শিল্প বিপ্লব যেভাবে বদলে দিয়েছিল অর্থনীতিকে

জন উইলকিনসন ছিলেন লোহা উৎপাদনকারী একটি ছোট্ট কারখানার মালিকের ছেলে। লোহা শিল্পের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বার বার প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র তৈরি করেছেন জন উইলকিনসন, যার মধ্যে ডজনখানেক দেখেছিল সাফল্যের মুখ। নিজের লোহা ফ্যাক্টরিতে উইলকিনসন ঢালাই মেশিন তৈরি করেছিলেন, লোহার পাইপের আদলে তৈরি করেছিলেন সিলেন্ডার।

পুরো জীবনজুড়ে তিনি একটিই স্বপ্নকে অনুসরণ করেছেন, সবকিছু তৈরি হতে হবে লোহা দিয়ে। এই স্বপ্নকে অনুসরণ করে তিনি লোহার ব্রিজ বানানোর পথ তৈরি করেন, তৈরি করে ফেলেন লোহার জাহাজও। তার তৈরি প্রথম লোহার জাহাজ পানিতে ভাসার পর তার বন্ধুকে উইলকিনসন লিখেছিলেন, “জাহাজ পানিতে ভাসা আমার সকল প্রত্যাশার উত্তর দেয়, আর উত্তর দেয় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার ধারণার প্রতি অবিশ্বাসীদের, যারা এক হাজার জনের মধ্যে নয় শত নিরানব্বই জন।”

প্রথম দিকে লোহার তৈরি জাহাজ; Image Source: Quora

জন উইলকিনসন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে তরান্বিত করার পথে একাই ছিলেন না, বাষ্প ইঞ্জিনের উৎকর্ষ সাধন করে ব্যবহার উপযোগী করার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন জেমস ওয়াট। শিল্প বিপ্লবের দ্রুত গতি ইংল্যান্ডের সামাজিক কাঠামোকে বদলে দেয়, বদলে দেয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি। শিল্প বিপ্লবের পটভূমি।

শিল্প বিপ্লব শব্দটি প্রথমবারের মতো ১৮৩৭ সালে ব্যবহার করেন জেরোমি ব্লাংকি, যিনি ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক বলয়ের একজন লেখক। শিল্প বিপ্লব শব্দটি বিশেষ পরিচিত লাভ করে আরো প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে, ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবির বক্তব্যের মাধ্যমে।

ইংল্যান্ডে যে সময়টাতে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়, সে রেনেসাঁর প্রভাবে শিক্ষিত একটি শ্রেণি তৈরি হচ্ছিল। রেনেসাঁর সময়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে আইজ্যাক নিউটনের মতো বিজ্ঞানীর, জন লক, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, থমাস হবস, পোপের মতো ফিলোসফারদের। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়টাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব কমে, যা বিকশিত করে শিল্প বিপ্লবের পথ।

একইসাথে সেই সময়ে ইংল্যান্ডের প্রভূত সম্পদ বৃদ্ধি ঘটে, ইংল্যান্ডের উপনিবেশ বিস্তৃত হয় আফ্রিকা আর এশিয়াজুড়ে। ইংল্যান্ডে তৈরি হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বড় একটি শ্রেণির বাড়ে ক্রয়ক্ষমতা। এই অর্থনৈতিক শ্রেণির পণ্যের চাহিদা শিল্প বিপ্লবকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।

শিল্প বিপ্লব; Image Source: History.com

 

শিল্প বিপ্লবের ফলাফল: বদলে যাওয়া অর্থনৈতিক কাঠামো

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে প্রধানতম একটি শিল্প ছিল কটন শিল্প, যেটিতে তাঁতিরা কাজ করতেন সুতা উৎপাদন থেকে শুরু করে বস্ত্র উৎপাদন পর্যন্ত। একটি দীর্ঘ সময় ধরে তাঁতিরাই কাঁচামাল সংগ্রহ করে বস্ত্র উৎপাদন করতো। পরবর্তীতে সেটি বিক্রি করতো বিভিন্ন বাজারে। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে একটি ব্যবসায়ী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যারা তাঁতিদের কাছ থেকে বস্ত্র কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করতো। ফলে, তাঁতিদের স্বাধীনতা অনেকটাই সমর্পিত হয় ব্যবসায়ীদের কাছে।

একসময় ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁতিদের কাছ থেকে বস্ত্র সংগ্রহের পরিবর্তে অনেক তাঁতিকে একসাথে করে বস্ত্র উৎপাদন করতে শুরু করেন। এতে ব্যবসায়ীদের মুনাফা হচ্ছিল বেশি। তাঁতিদেরকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ ছিল, কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি হতে হয় কম প্রতিযোগিতার। এখান থেকেই ফ্যাক্টরির ধারণা বিকাশ ঘটে, যেটি শিল্প বিপ্লবের সময়ে ব্যাপক এবং বিস্তৃত রূপ ধারণ করে। ইংল্যান্ডের পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশ, যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়, যার প্রভাব ছড়িয়ে যায় বিশ্বজুড়ে।

শিল্প বিপ্লবে সবার আগে পরিবর্তন আসে বস্ত্র শিল্পে; Image Source: Britannica

শিল্প বিপ্লবের ফলে সামাজিক পরিবর্তন এসেছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল ঘটেছে, অধিকাংশ দেশেই পরিবর্তন আসে আর্থ-সামাজিক কাঠামোর। তবে, শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি আসে অর্থনৈতিক কাঠামোতে।

অর্থনীতির ভরকেন্দ্র পরিবর্তন

একটা দীর্ঘ সময় ধরে মানবসভ্যতার অর্থনীতি ছিল কৃষিকেন্দ্রিক। কৃষকেরাই ছিলেন বাজারের ভরকেন্দ্র, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের উপর ভিত্তি করে বাজারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বাজারের কীসের চাহিদা রয়েছে, সেটির প্রভাব ছিল গৌণ। স্থানীয় পরিবেশ আর প্রাকৃতিক কাঠামোকে সামনে রেখে কৃষকেরা বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করতেন, মোটা দাগে সেগুলো বিক্রি হতো স্থানীয় বাজারেই। চাহিদাকে বিচার করে বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা হয়তো স্থানীয় বাজারগুলো থেকে পণ্য কিনে নিতেন বিভিন্ন সময়ে, বাজারের মূল কাঠামোর সাথে এই সম্পর্ক সবসময়ই ছিল পরোক্ষ।

শিল্প বিপ্লবের ফলে এই বাস্তবতায় পরিবর্তন আসে। অর্থনীতির মূল ভরকেন্দ্র কৃষিজমি থেকে চলে যায় ফ্যাক্টরিতে, বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে ভোক্তাদের চাহিদার তথ্য। বাজারের চাহিদাকে সামনে রেখে উৎপাদককে পণ্য উৎপাদন করার সংস্কৃতি শুরু হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে এসে উপনিবেশ স্থাপন করে। শুরুতে তাদের চাহিদা ছিল, কর আদায়ের কাঠামো সংস্কার করে অধিক কর আদায় করা। কিন্তু, ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে রংয়ের চাহিদা তৈরি হয়, যেই চাহিদাকে সামনে রেখে ভারতীয় উপমহাদেশে শুরু হয় বাধ্যতামূলক নীল চাষ

বাজারকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উৎপাদন; Image Source: downtoearth.co.org

আবার, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ফুল ফুটে শীতকালে, যেই ঋতু মধ্য ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু, ফুলের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে বসন্ত ঋতুতে। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী অর্থনৈতিক কাঠামোতে এখন বসন্তকে সামনে রেখেই ফুলের উৎপাদন করেন উৎপাদকেরা।

জনমিতির পরিবর্তন

একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অধিকাংশ পলিটির বেশিরভাগ মানুষ বসবাস করেছে গ্রামে, গ্রাম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হওয়ায়। শিল্প বিপ্লবের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে উঠে শহরকেন্দ্রিক, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম চতুর্থাংশেই মোট দেশজ উৎপাদনে শিল্পের অবদান বৃদ্ধি পায় প্রায় ১৫ শতাংশ, একইভাবে কমে কৃষিখাতের অবদান। ফলে, কাজের খোঁজে মানুষ পাড়ি জমাতে থাকে শহরের দিকে। ১৮০১ সালে যেখানে শিল্প মোট কর্মসংস্থানের ৩০ শতাংশ তৈরি করতো, ১৮১৫ সালের সেটি ৪৩ শতাংশে উন্নিত হয়।

আবার, একই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে সাথে বাড়তে থাকে মোট জনসংখ্যাও। ১৭৫১ যেখানে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা ছিল ৬.১ মিলিয়ন, ১৮৩১ সালে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা হয়ে যায় ১৪.২ মিলিয়নে। অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার সাথে সাথে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে শুরু করে, ফলে মানুষ অধিক সন্তান নিতে আগ্রহী হয়। পাশাপাশি, জীবনযাপনের মান বৃদ্ধির ফলে বাড়ে প্রত্যাশিত গড় আয়ু, যেটি স্বাভাবিকভাবেই বাঁড়ায় মোট জনসংখ্যাকে।

মানুষের কর্মদক্ষতার বৃদ্ধি

শিল্প বিপ্লবের ফলে পুঁজির বিকাশ ঘটে, পুঁজি ব্যবহার করে পুঁজিপতিরা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, টুল আর উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে কারখানা তৈরি করে। মানুষের শারীরিক সক্ষমতার চেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মানসিক দক্ষতার বিষয়টি, কোনো জিনিসকে দ্রুত আয়ত্ব করতে পারার ক্ষমতা এগিয়ে দেয় অনেককে। একই জিনিস বারবার করা আর যন্ত্রপাতির ব্যবহার মানুষকে অতিমানবীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়।

শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের কর্মদক্ষতায় বৃদ্ধি ঘটে; Image Source: History Crunch

যেমন, শিল্প বিপ্লবের পূর্বে হয়তো পাঁচজন তাঁতি তিন দিনে একটি শাড়ি তৈরি করতে পারতেন। শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে একজন শ্রমিকই একদিনে হয়তো দশটি শাড়ি উৎপাদন করতে পারছেন।

মানুষের সঞ্চয়ের ধারণা

সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ ততোটুকুই পরিশ্রম করেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, যতোটুকু তার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয়। শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে মানুষ একটি কর্মদক্ষতার ট্র্যাপের মধ্যে ঢুঁকে যেতে শুরু করে, মানুষের চাহিদা হওয়া শুরু করে অফুরন্ত। ফলে, অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য শুরু হয় মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা।

শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় সঞ্চয়ের ধারণা; Image Source: The Wall Street Journal

অধিক উপার্জিত অর্থ থেকে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের ধারণা তৈরি হয়। অর্থ সঞ্চয় বলতে এমন একতি প্রক্রিয়া বোঝায়, যেই প্রক্রিয়াতে মানুষ অর্থকে অর্থনৈতিক কাঠামোর বাইরে নিয়ে এসে বিচ্ছিন্ন স্থানে সংরক্ষণ করে, যেই অর্থ দিয়ে তার সেবা গ্রহণ বা পণ্য ক্রয়ের কথা ছিল, সেটি না করে অর্থকে বসিয়ে রাখছেন।

বিনিয়োগের ধারণা

সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের ধারণা গভীরভাবে সংযুক্ত। সঞ্চয়ের মাধ্যমে মানুষ অর্থ অর্থনৈতিক কাঠামোগুলো থেকে বাইরে নিয়ে যায়, বিনিয়োগের মাধ্যমে মানুষ সেই অর্থকে পুনরায় মূলধারায় ফিরিয়ে আনে। বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন ঘরানার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, বৃদ্ধি পায় মোট দেশজ উৎপাদনের পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ও। শিল্প বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে বিনিয়োগের সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত, বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও ছিল সীমিত।

This article is written in Bangla, explaining how the industrial revolution changed the economic structure. 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Feature Image: Encyclopedia Britannica. 

Related Articles

Exit mobile version