ব্রেক্সিট সম্পর্কে সবারই কম বেশি জানা আছে। একইসাথে নাটকীয় পরিস্থিতি, বিশৃঙ্খলা ও তর্ক-বিতর্কের জন্ম হয়েছে এই ব্রেক্সিটের জন্য, যা থেকে পশ্চিমা দেশগুলোতে উদারতাবাদ সঙ্কট (Liberalism Crisis) লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে ব্রিটেনে ব্রেক্সিট ছাড়াও বিভিন্ন দেশে উদারতাবাদ সঙ্কট দেখা যায়। যেমন ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়, ইতালিতে পপুলিস্ট সরকার নির্বাচন, স্পেনের কাতালান বিদ্রোহ, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ভারতের কিছু অংশে পপুলিস্ট স্বৈরাচারীদের উত্থান প্রভৃতি। ব্রেক্সিট পর্যন্তই ইতিহাসের পাতায় এই উদারতাবাদ রাজনীতির উদাহরণের অভাব নেই। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
‘লিবারেলিজম’ বা ‘উদারনীতি’ বুঝতে হলে শুধুমাত্র ঘটনা জানাই যথেষ্ট নয়। এজন্য পুরোপুরি এবং স্পষ্টভাবে বিষয়টি জানতে হবে। যেমন- ব্রেক্সিটের পর, তথা ইইউ থেকে বের হওয়ার পর যদি ব্রিটেনকে একসাথে ধরে রাখতে হয়, তবে সেই দেশের বিজ্ঞ বা নেতাদের সাধারণ জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভের মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আর সেই হিসেবে কাজও করতে হবে। এখন কথা হলো, বারবার ‘লিবারেলিজম’ নামক যে শব্দটি বলছি তার আসল অর্থ কী? এর মধ্যে বিশৃঙ্খলার ব্যাপারই বা কীভাবে আসে? আর এই ঝামেলা থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়?
উদারতাবাদ হলো একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ, যা একজন ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসন, সুযোগের সমতা, ব্যক্তি বিশেষের অধিকার (মূলত জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তির) রক্ষা করার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। অবস্থার প্রেক্ষিতে এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয়। এই বিষয়টি ব্যাখা করেছেন ইংরেজ দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪) এবং স্কটিশ দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০)।
জন লক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের একটি তত্ত্ব তৈরি করেন, যা জন্মগত স্বতন্ত্র অধিকার এবং শাসিতদের সম্মতির উপর ভিত্তি করে করা হয়। অ্যাডাম স্মিথ এ বিষয়ে যুক্তি স্থাপন করে বলেন, সমাজ তখনই উন্নতি করতে পারে যখন কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তি নিজের স্বার্থ অন্বেষণের চেষ্টা করে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উৎপাদনের মাধ্যমগুলো এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তিগত একচেটিয়া স্বত্বাধিকারী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না।
উদারতাবাদ ও উপযোগবাদ
১৮ শতকের শেষের দিকে এবং ১৯ শতকের শুরুর দিকে ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেনথাম, ব্রিটিশ দার্শনিক জেমস মিল এবং তার পুত্র জন স্টুয়ার্ট মিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল ইকোনমিক প্রিন্সিপালস প্রয়োগ করেন। তারা ‘ইউটিলিটারিয়ান’ বা উপযোগবাদ এর ব্যাখা প্রদান করেন। উপযোগবাদ হলো একটি নৈতিক ও দার্শনিক তত্ত্ব, যেখানে সর্বোত্তম কাজটিই ‘ইউটিলিটি’ বা ‘উপযোগ’ বাড়াতে পারে। অথবা সবচেয়ে বেশি উপযোগ দিতে পারে। এই বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে তারা সংক্ষেপে বলেন, সর্বোত্তম সংখ্যাই সর্বোত্তম সুখ দেয়।
অর্থাৎ যত বেশি কাজ করা হবে, তত বেশি উপযোগ পাওয়া যাবে। কোন ধরনের সরকার এই উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, উপযোগবাদীরা সাধারণত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র সমর্থন করেন। আর এই ধরনের ব্যবস্থায় সরকারেরও স্বার্থ পূরণ হবে। বাজার অর্থনীতি থেকে ধারণা নিয়ে এই উপযোগবাদীরা এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করেন, যা নাগরিকদের যতটা সম্ভব পছন্দ ও কাজের দিক থেকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা করে। এর সাথে দক্ষ সরকার এবং সামাজিক ঐকতান বজায় রাখারও চেষ্টা করেন। তারা সম্প্রসারিত শিক্ষা ও মতামত এবং নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করেন। তবে এই উপযোগবাদ সবসময় মানুষের অধিকার ও সুখ নিশ্চিত করতে পারে না।
এ বিষয়ে জন স্টুয়ার্ট মিলের জীবন থেকে উদাহরণ দেওয়া যায়। তাকে ছোটবেলা থেকে তার বাবা জেমস মিল উপযোগবাদী হিসেবে বড় করে তোলেন। এতে জীবন নিয়ে তার ধারণা একটি দিকেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তার মতে, দুটি বিষয়ের জন্যই এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব রয়েছে- তৃপ্তি এবং কষ্ট।
বাবা তাকে সবসময় শেখাতেন, সবাইকে খুশি করার মধ্যেই আসল সুখ পাওয়া যায়। তবে তার জীবনে এমন এক সময় আসলো, যখন কোনো কিছুতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারছিলেন না। অন্যদের খুশি করে যে তার পক্ষে সুখী থাকা সম্ভব হচ্ছিল না তা তিনি নিজের আত্মজীবনীতেও উল্লেখ করেন। এই ধরনের অসন্তুষ্টির কারণে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
তিনি উপলব্ধি করেন, সুখ একটি অদ্ভুত বিষয়। একজন ব্যক্তি নিজে থেকে যা বিশ্বাস করে, যা করতে চায়, তা করার বাই প্রোডাক্ট বা উপজাতই হলো এই ‘সুখ’। তবে একটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পরবর্তীতে মিল আবার অন্যদের খুশি করার মধ্যেই নিজের সুখ খুঁজে পেতেন। এই পরিবর্তন তার ক্ষেত্রে দেখা যায় যখন তিনি ইতিহাসবিদ জিন ফ্রানকোইস মার্মোন্টেলের একটি বই পড়েন। বইটিতে জিন তার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটি পুরোপুরি খুলে বলেন। এই বই মিলকে আবার নতুন করে সুখের আসল অর্থ খুঁজে বের করতে জোর দেয়, নতুন করে এ সম্পর্কে ভাবতে প্রভাবিত করে।
মিল উপলব্ধি করতে পারেন, জীবনে সবসময় উপযোগবাদ সুখ দিতে পারে না। বেঁচে থাকার একটি আদর্শ লক্ষ্যও দিতে পারে না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এরকম যে, এখানে তৃপ্তি ও সুখের মধ্যে পার্থক্য বোঝানো হয় না। যারা উপযোগবাদী তারা সবকিছু টাকা বা মূল্যের ভিত্তিতে ভাগ করে, অথবা ভোগেই শান্তি পায়। এমন মানুষদের কাছে স্মৃতিচারণ করার ব্যাপারকে গুরুত্ব দেওয়া নিতান্তই হাস্যকর মনে হবে।
অথচ তারাই নতুন কোনো পরিবর্তনকে প্রথমে প্রতিহত করতে চায়। যা পেয়েছে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে যা হারিয়েছে সেটা নিয়ে দুঃখ করতেই ব্যস্ত থাকে। জন স্টুয়ার্টের মতে, উপযোগবাদ কোনো ব্যক্তির আচরণ যখন নিয়ন্ত্রণ করবে, তখন বাকিদের স্বার্থ অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জন মিলের ‘অন লিবার্টি’ বইয়ে এই সম্পর্কে ব্যাখা করা হয়। অবশ্য উপযোগবাদীরা তাদের তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে রাজনৈতিক লিবারেলিজম বা উদারতাবাদের দার্শনিক ভিত্তিগুলো বিস্তৃত করেন এবং উদারতাবাদের নির্দিষ্ট সংস্কারবাদী লক্ষ্যগুলোও পূরণ করেন। এখান থেকে লিবারেলিজমের বিষয়টি বিস্তৃত হয়।
বিখ্যাত স্কটিশ দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথ এই উপযোগবাদ ও উদারতাবাদ সম্পর্কে ব্যাখা দিতে গিয়ে বলেন, একটি অদৃশ্য হাত কোনো ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ পূরণ করলে তা তার আশেপাশের ব্যক্তিদেরও উপকার করে থাকে।
ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেনথাম এই যুক্তিটির উপর ভিত্তি করেই তার মত প্রকাশ করেন। তার মতে, সব মানুষ সবসময় যৌক্তিক চিন্তাভাবনা করেন না। তবে স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে শিখলে সকলেই উপকৃত হবে। কিন্তু কোনো বিষয়ে কোনো পক্ষ যে যৌক্তিক তা কীভাবে বোঝা যাবে তা খুঁজে বের করা কঠিন। আর এজন্যই যত ঝামেলা। গত চার দশক ধরে লিবারেলিজমের বিষয়টি সফল হলেও এখন এটি বিচ্ছিন্ন।
ঔদ্ধত্য এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের দরুণ এই উদারতাবাদের নীতি এখন আর ঠিক নেই। এরকমই জানান ইউনিভার্সিটি অব নটর ডেমের অধ্যাপক প্যাট্রিক ডিনিন। তিনি তার বই ‘হোয়াই লিবারেলিজম ফেইলড’ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তিনি জানান, সাম্প্রতিককালে লিবারেলিজমের রেকর্ডটি বেশ হতাশাজনক। স্বার্থপরতা ও আত্মবিরোধী হিসেবে লিবারেলিজমের পূর্ব ধারণা থেকে এখনও অনেক কিছু শেখার রয়েছে। তবে তা এখন আর করা হচ্ছে না। ইতিহাস থেকে এর সমাধান পাওয়া সম্ভব। তবে আলোচনাটি শুধুমাত্র লিবারেলিজমের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে করা হলে আসল সমাধান পাওয়া যাবে না।