বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বেড়ে গিয়েছে। ১৯৭৪ সালে মাত্র ৪ ভাগ নারী শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা সর্বশেষ ২০১৬ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে শতকরা ৩৫.৬ ভাগ। নারীদের অংশগ্রহণে এই বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হারের পরিবর্তন সামান্যই। তবে পরিমাণটা বেশি। ১৯৭৪ সালে ৮০.৪% পুরুষ শ্রমশক্তিতে ছিল, যা ২০১৬ সালে ৮১.৯% হয়। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, শহরের তুলনায় গ্রামের নারীদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের অনুপাত বেশি। তবে অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, সেই তুলনায় নারীদের মজুরি বা বেতনের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সমান সময় ও সমান খাটুনির পরও কর্মক্ষেত্রে নারীদের এই বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে পুরুষদের গড় আয় ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা হলেও নারীদের গড় আয় মাত্র ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা।
এর পেছনে যে শুধুমাত্র বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকদের বৈষম্যপূর্ণ আচরণ দায়ী তা নয়। চাকরি নিয়ে নারীদের পছন্দ, পারিবারিক এবং সামাজিক সমস্যাও কাজ করে। এখানে কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলো।
জব ফ্লেক্সিবিলিটি
বিশ্বজুড়ে দেখা যায়, অধিকাংশ নারীই সাধারণত গৃহস্থালির কাজগুলো তথা অবৈতনিক কাজগুলো পুরুষদের তুলনায় বেশি করে থাকে। এসব কাজের চাপে অনেক সময় নারীদেরকে নিজেদের বৈতনিক চাকরির সাথে সমঝোতা করে নিতে হয়। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে ইচ্ছা করেই কম বেতনের চাকরি নেন, যাতে করে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। তাই তারা আয়ের দিক থেকেও এগিয়ে থাকেন নারীদের তুলনায়। অনেক নারীই শিক্ষক, নার্স, সহকারী হিসেবে কাজ করেন বা এমন কোনো চাকরি করেন যেখানে কম সময় থাকা লাগে বা সীমিত কাজ বা দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলশ্রুতিতে, তাদের বেতন যেসকল পুরুষ প্রকৌশলী, সার্জন হিসেবে কিংবা কোনো কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারি হিসেবে কাজ করে তাদের তুলনায় কম হয়ে থাকে।
নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য এবং জব ফ্লেক্সিবিলিটির মধ্যকার এই সম্পর্ক ক্লডিয়া গোল্ডিন তার আর্টকেল ‘এ গ্র্যান্ড জেন্ডার কনভারজেন্স: ইটস লাস্ট চ্যাপ্টার’-এ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করে কয়েকটি মূল ফ্যাক্টর বের করার চেষ্টা করেন, যা এই বৈষম্যের পেছনে মূলত কাজ করে থাকে। এই ফ্যাক্টরগুলো কম-বেশি সব দেশেই খাটানো সম্ভব। সেই দেশ উন্নত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত যা-ই হোক না কেন।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, অনেক নারী প্রায়ই পার্ট টাইম চাকরি করতে চান বা ফুল-টাইম চাকরি হলেও যে চাকরিতে থেকে পরিবারকে বেশি সময় দেওয়া যায় বা পারিবারিক দায়িত্ব বিনা বাধায় পালন করা যায় সেরকম কিছুই তারা বেছে নিচ্ছেন। বাংলাদেশে কর্মরত নারী-পুরুষদের মধ্যে ১০% নারী এবং শুধুমাত্র ৪% পুরুষ পার্ট-টাইম চাকরি করে থাকেন। তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, টেলিকমিউনিকেশন, পরিবহন, ব্যাংকিং এবং ইনসুরেন্স সেক্টরেও নারীদের অবদান পরিলক্ষিত। উচ্চশিক্ষার কারণে চাকরির বাজারে উচ্চপর্যায়েও চাকরি পাচ্ছে নারীরা। তবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে বা উচ্চপর্যায়ের কোনো পদে নারীদের অংশগ্রহণ এখনও সন্তোষজনক নয়।
বিভিন্ন সেক্টরে অংশগ্রহণের তারতম্য
সরকারি একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, আমাদের দেশে একজন পুরুষ যত আয় করে তার শতকরা ৯৪ ভাগ আয় করে একজন নারী। অনুপাতটা দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই, কারণ চাকরির সেক্টর ভেদে এই অনুপাত সমান নয়। আর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মজুরির বৈষম্যের এই ঝামেলা সব ক্ষেত্রেই রয়েছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। তবে সুপারভাইজার পদে নারীদের বেশি দেখা যায় না। ফ্যাক্টরির বড় বড় পদগুলো বেশিরভাগই পুরুষদের হাতেই থাকে। এখন শ্রমিক হিসেবে অনেক নারী যোগদান করলেও গড় মজুরি হিসাব করলে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে যায়।
আমাদের দেশে যেসকল নারী লেবার ফোর্স বা শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্ত, তাদের শতকরা ৮৯ ভাগই ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক সেক্টরগুলো থেকে আয় করে থাকেন। এসব সেক্টরের মধ্যে রয়েছে ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন ব্যবসা ইত্যাদি। এদিক থেকে হিসাব করার কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, তারা আসলেই কত আয় করছে সেই উপাত্ত বের করা বেশ কঠিন। কেননা, বিষয়টি পুরোপুরি ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এসব সেক্টর থেকে প্রাপ্ত আয় সাধারণত অনেক বেশি হয় না। অন্তত আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো ভালো পদে কর্মরত ব্যক্তিদের সাথে তুলনা করলে তা প্রায়শই কম হয়। উচ্চপদে নারীরা যোগদান করলেও সেই অনুপাত পুরুষদের তুলনায় অনেকাংশেই কম হয়ে থাকে। নারীদের মধ্যে মাত্র ৪% উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান ৮.২%। ব্যাপারটা এমন যে, যেসব সেক্টরে বেতন কম সেসব সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণও বেশি। আর যেখানে বেতনের পরিমাণ বেশি, সেসব ক্ষেত্রে নারীদের যোগদানের অনুপাত কম। ফলশ্রুতিতে, গড় হিসাবে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে আসে।
মাদারহুড পেনাল্টি
একজন নারী যখন গর্ভবতী হন, তখন তার মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রয়োজন হয়। চাকরিক্ষেত্রে যথেষ্ট ছুটির অভাব বা পরবর্তীতে সন্তানের দেখাশোনা করার জন্য কেউ না থাকায় বা দিবাযত্নকেন্দ্রের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় নারীদেরকেই চাকরি ছাড়তে হয়। আবার না ছাড়লে যতটা সম্ভব বড়সড় দায়িত্ব নেওয়া থেকে একটু দূরেই থাকেন অনেকে। তা না হলে কাজের চাপে সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালনে ঘাটতি রয়ে যাবে। মাতৃত্বকালীন সময়ে বা এর পরবর্তী সময়ে চাকরিক্ষেত্রে নারীদের যে পেনাল্টি দিতে হয় তা ‘দ্য মাদারহুড পেনাল্টি’ নামে পরিচিত।
আমাদের দেশে বা উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর আরেকটি সমস্যা হলো এসব দেশে শিশুদের জন্য দিবাযত্নকেন্দ্রের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অফিসেও এরকম কোনো ব্যবস্থা থাকে না, যার ফলে সন্তানকে ঘরে একা রেখে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া হয়ে ওঠে না। এতে করে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। যদিও অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মাতৃত্বকালীন ছুটি বেশি, তবে পরবর্তী সময়ে সন্তানের দেখাশোনা করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নারীদের চাকরি ছাড়ার পরিমাণ কমানো সম্ভবপর হচ্ছে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সরকারিভাবে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়ে থাকে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে এই ছুটি মাত্র তিন মাস। চীনে আসলে তিন মাসের একটু বেশি, ১৪ সপ্তাহ। কিন্তু এসব দেশে দিবাযত্নকেন্দ্রের ব্যবস্থাও উন্নত। এজন্য সবসময় নারীদের চাকরি ছাড়ার প্রয়োজন হয় না।
আমাদের দেশে হাতেগোনা এরকম কয়েকটি কেন্দ্র রয়েছে, তবে এগুলোর খরচ যেমন বেশি, তেমনি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয় না। যার কারণে এসব কেন্দ্রে শিশুদের দেখাশোনা কতটুকু ভালো করে করা হয়, কিংবা সন্তানদের জন্য স্থানটি কতটুকু নিরাপদ তা নিয়ে মা-বাবার মনে থেকে যায় হাজারো প্রশ্ন।
নিরাপদ পরিবেশ এবং সুষ্ঠু মানসিকতার অভাব
সমাজে নারীরা এখনও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের বা সমস্যার শিকার হয়ে থাকেন। চাকরিক্ষেত্রে বা পাবলিক পরিবহনগুলোতে প্রায়ই হেনস্তার শিকার হয় নারীরা। এজন্য অনেকেই সন্ধ্যায় ও রাতে অফিসের কাজ করতে চান না এবং অফিস যদি বাসা থেকে দূরে হয় তাহলে যাতায়াতের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে অনেকেই চাকরিটা আর করেন না। অথবা প্রতিকূল পরিবেশের জন্যও চাকরি ছাড়তে হয় কোনো কোনো নারীকে। অনেক সময় নিরাপদ পরিবেশের অভাব চাকরিক্ষেত্রে নারীদের যোগদান কম হওয়ার পেছনে দায়ী থাকে।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় সন্তানের পরিচর্যার দায়িত্ব শুধুমাত্র মায়ের উপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়। কিংবা পারিবারিক সকল দায়িত্ব ও কর্তব্যের দায়ভার শুধুমাত্র নারীদের উপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়। এতে করে সামাজিক ও পারিবারিক চাপে উপায় থাকলেও তা আর কাজে লাগানো যায় না। মা-বাবা দুজনই যদি সমান দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পারিবারিক দায়িত্বগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের সকলেই যদি পালন করেন, তাহলে চাকরিক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে যাওয়া রোধ করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে সরকার দিবাযত্নকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিলে এবং সেগুলো যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখলে কর্মজীবী মায়েরা লাভবান হবে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্র ও পরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে অনেক নারীই কাজে যোগদান করবেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে, বিশেষ করে উচ্চপদগুলোর ক্ষেত্রে বাড়লে এই মজুরি বা বেতন বৈষম্য দূর করা সম্ভব।