সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের কাজকর্ম আবর্তিত হয়েছে অর্থ আর অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। জনপদের মধ্যে পণ্যের আদান-প্রদান হয়েছে, আনা-নেওয়া হয়েছে এক জনপদ থেকে অন্য জনপদেও। বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই বিভিন্নভাবে যুক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, ভৌগোলিক অবস্থান আর সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লব শুরুর সাথে সাথে অর্থনীতির তাত্ত্বিক দিকের যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে পরিচিত স্কটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, যিনি তার সুপ্রসিদ্ধ বই ‘অ্যান ইনকোয়ারি ইন্টু দ্য নেচার অ্যান্ড কজেজ অভ দ্য ওয়েলথ অভ নেশনস’-এর ধারণা দেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধার।
পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা বলতে, অন্য কোনো দেশের চেয়ে কম কাঁচামাল ব্যবহার করে কিংবা কম কর্মঘণ্টা ব্যবহার করে বেশি পণ্য উৎপাদন করতে পারার সক্ষমতা বোঝায়। ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্রের একজন শ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় আট একক পণ্য তৈরি করতে পারে, দক্ষিণ সুদানের একজন শ্রমিক পারে দুই একক। এই জায়গায় পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
আবার ধরা যাক, বাকি সকল প্রভাবক একইরকম নিয়ে প্রতি একক পণ্য উৎপাদনে দক্ষিণ সুদানের কর্মীকে দিতে হয় ১০ ডলার, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিককে দিতে হয় ৪০ ডলার। এক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা পাবে দক্ষিণ সুদান।
পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা মানেই স্বল্প খরচে সর্বোচ্চ আউটপুট পাওয়া। ভৌগোলিক অবস্থান আর পণ্য উৎপাদনের অর্থনৈতিক সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে অনেক দেশ এই নিরঙ্কুশ সুবিধা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকতে হলে প্রতিটি দেশকেই যেতে হয় স্পেশালাইজেশনের পথে, স্মিথের মতে, যা একসময় পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধার জন্ম দেয়।
কিন্তু কেন অ্যাডাম স্মিথ, আধুনিক অর্থনীতির জনক, পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধার উপর জোর দিয়েছেন?
প্রথমত, প্রতিটি পণ্য উৎপাদনের জন্যই পুঁজি, শ্রমমূল্য, প্রযুক্তির মতো কিছু উৎপাদন প্রভাবক কাজ করে। সাধারণত, নির্দিষ্ট কোনো পণ্যে একটা দেশ তখনই নিরঙ্কুশ সুবিধা পায়, যখন এর উৎপাদনের মূল প্রভাবকের প্রাচুর্য থাকে। এই প্রাচুর্যের কারণে উক্ত দেশ সে পণ্য অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে কম মূল্যে উৎপাদন করতে পারে, ফলে বেঁচে যায় পুঁজিপতিদের খরচ।
যেমন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশ শ্রমশক্তিপ্রধান দেশ। এর ফলে, এসব দেশে কম মূল্যে শ্রম পাওয়া যাচ্ছে, গড়ে উঠছে শ্রমনির্ভর শিল্প।
দ্বিতীয়ত, একটা দেশ যখন একটা পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা অর্জন করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, বিভিন্ন বাণিজ্য-বাধা দূর করে সুযোগ করে দেয় ব্যবসায়ীদের। ফলে, বৃদ্ধি পায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, যা থেকে বিভিন্নভাবে সুবিধাভোগী হতে পারে ক্রিয়াশীল সকল ফ্যাক্টর।
কেন নিরঙ্কুশ সুবিধা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে ব্যাখ্যা করতে পারে না?
অ্যাডাম স্মিথের নিরঙ্কুশ সুবিধা তত্ত্ব খুব বেশিদিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে ব্যাখ্যা করতে পারেনি, কিছু তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার দরুন।
প্রথমত, অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্বানুযায়ী, নিরঙ্কুশ সুবিধা বজায় রাখতে উৎপাদনের প্রভাবকগুলো এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবাহিত হতে পারবে না। কিন্তু, বিশ্বায়নের এ যুগে পুঁজি, শ্রমশক্তির একটা অবাধ প্রবাহ দেখা যায়, একই ধারা দেখা গেছে গত কয়েক শতাব্দীতেও।
দ্বিতীয়ত, একটি দেশ শুধু সেই পণ্য নিয়ে বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করবে, যাতে তার নিরঙ্কুশ সুবিধা রয়েছে, এ ধারণা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সংকুচিত করে, অনিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ আর শ্রমশক্তির কল্যাণে কিছু দেশ হয়তো সব পণ্য উৎপাদনে কিংবা অধিকাংশ পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু, ক্ষুদ্র বা বিকাশমান অর্থনীতিগুলোর দেশগুলো হয়তো কোনো পণ্য উৎপাদনেই নিরঙ্কুশ সুবিধা পাবে না। এই দুই দল বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতার তৈরি করবে।
চতুর্থত, তাত্ত্বিকভাবে, অ্যাডাম স্মিথের নিরঙ্কুশ সুবিধা তত্ত্ব অনুযায়ী, স্পেশালাইজেশনের ফলে প্রত্যেক শ্রমঘণ্টা থেকে নির্দিষ্ট একক পণ্য উৎপাদন করার কথা। অর্থাৎ, একজন শ্রমিক আট ঘণ্টা কাজ করে যদি ৪০ একক পণ্য তৈরি করতে পারে, তাহলে ১৬ ঘণ্টা কাজ করলে ৮০ একক পণ্য তৈরি করতে পারার কথা। কিন্তু, বাস্তবে এটা দেখা যায় না। ধীরে ধীরে শ্রমিকের প্রতি ঘণ্টায় আউটপুট একটা সময়ের পর কমতে থাকে।
প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি নাকি ফাঁদ?
তাহলে কি বর্তমান সময়ে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে নিরঙ্কুশ সুবিধা অর্জন করা অসম্ভব?
না, অসম্ভব নয়। এখনো কিছু কিছু দেশ ক্ষেত্রবিশেষে পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা অর্জন করছে, উৎপাদন প্রভাবকের প্রাচুর্যের উপর ভিত্তি করে।
যেমন, চীন একটা দীর্ঘসময়ের চেষ্টার ফলাফল হিসেবে ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় নিয়ে গেছে, পরিচিত হয়েছে বিশ্বের ফ্যাক্টরি হিসেবে। লেবার ইন্টেন্সিভ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামও তৈরি পোশাক খাতের সাপ্লাই চেইনে নিজেদের অপরিহার্য প্রমাণ করেছে।
তবে, নিরঙ্কুশ সুবিধার ক্লাসিক্যাল উদাহরণ হিসেবে খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির উদাহরণ ব্যবহার করা যায়। যেমন, তেল রপ্তানিতে একটা দীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষস্থান দখল করেছিল ভেনিজুয়েলা, ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ লিথিয়াম উৎপাদনে দীর্ঘদিন ধরেই শীর্ষস্থানে রয়েছে বলিভিয়া।
নিরঙ্কুশ সুবিধা অর্জনের পর দেশগুলো যেহেতু স্বল্প বিনিয়োগে সর্বোচ্চ আউটপুট পায়, ফলে স্বল্প মেয়াদে একটা অর্থনৈতিক বুম দেখা যায়, ব্যাপক বৃদ্ধি পায় রাজস্ব আয়। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জীবনমান, বড় হয় অর্থনীতির আকার, বাড়ে প্রবৃদ্ধি, বাড়ে মাথাপিছু আয়।
তাহলে, পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা কি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক?
উত্তর হ্যাঁ এবং না, দুটোই। যদি স্বল্পমেয়াদী অর্জনকে সামনে রেখে উত্তর চাওয়া হয়, তাহলে নিরঙ্কুশ সুবিধা ইতিবাচক, যার ফলাফলগুলো আগে আলোচনা করা হয়েছে।
কিন্তু, যখনই দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলের কথা আলোচনা হবে, নিরঙ্কুশ সুবিধা একটা দেশের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে।
একটা দেশ যখন দীর্ঘ সময় ধরে একটা নির্দিষ্ট পণ্য থেকে তার বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগ পায়, তখন সে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নাগরিক সুবিধাগুলোর মতো বিষয়গুলো পুরোপুরি নির্ভর হয়ে পড়ে নিরঙ্কুশ সুবিধা পাওয়ার খাতের উপর। আস্তে আস্তে দেশের শ্রমশক্তির বড় অংশ একটা খাতেই জড়িয়ে পড়ে।
এতটুকু পর্যন্ত অর্থনীতি ঠিকই থাকে। কিন্তু, যেকোনো প্রাকৃতিক কারণে বা মানবসৃষ্ট কারণে সাপ্লাই চেইনের পরিবর্তন ঘটতে পারে, পরিবর্তন ঘটে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে। তখন উক্ত দেশের অর্থনীতি মুখোমুখি হয় সংকটের, যেহেতু একটি খাতের উপরই নির্ভরশীল থাকে অর্থনীতি, ফলে বিপুল বাণিজ্যঘাটতির মুখোমুখি হয় দেশটি। এক খাতে নির্ভরতা থাকার কারণে অর্থনীতি পুনরায় স্থিতিশীল অবস্থায়ও আসতে পারে না দ্রুত। ফলে, মুদ্রার অবনমন হয়, বাড়ে মুদ্রাস্ফীতি। একটা সময় ভেঙে পড়ে পুরো অর্থনীতি। এ অবস্থা পরিচিত ডাচ ডিজিজ নামে।
ডাচ ডিজিজ টার্মটি প্রথম ব্যবহৃত হয় দ্য ইকোনমিস্টে, ১৯৭৭ সালে। একাডেমিক পরিসরে এটি প্রতিষ্ঠিত করেন ডব্লিউ ম্যাক্স করডেন আর জে পিটার ন্যারে, ১৯৮২ সালে।
নেদারল্যান্ডসে ১৯৫৯ সালে আবিষ্কৃত হয় বিপুল রিজার্ভসহ গ্যাসক্ষেত্র, যা পরবর্তী দশকে হয়ে ওঠে ডাচদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। এ খাতে বিপুল আয়ের সাথে সাথে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা এর উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়, ডলারের বিপরীতে বাড়তে থাকে ডাচ মুদ্রার মান। এতে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে উৎপাদন খরচ, ফলে পরবর্তী দশকের তাদের এই খাতে নিরঙ্কুশ সুবিধাটি চলে যায়। ফলাফল হিসেবে অর্থনৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়, শুরু হয় মুদ্রাস্ফীতি। বর্তমানে একই অবস্থার মধ্যে আছে ভেনিজুয়েলা। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ভেনিজুয়েলা ছিল বিশ্বের সর্বাধিক তেল উৎপাদনকারী দেশ, রাজস্বের সিংহভাগই আসতো এই খাত থেকে। অব্যবস্থাপনা আর অস্থিতিশীলতার জন্য সংকটে পড়ে এ খাত, ফলে বর্তমানে সংকটে পুরো ভেনিজুয়েলা।
পণ্য উৎপাদনে নিরঙ্কুশ সুবিধা থাকলেই একসময় সংকটে পড়া স্বাভাবিক। তবে, আয় রিজার্ভ করে রেখে আর এক্সচেঞ্জ রেটকে প্রভাবিত করে এই সংকটকে মোকাবেলা করা যায়। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশই দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা না করায়, সেই সংকটকে মোকাবেলা করতে পারে না। ফলে, নিরঙ্কুশ সুবিধা স্বল্পমেয়াদে প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি হলেও, দীর্ঘমেয়াদে আবির্ভূত হয় ফাঁদ হিসেবে।