আমি কিছুটা ভয় পাচ্ছি, কিন্তু আমি অনেক বেশি খুশি আর উত্তেজিত। আমি আমার জীবন আবার নতুন করে শুরু করতে পারবো।
– বিয়াট্রিস কাপিতো, ১৭ বছর বয়সী মালাউইয়ান কিশোরী
না, বিয়াট্রিস কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি বা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার নন যেখান থেকে তাকে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবতে হচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের কিছুক্ষণ আগে এমনটাই বলছিলেন ৪ বছর বয়সী পুত্রের ১৭ বছর বয়সী জননী বিয়াট্রিস। একজন কিশোরীকে যদি এভাবে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবতে হয়, তবে তা আধুনিক মানব সভ্যতার জন্য চরম অপমানজনক! শুধু ১৭ বছর বয়সী বিয়াট্রিস নয়, মালাউইতে নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ খুঁজছে ৭ বছর বয়সী শিশুরাও!
নতুন করে শুরুর কারণ কী? কারণটি যেকোনো দুরারোগ্য ব্যাধি বা সড়ক দুর্ঘটনার চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর কিছু সামাজিক প্রথা যেমন বাল্য বিবাহ ও শৈশবে ‘যৌন দীক্ষা’। অন্ধকার যুগের চেয়েও ভয়াবহ এই সামাজিক প্রথা এখনও নিয়মিতভাবে চর্চা হচ্ছে মালাউই সহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে।
২০১২ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মালাউইর অর্ধেকেরও বেশি মেয়েদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়া হয়। এসকল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানও বেশ নাজুক। সাধারণ তালিকার শেষের দিকের দেশগুলোতে এই অবস্থা প্রকট। এই তালিকায় বিশ্বের ১৮২টি দেশের মধ্যে মালাউইর স্থান ১৬০তম (২০১৭ সালের তথ্যানুযায়ী)। সেই সাথে এই দেশটিতে এইচআইভি এর সংক্রমণও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে মালাউই ভূখণ্ডের মধ্যভাগে অবস্থিত দেজ্জা অঞ্চলের উপজাতীয় গোষ্ঠীর ‘সিনিয়র চিফ’ তথা ‘জ্যেষ্ঠ গোত্র প্রধান’ হিসেবে ১৫ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন থেরেসা কাচিন্দামোতো। তার শাসনামলে তিনি প্রায় ২,৬০০ (মে ২০১৮ পর্যন্ত সময়কালে) বাল্য বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। সেই মেয়েদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের শিক্ষার পথ সুগম করেছেন। এমনকি তাদের শিশু সন্তানদের যথাযথ লালন পালনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছেন।
তার অধীনে দায়িত্বরত আছেন মোট ৫১ জন উপগোত্র প্রধান (৪০ জন পুরুষ ও ১১ জন নারী)। এদের প্রত্যেকেই উক্ত অঞ্চলের ১০টি করে গ্রামের দায়িত্বে বহাল আছেন। কাচিন্দামোতো তাদের সবাইকে একত্র করে প্রত্যেকের সাক্ষর সম্বলিত একটি চুক্তি তৈরি করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, উক্ত অঞ্চলে প্রচলিত বাল্য বিবাহ বন্ধের উদ্দ্যেশ্যে তারা সকলেই অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
২০১৫ সালে মালউইর সংসদে বাল্য বিবাহ রোধে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করে আইন পাস করা হয়। তবে এই আইনের বাইরেও মেয়েরা বাবা-মায়ের অনুমতি সাপেক্ষে ১৮ বছরের নিচেও বিয়ে করতে পারে। ২০১৫-২০১৭ পর্যন্ত এই ৩ বছরে বাল্য বিবাহ বিচ্ছদের সংখ্যা ছিল ৮৫০ এরও বেশি। আর শুধু ২০১৭ সালেই এই সংখ্যা ছিল ২০০ এরও বেশি।
এছাড়াও কাচিন্দামোতো যুগ যুগ ধরে চলে আসা যৌন দীক্ষা প্রদানের নোংরা রীতিটিও বন্ধ করেছেন। এই যৌন দীক্ষার প্রথা অনুযায়ী, দেজ্জাসহ এরকম আরও অনেক অঞ্চলেই মেয়ে শিশুদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হবার সাথে সাথেই যৌনতা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ৩ দিন ব্যাপী একটি ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ক্যাম্পে এই কিশোরীদের, পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের যৌন অঙ্গভঙ্গী শেখানো হয়। এই ক্যাম্পকালীন দীক্ষার শেষ পরীক্ষা হয় প্রশিক্ষকের সাথে যৌন মিলনের মাধ্যমে। এই জঘন্য মানবেতর প্রথাটিকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘কুসাসা ফুম্বি’, বাংলায় যার অর্থ ‘শুদ্ধিকরণ’।
ধারণা করা হয়, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরুষদের বেশ কিছু রোগমুক্তি ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে এই প্রথার কারণে এইডস সহ বিভিন্ন ধরনের যৌন রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার আরও বেড়েছে। এমনকি ৭ বছরের শিশু কন্যাদেরও এই ক্যাম্পে পাঠানো হয়ে থাকে। সব মেয়েরা এখানে শেষ পর্যায় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। তাদের জন্য বাড়িতেই কোনো পুরুষের দ্বারা এই শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এই পুরুষটিকে প্রথা অনুযায়ী ‘হায়েনা’ বলা হয়ে থাকে। এই পুরুষটি অনেক ক্ষেত্রেই বাবা, ভাই বা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় হতে পারে।
ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, মালাউইতে প্রতি ৫ জনে ১ জন মেয়ে ও প্রতি ৭ জনে ১ জন ছেলে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। দেশটির রাজধানী লিলোঙ্গোয়েতে কর্মরত ইউনিসেফ এর শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা নানকালি মাকসুদ আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন:
ছোট ছোট শিশুদের সুরক্ষা দেয়া যাদের কর্তব্য, তারাই এই সকল যৌন হয়রানিমূলক কাজে সক্রিয়। আর এ কারণেই এই প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপে তাদের অংশগ্রহণ কম।
যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা এই সকল নির্লজ্জ প্রথা রদ করার জন্য কাচিন্দামোতোকে বিভিন্ন দুর্যোগও মোকাবেলা করতে হয়েছে। যার মধ্যে সরাসরি মৃত্যুর হুমকিও ছিল। কিন্তু নিজস্ব শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে তিনি সে সকল বাধা অতিক্রম করে সাফল্য অর্জন করেছেন। তার নামের মাঝেই এই সাহসিকতার পরিচয় নিহিত রয়েছে। মালাউই অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা ‘শিচেওয়া’তে কাচিন্দামোতো শব্দের অর্থ ‘আগুন নিয়ে খেলো না’।
১২ ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ও বর্তমানে ৫ পুত্র সন্তানের জননী থেরেসা কাচিন্দামোতো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পরে নিজ গ্রাম তাকাতাকা থেকে ২০০ মাইল দূরে দক্ষিণ মালাউই’র জোম্বা অঞ্চলের একটি কলেজে অফিস সেক্রেটারি হিসেবে চাকরি নেন। সেই চাকরির ২৭ বছর সময়কালে বা তার আগেও, তিনি কখনোই চিন্তা করেননি যেয এক সময় তাকে ৫৪৫টি গ্রাম ও প্রায় ৯ লক্ষ অধিবাসী সম্বলিত দেজ্জা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ গোত্র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন তার উপজাতীয় রাজ-পরিবারের ১৫ জন সদস্যের নির্দেশে তাকে এই দায়িত্ব নিতে হয়। তার বাবাও এক সময় এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নেতৃত্ব গুণের কারণেই বড় ভাইয়ের (বাবার পরে তিনি জ্যেষ্ঠ গোত্র প্রধান ছিলেন) মৃত্যুর পর তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দায়িত্ব পালনকালেই ১২ বছর বয়সী কিশোরীদের কোলে বাচ্চা দেখে তিনি মর্মাহত হন আর তৎক্ষণাৎ বাল্য বিবাহ রদের নির্দেশ দেন।
তোমরা পছন্দ কর আর না-ই বা কর, এই বিয়েগুলো ভাঙতেই হবে। – থেরেসা কাচিন্দামোতো
এই যুদ্ধ জয়ের পথটি ছিল বেশ বন্ধুর। শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরনের হুমকি আর বিপদ নয়, এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল গ্রামবাসীর অসহযোগিতা। তিনি কন্যা সন্তানের মা নন, কাজেই মেয়েদের লালন পালন ও শিক্ষার কারণে হওয়া অর্থের অপচয় সম্পর্কেও তিনি যেমন জানেন না, তেমনি মেয়ে সন্তানদের ভালমন্দ সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা নেই- এই ধরনের কটূক্তিও তাকে অনেক বার শুনতে হয়েছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাল্য বিবাহের বিষয়টি লুকিয়ে রাখা হতো যার কারণে তিনি জানতেও পারতেন না যে তার আদেশ অমান্য হচ্ছে। এমনকি তার অধীনস্থ ৪ জন উপগোত্র প্রধান অঙ্গীকার ভঙ্গ করেও বেশ কিছু বাল্য বিবাহের আদেশ দেন। কাচিন্দামোতো তৎক্ষণাৎ তাদের বহিষ্কার করেন। এরপর তারা কয়েক বছর যাবৎ নিজস্ব চেষ্টায় আরও কিছু বাল্য বিবাহ বন্ধ করলে তিনি গোপনসূত্রের মাধ্যমে তাদের কথার সত্যতা যাচাই করেন। সত্যতা প্রমাণিত হলে তবেই তাদেরকে আবার তাদের পূর্বপদ পূর্ণ মর্যাদার সাথে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
শুধু এই সত্যতা যাচাই করার জন্যই নয়, বরং গোপনে অনুষ্ঠিত বাল্য বিবাহের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এবং নির্যাতিত মেয়েদের উদ্ধারের জন্য প্রতিটি গ্রামেই স্থানীয় মহিলা ও পুরুষদের সমন্বয়ে কাচিন্দামোতো ‘সিক্রেট মাদার্স গ্রুপ’ ও ‘সিক্রেট ফাদার্স গ্রুপ’ গঠন করেছেন। এদের মূল কাজ হচ্ছে চোখ-কান খোলা রেখে গোপনে অনুষ্ঠিত বাল্য বিবাহ, যৌন দীক্ষা সহ যেকোনো ধরনের নির্যাতনের হাত থেকে মেয়ে শিশুদের রক্ষা করা ও পুনর্বাসনে সহযোগিতা করা।
এছাড়াও তিনি স্বেচ্ছাসেবী মেয়েদের নিয়ে দল গঠন করেছেন। এরা নির্যাতিত মেয়েদের পুনর্বাসন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ ও জীবিকার ব্যবস্থা করতে সাহায্য করে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে শহর থেকে কর্মজীবী মেয়েদের গ্রামের স্কুলে এনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যবস্থাও করেন কাচিন্দামোতো। এতে শিশু ও কিশোরী মেয়েদের মাঝে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এমনকি মালাউই’র সংসদে ব্যবহৃত ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রতিও তারা আগ্রহ প্রকাশ করছে। খেলাধুলায়ও এই সকল মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে।
যদি তারা শিক্ষিত হয়ে ওঠে, তাহলে তারা জীবনে যা ইচ্ছা পেতে পারে এবং যেভাবে খুশি নিজেদের জীবনকে সাজিয়ে নিতে পারে।
– থেরেসা কাচিন্দামোতো
মালাউইতে নারী জাগরণের পথিকৃৎ এই সাহসী নারী তার অবদানের জন্য ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে নারীদের সহযোগিতা প্রদানকারী সংস্থা ‘ভাইটাল ভয়েসেস’ এর পক্ষ থেকে ‘গ্লোবাল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ এ ভূষিত হন। ওয়াশিংটন ডি.সি. তে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে দেশটির প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন উপস্থিত ছিলেন। ২০১৫ সালে বাল্য বিবাহ রোধের জন্য পাসকৃত আইনের সাফল্যকে অভিনন্দন জানাতে ও তার এই উদ্যোগকে আরও অনুপ্রাণিত করতে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে অভিনেত্রী ও জাতিসংঘের নারী বিষয়ক শুভেচ্ছা দূত এমা ওয়াটসন তাকাতাকা গ্রাম পরিদর্শন করেন এবং কাচিন্দামোতোর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
তবে তার যুদ্ধ এখনও চলছেই। সামাজিক অসহযোগিতাকে বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এখনও তাকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। এই অর্থনৈতিক বাধাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে অসংখ্য মেয়ের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও শিক্ষার খরচ বহন করেন। এই সকল মেয়েদের নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন।
মেয়েদের শিক্ষার পথ সুগম করার জন্য ভবিষ্যতে কলেজ পর্যায়ে বৃত্তির ব্যবস্থা করতে চাই। তাদের মেধাকে পুরোপুরি বিকশিত করার জন্য চাকুরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাই। আর আমরা সেই উদ্দ্যেশ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।
-থেরেসা কাচিন্দামোতো