বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামো হলো পুঁজিবাদ। গত শতকের ৯০’র দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের সাথে সাথে সমাজতন্ত্রের ভাগ্য মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে যায়। পুঁজিবাদ তখন থেকেই সর্বেসর্বা। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই কাঠামো ধারণ করলেও এর রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। পুঁজিবাদের কারণে সংস্কৃতি বিনষ্ট হচ্ছে, মানুষের মানবিক গুণাবলী ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, গুটিকয়েকের মাঝে সমস্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, আরো অসংখ্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আসলেই কি তা-ই? যদি পুঁজিবাদ এসব সমস্যার নিয়ামক হয়ও, তাহলে কীভাবে? চলুন জানা যাক।
কমছে পুঁজিবাদের গ্রহণযোগ্যতা
শুরু করা যাক সিএনএনের একটি বিশেষ সমীক্ষা দিয়ে। উল্লেখ্য, প্রাসঙ্গিক এ তথ্য-উপাত্ত পুঁজিবাদের প্রধান ধারক আমেরিকা অর্থনৈতিক কাঠামো থেকেই নেয়া। সিএনএনের সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ২১-৩২ বছর বয়সের প্রায় ৬৬ শতাংশ আমেরিকান মানুষই ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করছেন না। এ অংশটা প্রবল পুঁজিবাদ বিরোধী এবং তাদের সঞ্চয় না করার অন্যান্য কারণের মাঝে একটি হচ্ছে এই যে, পুঁজিবাদ আর বেশিদিন টিকবে না! তাদের বিশ্বাস, তাদের অবসরপ্রাপ্তির বয়স অর্থাৎ ষাটোর্ধ্ব হতে হতে পুঁজিবাদ পৃথিবী থেকে মুছে যাবে।
তখন সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটতে পারে, যা ঘটলে অর্থ সঞ্চয় করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। অথবা, পৃথিবীর তাবৎ প্রাকৃতিক সম্পদ ফুরিয়ে যাবে, পৃথিবী এক সংকটময় পরিস্থিতিতে উপনীত হবে যখন অত্যধিক ধনীরা সবকিছুর মালিক হবে আর দরিদ্র মানুষেরা বেঁচে থাকার তাগিদে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে বসবাস করবে। এই কাল্পনিক দৃশ্যপট পরিচিত লাগছে কি? এটি ‘ম্যাড ম্যাক্স’ সিনেমার মতো কল্পনা।
সমাজতন্ত্র আসবে নাকি ম্যাড ম্যাক্সের মতো অর্থনীতি, সে তর্ক এখানে মুখ্য নয়। এই সমীক্ষার মূল নির্যাস এই যে, মানুষ পুঁজিবাদকে আর পছন্দ করছে না। যার প্রমাণ দিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্টের একটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনও। ২০১৬ সালের সে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আমেরিকার ১৮-২৯ বছর বয়সী মানুষের সিংহভাগই পুঁজিবাদকে অপছন্দ করেন এবং এ ব্যবস্থার বিলোপ চান! কিন্তু কেন এমন ঘটছে? উৎপাদনযন্ত্র ব্যক্তিমালিকানায় রাখার পক্ষপাতী এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মুণ্ডুপাত কেন করছে সাধারণ মানুষ?
পুঁজিবাদের উদ্ভব
পুঁজিবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল ইউরোপে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামক মধ্যযুগের সেই ভয়াবহ মহামারী থেকেই। ১৬ শতকের সেই মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছিল ইউরোপের ৬০ ভাগের অধিক মানুষ! এর পর থেকে ইউরোপের চেহারাই বদলে যায়। সমাজ, সংস্কৃতির সাথে অর্থনৈতিক কাঠামোও বদলে যায়। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়াদের একটা ছোট্ট অংশ হঠাৎ পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় ক্ষমতাধর হয়ে উঠলো। তারা দেশের বাইরেও নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে শুরু করলো। সামন্ত সমাজের পতন ঘটলো আর ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণীর হাত ধরে এলো উপনিবেশবাদ, দাসত্ব আর সাম্রাজ্যবাদ।
১৮ শতক শুরু হতে হতে ইংল্যান্ডে শিল্পায়ন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। কৃষি, স্থানীয় বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি ছেড়ে ধোঁয়া ওঠা চিমনী, কয়লার গাড়ি, গরম বাষ্প নিঃসরণ করা টেক্সটাইল মিল, বড় বড় রাসায়নিক কারখানা, এসবই হয়ে ওঠে শিল্পায়িত ইংল্যান্ডের চিত্র। এ চিত্র ছিল পুঁজিবাদের প্রাথমিক স্কেচ। ১৭৭৬ সালে পুঁজিবাদের জনক হিসেবে পরিচিত অ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েলথ অব ন্যাশনস’ বইটি সেই সাদাকালো স্কেচকে তুলির আঁচড়ে রঙিন করে তোলে। মানুষের হস্তক্ষেপের জায়গা দখল করে বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’, আইনকানুন শিথিল হতে শুরু করে, ক্লাসিক্যাল উদারবাদ শাখা প্রশাখা মেলে, ধীরে ধীরে শুরু হয় পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে বড় বড় পুঁজিপতিরা ব্যাপক পুঁজির মালিক হয়ে থাকেন। তারা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত শ্রম থেকে অতিরিক্ত মুনাফা আয় করেন এবং ধীরে ধীরে আরো ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। কারণ, বাজারকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হলে পুঁজিপতিরা ব্যক্তিগত বিনিয়োগ করতে পারেন সহজে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিন্তু বেশ কার্যকর। তবে কাদের জন্য কার্যকর, সেটা জানা জরুরি।
সম্পদের অসম বণ্টন
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বের গুটিকতক ধনী পুঁজিপতির জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতোই। ২০০০ সালেও পৃথিবীতে বিলিয়ন ডলার অর্থের মালিক ছিলেন কেবল ৩২২ জন। ২০১৫ সালে সে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছিল ১৮২৬ জনে! তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২,৭৫৪-তে! মাত্র ৬৭ জন ব্যক্তি বিশ্বের অর্ধেক সম্পদের মালিক। পুঁজিবাদ যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে ২১০০ সাল আসতে আসতে ১১ জন ‘ট্রিলিয়নেয়ার’ পাবে পৃথিবী! (১ ট্রিলিয়ন মানে এক হাজার বিলিয়ন।)
এই যখন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের সম্পদের পরিমাণ, মুদ্রার অপর পিঠে বাকি অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে অসীম যুদ্ধে মেতে আছে পৃথিবীর সাড়ে সাতশো কোটি মানুষ। ১০০ কোটির অধিক মানুষ প্রতিদিন ২ ডলারের কম অর্থে বেঁচে আছে। এ বৈষম্যই পুঁজিবাদের ফসল। এ বৈষম্যই পৃথিবীর তাবৎ অপরাধ, যুদ্ধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অশান্তির মূল কারণ। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন,
“পুঁজিবাদ সৃষ্ট এ বৈষম্যই সকল সামাজিক ব্যাধির কারণ। বৈষম্যই ক্ষুধা, যুদ্ধ, বিদ্রোহ উসকে দেয়।”
নৈতিকতার অবনমন
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক মাইকেল সান্ডেল তার বই ‘হোয়াট মানি কান্ট বাই: দ্য মোরাল লিমিটস অব মার্কেটস’ বইয়ে দেখিয়েছেন পুঁজিবাদ কীভাবে আমাদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে। একসময় যে সকল খাতকে সেবামূলক খাত ভাবা হতো, সেগুলো এখন পুঁজিবাদের পাল্লায় পড়ে বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে। এখন শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তারক্ষাসহ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, জনপরিবহন, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, সর্বত্র চোখে পড়বে বিভিন্ন বড়-ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সম্বলিত পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড। ছোট ব্যবসা আর ছোট ব্যবসায়ীকে ধ্বংস করতে সদা প্রস্তুত থাকে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো, ঠিক যেভাবে ছোট মাছকে গিলে ফেলে বড় মাছ। বাজার ব্যবস্থা উন্মুক্ত হওয়ায় বড় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো বাজারে পণ্যের দাম, সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে এ পদ্ধতি থেকে কেবল হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ছাড়া ছোট ব্যবসায়ী কিংবা নতুন উদ্যোক্তা আর ক্রেতা কেউই লাভবান হন না।
পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- এটি সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে একসময় যেসকল বস্তু বা সেবা নিছক মানবতাবোধ থেকে হতো, কিংবা নামমাত্র মূল্য প্রদান করা হতো, সেগুলোও এখন উচ্চ মুনাফার আওতাভুক্ত। শিক্ষা, চিকিৎসা, ঔষধ থেকে শুরু করে বৈদেশিক ত্রাণ পর্যন্ত পণ্যে রুপান্তরিত হয়েছে। এই পণ্যায়নের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মিডিয়ার উপরই। মিডিয়া আধেয়গুলো পণ্যায়ন হতে হতে এখন দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় না রেখে স্পন্সরদাতার কথা ভেবে আধেয় নির্মিত হচ্ছে। আর এ প্রক্রিয়ায় স্বয়ং দর্শকরাই পণ্যে পরিণত হচ্ছে যাদেরকে মিডিয়া মালিকগণ বিভিন্ন স্পন্সরদাতার কাছে বিক্রি করেন। সান্ডেলের মতে, নৈতিক বস্তুগুলোর যখন আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তখন সেটি তার মানবিক গুণ হারায়।
সংস্কৃতিতে প্রভাব
পুঁজিবাদের একটি প্রাচীনতম সমালোচনা হচ্ছে এর সংস্কৃতি ধ্বংসাত্মক দিক। এ সমালোচনার প্রথমেই চলে আসবে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত চিরাচরিত জীবনব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটার ব্যাপারটি। পুঁজিবাদী কাঠামোর আওতাভুক্ত হবার পর কোনো সমাজই এর আদি কাঠামো ধরে রাখতে পারে না। তবে, নিতান্ত রক্ষণশীল না হলে আদি কাঠামো অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতি সমর্থনও খুব একটা মিলবে না। তবে সমর্থন না থাকুক, অভিযোগ যে মিথ্যা, তা কিন্তু নয়। পুঁজিবাদী কাঠামো চিরায়ত সমাজ কাঠামোতে প্রথম পরিবর্তন আনে প্রযুক্তি, শিল্পায়ন আর শহরায়নের মাধ্যমে। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রচলিত যোগাযোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হতে বাধ্য। পুরাতন উৎপাদনযন্ত্র নতুন উৎপাদনযন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবার সাথে সাথে সেখানকার পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, শ্রমবিভাজন, অর্থনৈতিক বণ্টন, বিলি-ব্যবস্থা সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। এসব পরিবর্তন ঘরে বাইরে নারী-পুরুষের ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করছে। আর সবকিছু সামষ্টিকভাবে বিবেচনা করলে পুরো স্থানীয় সংস্কৃতিই প্রভাবিত হচ্ছে।
পুঁজিবাদের সমর্থক অনেক পণ্ডিত পুঁজিবাদের এরূপ প্রভাবকে ‘ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন’ বা সৃজনশীল বিনাশ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা, গ্রামের দরিদ্র সমাজের চেহার পুঁজিবাদী কাঠামোর আওতায় এসে বদলে যাচ্ছে তো ইতিবাচক দিকেই যাচ্ছে, যেখানে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই বিনাশ সৃজনশীল হয় না। পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তা চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে নানাবিধ ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ কুটিরশিল্প, হস্তশিল্পকে। পুঁজিবাদী মিডিয়ার সর্বগ্রাসী স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি, বাউল গান, মঞ্চ নাটক, যাত্রা আর পালাগানের মতো ঐতিহ্যগুলো। এগুলোকে নিশ্চয়ই ‘সৃজনশীল বিনাশ’ বলা চলে না।
সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ
পুঁজিবাদের আরেকটি গুরুতর দোষ হচ্ছে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ। শিল্পায়নের সাথে পুঁজিবাদের সম্পর্ক থাকলেও শিল্পায়ন পুঁজিবাদের পূর্বেই ডালপালা মেলেছিল। কিন্তু সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ পুরোপুরি পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বেশ বিস্তৃত একটি ধারণা। এই ধারণা আলোচনা করে- কীভাবে পুঁজিপতি দেশগুলো তাদের স্বীয় সংস্কৃতি, ধ্যান ধারণা আর দৃষ্টিভঙ্গি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভৌগলিক সাম্রাজ্য অস্তিত্বহীন হলেও আধুনিককালে এসে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য ঠিকই অস্তিত্ববান। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন রোর বাংলার আর্টিকেল ‘সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ’।
একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলো সহায়তার নামকরে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নানাবিধ কার্যক্রম চালায়। বিভিন্ন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান কিংবা নানা এনজিও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যারোধে পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন মুখরোচক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এসব প্রচারণায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসছে ঠিকই, তবে লক্ষ লক্ষ নিষ্পাপ প্রাণের বিনিময়ে।
প্রতিবছর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বে লক্ষাধিক মানবশিশুকে গর্ভপাত করিয়ে হত্যা করছে অস্বাক্ষর গ্রামীণ পরিবারগুলো। আর এই হত্যাও লিঙ্গ সংবেদনশীল। তাদের ভাবনা থাকে, ছেলে সন্তান হলে ভালো, অন্যথায় গর্ভপাত করিয়ে পরিবার ছোট রাখা! এর ফলে নারী-পুরুষের অনুপাতে যে অসামঞ্জস্য দেখা দিচ্ছে, নিউ ইয়র্ক টামস সম্প্রতি তার নাম দিয়েছে ‘ডটার ডেফিসিট’। ইকোনমিস্ট একে অভিহিত করেছে ‘জেন্ডারসাইড’ হিসেবে। এখানে বলা দরকার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রচারণা চালানো অবশ্যই প্রয়োজনীয়, কিন্তু তা প্রাণের বিনিময়ে কখনোই নয়। পরিবার পরিকল্পনার প্রচারণার পাশাপাশি তাই গর্ভপাতের ব্যাপারেও সচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব নেয়া উচিত এনজিওগুলোর।
ভোগবাদ
পুঁজিবাদের বড় কুফলগুলোর একটি হচ্ছে ভোগবাদ। বর্তমানে উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে আর কিছু উৎপন্ন করে না। কোনো একটি পণ্য ক্রেতা কিনবেন কি কিনবেন না, তা আর এখন ক্রেতার মর্জির উপর নির্ভরশীল নয়। বরং, উৎপাদনযন্ত্রের মালিকেরা যা বিক্রয় করতে চান, তা-ই ক্রেতার চাহিদায় পরিণত হয়। ক্রেতার চাহিদার সিংহভাগই এখন কৃত্রিম।
বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে একটি তথ্য তুলে ধরা যাক। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন খরচ দাঁড়িয়েছে ৫৮১ বিলিয়ন ডলারে! এবার তাহলে ভাবুন, বিশ্বের বহু দেশের জিডিপির চেয়েও বড় আকারের অর্থ বিজ্ঞাপনের পেছনে নিশ্চয়ই কারণ ছাড়াই ব্যয় করা হচ্ছে না। ক্রেতা ভোগে উৎসাহী না হলেও, কিংবা ক্রেতার চাহিদা না থাকলে বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা আর কৃত্রিম চাকচিক্যের মাধ্যমে ক্রেতাকে ঠিক নিজেদের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ হয়ে উঠছে ভোগবাদী।
পরিবেশ দূষণ
এই ভোগবাদ একটি সামাজিক ব্যাধি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুঁজিবাদী সমাজই ভোগবাদের প্রধান নিয়ামক, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। আর এ দুয়ে মিলে মানবসমাজকে বিশৃঙ্খল করবার পাশাপাশি ধ্বংস করছে পরিবেশও। খুব সহজে যদি আলোচনা করি, একসময় মানুষের তাবৎ উৎপাদনের মূলে ছিল কেবলই ভোগ। তখন সমাজব্যবস্থা ছিল সমমাত্রিক, চাহিদা ছিল সীমিত, উৎপাদন ছিল পরিমিত, ভোগও ছিল কম। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রতিটি উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে পরিণত হয়েছে, তৈরি হয়েছে তাদের অর্থমূল্য। তাই উৎপাদনের সাথে মুনাফার একটি নগদ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ফলে উৎপাদনযন্ত্রের মালিকগণ চাহিদার চেয়ে অধিক পণ্য উৎপাদন করছে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য। আবার উদ্বৃত্ত পণ্য বিকোনোর জন্য তারাই ঝুড়িভর্তি টাকা ঢালছে বিজ্ঞাপনের পেছনে। অতঃপর সমাজ ভোগবাদী হয়ে গেলে বাজারের চাহিদা আপনাআপনি বৃদ্ধি পেতে থাকে। চাহিদার চেয়ে অধিক গতিতে বাড়ে উৎপাদন, এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোগবাদকে আরেক ধাপ উপরে তোলার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। এভাবে পুঁজিবাদ আর ভোগবাদ পরস্পর মিথোজীবীর মতো সমাজে টিকে আছে আর ধ্বংস করছে পরিবেশ। কেননা, উৎপাদন যত বেশি, কাঁচামালের ব্যবহার তত বেশি, পরিবেশ দূষণের পরিমাণটাও হয় অনুরূপ।
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা পুঁজিবাদের মূল সমস্যাগুলোকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করে উপসংহার টানতে পারি।
১. অসমতা
পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হলো অসাম্য। এটি এমন এক ব্যবস্থা, যা ধনীকে অবশ্যম্ভাবীভাবে আরো ধনী আর গরীবকে আরো গরীব করে তুলবে। সম্পদের প্রবাহ এখানে একমুখী হতে বাধ্য। এ ব্যবস্থায় একজন ধনী পুঁজিপতি মৃত্যুকালে তার সম্পদ উত্তরাধিকারীদের কাছে সহজে প্রেরণ করে যেতে পারেন। ফলে শিক্ষাজীবনে একই শ্রেণীতে একই শিক্ষায় সমরূপ শিক্ষিত হওয়া দুজন মানুষ যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, তখন প্রথমজনের হাতে তার পিতার রেখে যাওয়া ১০ কোটি টাকা পুঁজি থাকলেও দ্বিতীয়জনকে শুরু করতে হবে শূন্য থেকে। আর প্রতিযোগিতামূলক এবং সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত বাজার অর্থনীতিতে এরকম অসমতা নিয়ে বাজারে টিকে থাকা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে।
২. অস্থিতিশীলতা
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকাংশেই শেয়ারবাজার, বন্ড, মুদ্রাবাজারের মতো অর্থবাজারের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতার কারণে এ বাজারব্যবস্থা অনেকাংশে অস্থিতিশীল। কেননা, শেয়ার বাজার বা মুদ্রাবাজার যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিম্নমুখী হতে পারে এবং কখনো কখনো বড় রকমের ধ্বসও নামতে দেখা যায়। তখন সে ধ্বসের প্রভাব পড়ে সমগ্র অর্থনীতিতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে যায়, বেড়ে যায় বেকারত্বের হার আর সার্বিকভাবে পড়ে যায় জীবনযাত্রার মান। বিশ্ব এরকম অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছিল ১৯৩০ সালে। এরপরেও আরও বেশকিছু ছোটখাট অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে বিশ্ব।
৩. একচেটিয়াত্ব
পুঁজিবাদে বাজারে পুঁজির অসমতার কথা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। বাজারের সূচনালগ্নে দেখা গেল, বেশ কয়েকজন ছোট পরিসরের উদ্যোক্তার সাথে প্রতিযোগিতায় নামলো উত্তরাধিকারসূত্রে ব্যাপক পুঁজি লাভ করা কোনো এক উদ্যোক্তা। ফলাফল অনুমেয়। বড় পুঁজির উদ্যোক্তার বিপরীতে টিকতে না পেরে দ্রুত বাজার ত্যাগ করবে ছোট পুঁজির উদ্যোক্তারা। ফলে ঐ নির্দিষ্ট পণ্যের বাজারে একচেটিয়াত্ব কায়েম হবে। আর একচেটিয়া বাজার ক্রেতাদের অসহায় করে তোলে। কেননা, একচেটিয়া বাজারের উৎপাদক নিজের মর্জিমাফিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে পারেন। কিন্তু হাতে কোনো বিকল্প না থাকায় ক্রেতারা সে পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য থাকে।
৪. মনোপসনি
মনোপসনি হচ্ছে মনোপলি বা একচেটিয়াত্বের অনুরূপ একটি ধারণা। একচেটিয়া বাজারে একজন বিক্রেতা, একাধিক ক্রেতা থাকে। মনোপসনি বাজারে একজন ক্রেতা, একাধিক বিক্রেতা থাকে। এই ধারণাটি সাধারণত শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কোনো ফার্ম যখন মনোপসনি ক্ষমতা অর্জন করে, তখন সে বাজারের বিভিন্ন নিয়ামক নিজের ইচ্ছায় পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধরুন, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে তিনটি কয়লাখনি আছে। কিন্তু প্রতিটি খনির মালিক একজনই। ফলে ঐ গ্রামের শ্রমবাজারে একজন ব্যক্তি প্রবর্তিত নিয়ম বলবত থাকবে। মালিক যদি চান শ্রমিকের পারিশ্রমিক কমিয়ে দেবেন, তাহলে তিনি তা করতে পারেন, কেননা শ্রমিকদের নিকট আর কোনো পথ খোলা থাকে না। একই কারণে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারেও মালিক মাথা ঘামান না, যখন মনোপসনি ক্ষমতা পান। বাস্তবক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সরকার আমলা নিয়োগ, পুলিশ নিয়োগের মতো ব্যাপারগুলোতে মনোপসনি ক্ষমতার চর্চা করে থাকে।
৫. বেকারত্ব
পুঁজিবাদের একটি প্রধানতম সমস্যা বেকারত্ব। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উৎপাদনযন্ত্রের মালিককে অসীম মুনাফার অনুমতি দেয়। ফলে মালিক যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে তার ফার্ম থেকে শ্রমিক ছাঁটাই করে দিতে পারেন। তাছাড়া প্রযুক্তির উৎকর্ষ তো আছেই। বেকারত্বের জন্য যদিও প্রযুক্তিকে দায়ী করা যৌক্তিক হবে না। তবে প্রযুক্তির উন্নয়ন যেন বেকারত্বের কারণ না হয়, সে দিকটিও ভাবা উচিৎ। কিন্তু সে ভাবনার অবকাশ পুঁজিপতি মালিকদের মেলে না মুনাফার হিসাব নিকাশ করতে করতে।
৬. পরিবেশ দূষণ
পুঁজিবাদী কাঠামোতে সমাজ ভোগবাদী হওয়ায় এবং সমাজের যাবতীয় উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে রূপান্তরিত হওয়ায় মুনাফাই এখানে প্রথম কথা। ফলে মুনাফার্জনের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অধিক উৎপাদন করা হচ্ছে যা মোট প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস করছে, পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, বাধাগ্রস্ত করছে টেকসই উন্নয়নকে।
৭. সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিনাশ
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোই আজকের যুগের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মতো আধুনিক সাম্রাজ্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে। পুঁজিবাদের আগ্রাসনে দুর্বল এবং দরিদ্র দেশগুলোর স্বীয় সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে তাদের সামাজিক ন্যায় ও নীতিবোধ। দুর্ভাগ্যক্রমে এই পরিবর্তনে ইতিবাচকতার চেয়ে নেতিবাচকতাই বেশি।