মায়ের ৩০ হাজার পাউন্ড ‘চুরি করে’ মিলিয়নিয়ার!

মিলিয়নিয়ার হওয়া কি চাট্টিখানি কথা? এজন্য দরকার প্রচুর পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, কাজের প্রতি ভালোবাসা, হার-না-মানা মনোভাব। সেই সাথে প্রয়োজন ভাগ্যের ছোঁয়াও। কিন্তু এই সবকিছুর পরও একজন ব্যক্তি মিলিয়নিয়ার হয়ে যাবে, জীবনে সফলতার দেখা পাবে, সেরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই কখনো কখনো মানুষ সহজে মিলিয়নিয়ার হতে নীতি-বহির্ভূত কাজেরও আশ্রয় নেয়। মিলিয়নিয়ার হওয়ার পথে সেরকমই একটি অনৈতিক কাজ করেছিলেন ধারাবাহিক প্রযুক্তি উদ্যোক্তা অ্যান্ড্রু মাইকেল।

চৌর্যবৃত্তি কিংবা একটি বিশাল ঝুঁকি

সালটা ১৯৯৭। অ্যান্ড্রুর বয়স তখন ১৭। মায়ের সাথে পশ্চিম ইংল্যান্ডের শেলটেনহ্যামে থাকেন। সে সময়ই দারুণ একটা ব্যবসার সুযোগ নজরে পড়ে তার। এক স্কুল বন্ধুর সাথে নিজস্ব ওয়েবসাইট খুলতে গিয়ে তিনি খেয়াল করে দেখেন, যুক্তরাজ্যে সেই সময় যেসব ওয়েব-হোস্টিং কোম্পানি বিদ্যমান, তাদের মধ্যে অধিকাংশই কেবল বৃহৎ কোম্পানিদের সাথে কাজ করছে। ছোট কোম্পানি বা ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজন মেটাতে তেমন কোনো ওয়েব-হোস্টিং কোম্পানিই নেই। ফলে যাদের বাজেট সীমিত, তাদেরকে ওয়েবসাইট খোলার ক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এখান থেকেই দারুণ এক আইডিয়া খেলে যায় অ্যান্ড্রুর মাথায়। বাজারে যে জিনিসটির শূন্যতা রয়েছে, তা কেন তারা নিজেরাই পূরণ করেন না? এমন ভাবনা থেকেই অ্যান্ড্রু আর তার বন্ধু ঠিক করলেন, তারা নিজেরাই ওয়েব-হোস্টিং কোম্পানি দাঁড় করাবেন, নাম দেবেন ‘ফাস্টহোস্টস’।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ঝুঁকি নিয়ে আসছেন অ্যান্ড্রু; Image Credit: Grant Triplow

নিজস্ব কোম্পানি চালু করতে তাদের সবার আগে প্রয়োজন ছিল কম্পিউটারের। তবে কম্পিউটার অ্যান্ড্রুর ছিল। সফটওয়্যার নিয়েও তাদের বিশেষ কোনো ঝামেলা হয়নি, কারণ নিজেদের সফটওয়্যার তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছিলেন। সমস্যাটা হলো ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে। ওয়েব-হোস্টিং কোম্পানি চালাতে গেলে সাধারণ ইন্টারনেট সংযোগই যথেষ্ট নয়, দরকার দ্রুতগতির ইন্টারনেট। তখনকার দিনে বাড়িতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া সহজ বিষয় ছিল না, রীতিমতো রাস্তা খুঁড়ে সংযোগ আনতে হতো। আর সেজন্য মোট খরচ পড়ত ৩০ হাজার পাউন্ড।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দশা হলো অ্যান্ড্রুর। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি বা তার বন্ধু কোথা থেকে, কীভাবে জোগাড় করবেন? ১৭ বছর বয়সী দুটি ছেলেকে ৩০ হাজার পাউন্ড কে-ই বা দেবে? উপায়ন্তর না দেখে, অ্যান্ড্রু মাকে কিছু না জানিয়েই তার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ৩০ হাজার পাউন্ড খরচ করে ফেললেন, এবং টেলিফোনে অর্ডার দিলেন ইন্টারনেট সংযোগ আপগ্রেডের। এছাড়াও কিছু ম্যাগাজিনে নিজেদের কোম্পানির বিজ্ঞাপনও ছাপালেন তিনি, যাতে করে মানুষজন তাদের সেবা গ্রহণে আগ্রহী হয়।

ব্যবসায় সফল হতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়, আর অ্যান্ড্রু তার প্রথম ব্যবসাটিতেই সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটি নিয়েছিলেন। তার মা যদি কোনোভাবে জেনে যেতেন যে, ৩০ হাজার পাউন্ড খরচ করা হয়েছে তার ক্রেডিট কার্ড থেকে, তাহলে অ্যান্ড্রুকে আর আস্ত রাখতেন না তিনি। কিন্তু অ্যান্ড্রুর পরিকল্পনা এমন ছিল যে, তারা প্রথম মাসেই তাদের ব্যবসা থেকে এত পরিমাণ আয় করে ফেলবেন যে, বাড়িতে ক্রেডিউ কার্ডের বিল আসা মাত্রই তারা তা মিটিয়ে ফেলতে পারবেন।

অভাবনীয় হলেও সত্যি, অ্যান্ড্রুর পরিকল্পনা কাজে লেগেছিল। প্রথম মাসেই তারা যথেষ্ট সংখ্যক ক্লায়েন্ট পেয়ে গিয়েছিলেন, ফলে খুব সহজেই ইন্টারনেট লাইন ও বিজ্ঞাপন বাবদ ক্রেডিট কার্ড থেকে খরচ হওয়া অর্থ পরিশোধ করে দিতে পেরেছিলেন। এবং সবচেয়ে বড় কথা, ছেলের উদ্দেশ্য সৎ ছিল বুঝতে পেরে অ্যান্ড্রুর মা-ও শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

অব্যহত রইল অ্যান্ড্রুর পথচলা

ব্যবসায়ী জীবনের প্রথম মাসে পাওয়া সাফল্যকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হতেই পারত, যদি অ্যান্ড্রু এই সাফল্য পরবর্তী সময়ও ধরে রাখতে না পারতেন। তবে তিনি পেরেছিলেন। কেননা নিজের লক্ষ্যে তিনি সবসময়ই ছিলেন অবিচল। ১৭ বছর বয়সে শুরু করা ব্যবসাটি কোনো ‘খেয়ালের বশে নেয়া’ উদ্যোগ ছিল না। তখন থেকেই তিনি জানতেন, জীবনে এই কাজ করেই বড় হতে হবে তাকে। তাই বছরখানেক পর তার সেই সহযোগী বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চলে গেলেও, অ্যান্ড্রু তার নিজের উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন থেকে পূর্ণ মনোযোগ তিনি ফাস্টহোস্টসকেই দেবেন, এই কোম্পানিকেই অনেক বড় করে তুলবেন।

অ্যান্ড্রু ও বার্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কাই ফেলার; Image Source: Andrew Fosker/PinPep

ফাস্টহোস্টস কি প্রাথমিক সফলতা ধরে রাখতে পেরেছিল? অ্যান্ড্রু কি তার জীবনের দ্বিতীয় বড় ঝুঁকিটিও জয় করতে পেরেছিলেন? এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আপনাদেরকে জানতে হবে একটি বিশেষ তথ্য: ২৬ বছর বয়সে, ব্যবসা শুরুর নয় বছর পর ফাস্টহোস্টস বিক্রি করে দেন অ্যান্ড্রু। তখন ফাস্টহোস্টসের মূল্যমান ছিল ৬১.৫ মিলিয়ন পাউন্ড। এবং যেহেতু এই কোম্পানির ৭৫% মালিকানা ছিল অ্যান্ড্রুর, তাই তিনি নিজের পকেটে পুরেছিলেন ৪৬ মিলিয়ন পাউন্ড।

এর বছর দুই পরে অ্যান্ড্রু ‘লাইভড্রাইভ’ নামে একটি নতুন ক্লাউড স্টোরেজ ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে সেটিও বিক্রি করে দেন তিনি। ঠিক কত পাউন্ডে তিনি লাইভড্রাইভ বিক্রি করেছিলেন তা জানা না গেলেও, ধারণা করে নিতে অসুবিধা হয় না যে এটি বিক্রি করেও অ্যান্ড্রু বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন।

একাধারে যেমন অ্যান্ড্রুর দুটি ব্যবসাই সফল বলে প্রমাণিত হলো, তিনি পত্রিকার শিরোনাম হতে লাগলেন পার্টিতে লাগামছাড়া খরচের কারণেও। ফাস্টহোস্টসের ক্রিসমাস পার্টিতে পারফর্ম করেছিল গার্লব্যান্ড ‘গার্লস অ্যালাউড’ ও ‘সুগাবেবস’। এছাড়াও ছিল রকার্স ‘দ্য ডার্কনেস’, এবং অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন চ্যাট-শোর উপস্থাপক জোনাথন রস। এমনকি একবার এক প্রেমিকার জন্মদিনের পার্টিতে গান গাওয়ার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়িয়ে এনেছিলেন আর অ্যান্ড বি গায়ক আশারকেও। এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রুর বক্তব্য, “আমি পার্টি করতে ভালোবাসি, মানুষকে বিনোদন দিতে ভালোবাসি। এবং আমি কোনোকিছুই অর্ধেক করি না।

স্যার রিচার্ড ব্র্যানসনের সাথে অ্যান্ড্রু; Image Credit: Andrew Michael

সাফল্যের নেপথ্যে

অ্যান্ড্রুর জন্ম সাইপ্রাসে, কিন্তু বেড়ে ওঠা শেলটেনহ্যামে। তার নিজের বিশ্বাস, ব্যবসায়ী মানসিকতা ও একাগ্রতা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে।

আমার বাবা এসেছিলেন সাইপ্রাস থেকে, এবং তিনিও ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ছোটখাট ব্যবসায়ী। অন্যান্য সাইপ্রিয়টসদের মতোই, তিনিও মাছের দোকান দিয়েছিলেন, ক্যাফে খুলেছিলেন। তাই আমার শৈশব কেটে গেছে ঐসব সাইটে ঘুরে বেড়িয়ে, পাওয়া অর্থ সংগ্রহ করে, এবং ব্যবসার নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করে। খুব অল্প বয়স থেকেই আমার মধ্যে ছিল ব্যবসায়ী হওয়া ও টাকা কামাবার মতো, ধর-তক্তা-মার-পেরেক শ্রেণীর মানসিকতা।

এখন যখন অ্যান্ড্রু পেছন ফিরে তাকান, চিন্তা করেন কীভাবে তিনি ফাস্টহোস্টসকে বড় করে তুলেছিলেন, তখন তার নিজের কাছেই মনে হয় তিনি ছিলেন ‘লেজার ফোকাসড’, অন্য কোনো কিছুই তখন তাকে ভাবিত করত না।

অপূর্ণতা ও বিষণ্ণতা

তবে ২০০৬ সালে যখন তিনি ফাস্টহোস্টস বিক্রি করে দিলেন, হঠাৎ করেই তিনি প্রচুর ধনী হয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা অপূর্ণভাবও রয়ে গিয়েছিল।

আমার মনে আছে আমি অফিসে বসে ছিলাম, যখন আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ প্রবেশ করল। আমি ভেবেছিলাম এতে আমি সত্যিই অনেক খুশি হবো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার মধ্যে একটা তলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছিল, যখন আমি অফিস থেকে বের হয়ে আসলাম এবং অনুধাবন করলাম এই সবকিছুই আমি বিক্রি করে দিয়েছি, এখন আমার কাছে এগুলো স্প্রেডশিটে থাকা কিছু সংখ্যা বৈ আর কিছুই নয়।

লাইভড্রাইভের নির্বাহীদের সাথে অ্যান্ড্রু; Image Source: Success Story

পরবর্তীতে বিষণ্ণতা ভর করেছিল অ্যান্ড্রুর মনে। একদম ছোটবেলা থেকে কাজে ডুবে থাকার পর, হঠাৎ পাওয়া অবসর সহ্য করা সহজ ছিল না তার জন্য। ড্রিংক করে আর প্রচুর খাওয়াদাওয়া করে জীবনের উপর ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তখন তিনি বুঝতে পারেন, কাজে ফিরে যাওয়াই তার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। কাজ করতে থাকলেই মানসিকভাবে সুখী থাকবেন তিনি। এ কারণেই দুই বছর পর তিনি লাইভড্রাইভ নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করেন।

নতুন চ্যালেঞ্জ

লাইভড্রাইভের শুরুর পথচলা সুখকর হয়নি। জনাকীর্ণ বাজারব্যবস্থার মাঝে পড়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে সেটি। অ্যান্ড্রু দেখতে পান, একই সময় আরো অনেক মানুষ এই একই আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে। তাই শুধু বিজ্ঞাপনই ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথেষ্ট নয়। ফলে প্রথমবারের মতো ব্যর্থতার চিন্তা উঁকি দিয়ে গিয়েছিল তার মনে। তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন, নিজের প্রথম আইডিয়াটা কপালজোরে কাজ করেছে বটে, কিন্তু এবার আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়তে হবে তাকে।

অবশ্য ভাগ্য তখনো ছেড়ে যায়নি অ্যান্ড্রুকে। নতুন এক বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়ে যান তিনি। ইলেকট্রনিক্স রিটেইলার ডিক্সনসে কাজ করতেন সেই বন্ধু। তার মাধ্যমে ডিক্সনসের সাথে মিলেই নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা শুরু করেন তিনি। ডিক্সনস ঠিক করে, তারা লাইভড্রাইভকে তাদের প্রোডাক্ট তৈরিতে সাহায্য করবে, এবং তারপর নিজেরা যেসব ল্যাপটপ ও ট্যাবলেট বিক্রি করবে, সেগুলোতে লাইভড্রাইভের প্রোডাক্ট ইনস্টল করে দেবে।

নতুন এই ব্যবসায়িক ধারণাটি ব্যাপক সাফল্য পায়। এতটাই হিট ছিল লাইভড্রাইভ যে, তারা অন্যান্য রিটেইলারের সাথেও কাজ করতে শুরু করে। এভাবে ধীরে ধীরে লাইভড্রাইভের ব্যবসা ফাস্টহোস্টসকেও ছাড়িয়ে যায়।

কাঠমিস্ত্রী থেকে শুরু করে গিটার শিক্ষক, সবার দেখা মিলবে বার্কে; Image Source: Bark

এরপর…

২০১৪ সালে লাইভড্রাইভ বিক্রি করে দেন অ্যান্ড্রু। তার সাম্প্রতিক ব্যবসা হলো বার্ক ডট কম, যে ওয়েবসাইট থেকে ব্যবহারকারীরা যেকোনো ধরনের স্থানীয় পেশাজীবীকে ‘বুক’ করতে পারে। কাঠমিস্ত্রী থেকে শুরু করে গিটার শিক্ষক, ডগ ওয়াকার কিংবা ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক, সবাইকেই পাওয়া যায় এই ওয়েবসাইটে। অনেকের কাছেই এ ধরনের সেবা নতুন কিছু মনে হচ্ছে না, কারণ ইতিমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশেও এমন সেবাদানকারী ওয়েবসাইট চালু হয়ে গেছে। তবে এই অঙ্গনে একদম প্রথম কাজ শুরু করাদের অন্যতম অ্যান্ড্রুই।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about Andrew Michael, the serial technology entrepreneur Andrew Michael, who gambled on changing his life by spending £30,000 on his mother's credit card without her knowledge. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Andrew Fosker/PinPep

Related Articles

Exit mobile version