আপনি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন? কীভাবে আপনি বিনিয়োগ শুরু করবেন? বিনিয়োগ কৌশল শিখতে হলে এই বিষয়ে কিছু অনুশীলন এবং হাতে-কলমে জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। নিম্নে এ সম্পর্কিত কিছু নির্দেশনা দেওয়া হলো, যা আপনি বিনিয়োগ করার পূর্বে জেনে নিতে পারেন।
আপনার কত বিনিয়োগ করা উচিত?
যদিও এই প্রশ্নের উত্তরটি আপনার ব্যক্তিগত আর্থিক পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্ট, তদুপরি একটি সর্বজনবিদিত নীতি হচ্ছে, পারিবারিক আয়ের ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ আপনার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত, এর বেশি নয়। যদি আপনার উচ্চসুদের অনেক ঋণ থেকে থাকে, তবে ১৫% বা তার বেশি অর্থ বিনিয়োগের পূর্বেই আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন তা পরিশোধ করতে এবং নিশ্চিত করতে যে আপনার জরুরি অবস্থার জন্য যথেষ্ট অর্থ যেন বরাদ্দ থাকে । মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ আর সঞ্চয়ের মাঝে সামঞ্জস্য না থাকলে পরবর্তীতে দৈনন্দিন জীবনে অর্থনৈতিক সমস্যার মুখে পড়তে পারেন ।
পুঁজিবাজারে আপনাকে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন হোক বা কোনো নতুন পণ্য, গাড়ি বা অন্য কোনো জিনিসের জন্য আপনার অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হোক, সকল সময়ই আনুপাতিক হারে বিনিয়োগ করে যাওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। তবে আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায়, মানুষ তার শেষ সম্বলটুকু নিয়ে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে আসেন। অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার থেকে মূলধন তুলে নিয়ে স্বল্প মেয়াদে বেশি লাভের আশায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদী, যা-ই হোক না কেন, কখনোই এভাবে নিজের সর্বস্ব নিয়ে অথবা অন্য কোনো ব্যবসার ক্ষতি করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন না।
বিনিয়োগ শেখার জন্য সময় দিতে হবে
বিনিয়োগের বিষয়ে জানার জন্য পর্যাপ্ত সময় নিন, যদিও প্রথমদিকে বিষয়টি বিরক্তিকর মনে হতে পারে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বলতে কোনো কোম্পানির আংশিক শেয়ার কেনার বিষয় বোঝানো হচ্ছে। কোম্পানিগুলো সম্পর্কে এবং তারা কীভাবে ব্যবসা করে তা সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ। বেঞ্জামিন গ্রাহামের ‘দ্য ইন্টেলিজেন্ট ইনভেস্টর’ বইটি আপনাকে এই বিষয়গুলো সহজভাবে চিন্তা করতে এবং বিনিয়োগের মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে সহায়তা করবে। বইটি আপনারা বাতিঘর কিংবা প্রসিদ্ধ কোনো বইয়ের দোকান থেকে কিনতে পারবেন। অনলাইনে অনেক ওয়েব সাইটে এ জাতীয় বই পাবেন।
বিনিয়োগ একটি দীর্ঘ ভ্রমণের মতো, যেখানে আপনি যত শিখবেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, ততই উন্নতি করতে থাকবেন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ স্বল্পকালীন মুনাফা অর্জনের জন্য নয়। এটি আপনার ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত রাখার একটি উপায় এবং যেটি নিশ্চিত করতে পারে যে অবসর গ্রহণের পরেও যেন আপনি উচ্চমানের জীবনযাপন উপভোগ করতে পারেন। যখন আপনি সময় দেবেন এবং বুঝতে পারবেন যে বিনিয়োগ আপনার ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের সাথে আবদ্ধ, তখন তা আপনাকে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগের জন্য আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে তুলবে। এছাড়া, আপনি কত বিনিয়োগ করতে চান, কতবার করতে চান এবং কোন কোন সেক্টরে বিনিয়োগ করতে চান, তা অনেকটাই নির্ভর করবে আপনার ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতার উপর। মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মানেই ঝুঁকি। নিজের সক্ষমতা এবং জ্ঞান সেই ঝুঁকিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে।
২০ বছর বয়সে আপনার বিনিয়োগের কৌশল স্বাভাবিকভাবেই আপনার ৬০ বছর বয়সের কৌশলের চেয়ে অনেক ভিন্ন হবে, যেখানে আপনার নির্ধারণ করা লক্ষ্যগুলোও ভিন্ন থাকবে। তবে আপনার যদি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য জানা থাকে এবং আপনি আপনার বিনিয়োগকৃত অর্থ দিয়ে কী অর্জন করতে চান তা জানা থাকে, তাহলে আপনার বিনিয়োগ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ অনেক সহজ হয়ে যাবে।
আপনার আবেগ নিয়ন্ত্রণ
প্রায়ই দেখা যায়, ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও নিজস্ব কিছু ধ্যান-ধারণায় এগোতে থাকেন। এক্ষেত্রে আবেগের কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঘোলাটে হয়ে যায়। আপনি যদি পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতা বা তদসম্পর্কিত খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে স্টক কেনাবেচার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে হয়তো আপনার প্রত্যাশার চেয়ে অধিক অর্থ হারাতে হতে পারে। আপনি যদি পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতা বা এ ধরনের যেকোনো সংবাদে নিজেকে শান্ত রেখে আবেগকে নিয়ন্ত্রত করতে পারেন, তবে তা আপনার পুঁজি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আপনার বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা
আপনি সম্পূর্ণরূপে আপনার নিজের বিনিয়োগ নিজেই পরিচালনা করতে পারেন। যদিও, একজন অর্থ উপদেষ্টা আপনাকে ভাল পরিমাণ মুনাফা অর্জন এবং বিনিয়োগের লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে, প্রথমেই তার সাথে কথা বলে তাকে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে যেন তিনি সময় নিয়ে আপনার বিনিয়োগের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যগুলোর ব্যাপারে ভালোভাবে শোনেন, আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেন, আপনাকে সব বিকল্প পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং যখন আপনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন তখন সব ধরনের সহায়তা করেন।
বিনিয়োগের জন্য একজন পেশাদার উপদেষ্টা নির্বাচন করার সময় কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে, যেমন- উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পদ্ধতি, বাজার পর্যবেক্ষণে তাদের বিগত দিনের সাফল্য এবং আপনি যে বিনিয়োগ করেছেন তার ফলাফল জানার পদ্ধতি। আপনার অর্জিত বিনিয়োগ কৌশলের শিক্ষা, আপনার বিনিয়োগের সক্ষমতা ইত্যাদি পেশাদার উপদেষ্টার কৌশলের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটা বিবেচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ ও ফলাফল
সময়ের সাথে সাথে বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি আপনার দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় যদি ২০১৬ সাল থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকেন, তাহলে আপনি ভালো মুনাফা লাভ করেছেন, যেহেতু বাজারের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। এমনকি বর্তমানে ২০১৮-তে বাজারের পতনে আপনি এখনো তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছেন। সব বাজারেই উত্থান-পতন রয়েছে। বাজারে পতন ঘটার মানে এই নয় যে আপনি আপনার সব অর্থ তুলে নিয়ে আসবেন। বরং মনে রাখতে হবে, বাজার পতন নতুন একটি বিনিয়োগের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে আপনার জন্য।
পুঁজিবাজারে যে সবসময় উর্ধ্বগতি থাকবে এমনটাও নয়, প্রতি বছরই কিছু দিন এবং মাস থাকে যখন সর্বোচ্চ লেনদেন হয়ে থাকে এবং বাজার যখন ঘুরে দাঁড়ায় এই দিনগুলোতেই সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারীগণ সাধারণত এই দিন এবং মাসগুলো পেয়ে থাকেন। স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগকারীগণ দেখা যায় পুরোটি বছর এই দিন এবং মাসগুলোকে খুঁজে বেড়ান এবং অনেক ক্ষেত্রেই ধৈর্যের অভাবে পুঁজি হারিয়ে ফেলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাজারে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হলে তবেই টিকে থাকা সম্ভব এবং সময়ের সাথে সাথে অধিক অর্থ মুনাফা করা সম্ভব।
প্রথমদিকে বিনিয়োগ করার সময় কিছুটা ভীতি কাজ করতে পারে। তবে একজন নতুন বিনিয়োগকারী হিসেবে পুঁজিবাজার থেকে আপনি কী কী প্রত্যাশা করতে পারেন সেই বিষয়গুলো আপনার জানা থাকলে তা আপনার বিনিয়োগে সহায়ক হবে। সর্বোপরি, বিনিয়োগের কৌশল শিখতে হবে, যথাযথভাবে সেগুলো অনুশীলন করতে হবে এবং নিজেকে একজন দক্ষ বিনিয়োগকারী হিসেবে তৈরি করতে যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিতে হবে।