“নব্য উদারবাদের প্রকৃত অভিসন্ধিই গণতন্ত্রের বিনাশ!”- নোম চমস্কি
আমাদের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো কীভাবে চলছে, কখনো ভেবেছেন? বর্তমানে প্রায় পুরো পৃথিবী একই অর্থনৈতিক মডেলে চলছে, তা কি খেয়াল করেছেন? কখনো ভেবে দেখেছেন, ধনী-গরীবের ব্যবধান ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণটা কী? কিংবা বিশ্ব অর্থনীতি কোনসব নিয়ম-কানুনের উপর ভিত্তি করে চলছে, যেখানে সম্পদের ধারা কেবল গুটিকয়েক মানুষের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, এ ভাবনার অবকাশ হয়েছে কি? ‘নব্যউদারবাদ’ শব্দটার সাথে পরিচয় আছে কি? না থাকলেও সমস্যা নেই। আজকের আলোচনা নব্যউদারবাদ নিয়েই।
নব্যউদারবাদ এক অদৃশ্য বস্তুর নাম, যার মাঝে ডুবে আছে পুরো পৃথিবীটাই। সর্বত্রই আছে এর অস্পৃশ্য উপস্থিতি, অথচ সাধারণ অর্থে তা টের পাওয়া দুরূহ। একবিংশ শতকের শুরু থেকেই দ্রুতগতিতে বিলিয়নিয়ারের পরিমাণ বাড়তে থাকা, ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা, দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে ব্যাপক পরিমাণ সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া (যার খণ্ডিত চিত্র আমরা দেখেছিলাম পানামা পেপার ঘটনায়), জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার মানের ধীরে ধীরে অবনমন, বিশ্বজুড়ে দরিদ্রতা বৃদ্ধি, শরণার্থী সমস্যা, সুখসূচকের অবনমন, বিষণ্ণতার মহামারী, পরিবেশ বিপর্যয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ভাঁড়ের উত্থান, এই সবকিছুর পেছনেই এক অদৃশ্য হাতের অবদান রয়েছে। সে হাত নব্যউদারবাদের।
নব্যউদারবাদ এখন এতটাই ব্যপ্তিশীল, এর উপস্থিতি এখন এমনই প্রবল যে আমরা ভুলেই যেতে বসেছি এটি হঠাৎ করে বিশ্বে স্থাপিত করা হয়েছিল ১% এর স্বার্থ উদ্ধারে। আমরা এর সংক্ষিপ্ত উত্থানের ইতিহাস ভুলে গিয়ে যেন ভাবতে শুরু করেছি, এটি তো হবারই ছিল। ঠিক যেমন ডারউইনের বিবর্তনবাদ বলে বনমানুষ বিবর্তিত হয়ে মানুষ এসেছে। নব্য উদারবাদের ক্ষেত্রেও সেরকম ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে যে, এটি সময়ের আবর্তেই আজকের রূপ পেয়েছে। অথচ রাষ্ট্র আর সমাজের কত কল্যাণমুখী প্রথা-প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিকায়ন করেছে নব্যউদারবাদ, মানুষের সম্পর্ক নির্ধারণ করেছে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে, রাষ্ট্রের নাগরিককে পরিণত করেছে ‘ভোক্তা’য়, সবকিছুর মূলে স্থাপন করেছে বাজারকে, মানুষের গণতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চাকে করেছে কেনাবেচাকেন্দ্রিক! এসব ব্যাপার কালের বিবর্তনে হয়েছে? নব্যউদারবাদ জানার পর সে কথা ভুলেও আর মাথায় আসবে না।
নব্যউদারবাদ মুক্তবাজারের কথা বলে, সকলের সমান অধিকার নিয়ে প্রতিযোগিতার কথা বলে, ভালোই তো শোনাচ্ছে, তা-ই নয় কি? কথায় আছে বইয়ের মলাট দেখে বই বিচার করতে নেই। নব্যউদারবাদ বাজার স্বাধীনতার কথা বলে এমন এক ব্যবস্থার সৃষ্টি করে যেখানে, দুর্বলদের সাহায্য দিয়ে এগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়, যেখানে সকল প্রকার কর কমিয়ে আনতে হয়, জনসেবামূলক খাতগুলোকে বেসরকারিকরণ করা হয়, যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমজীবীদের সংগঠনগুলোকে দেখা হয় ‘বাজার অর্থনীতির শত্রু’ হিসেবে, ধনীর যাবতীয় সম্পদ, সুবিধাদি স্বাভাবিক আর গরীবের অবস্থার জন্য তার ভাগ্য, তার ‘অযোগ্যতা’কে দায়ী করা হয়!
ধরতে পারছেন না? চলুন ধরিয়ে দিচ্ছি। প্রথমে বাজার স্বাধীনতায় আসা যাক। নব্যউদারবাদ এমন এক বাজারের কথা বলে, যে বাজারে কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না, থাকবে না কোনো সরকারি আইন। বাজার চলবে বাজারের মতো, সকলেরই সে বাজারে মুক্ত প্রবেশাধিকার থাকবে। এবার কল্পনা করুন, বাংলাদেশে কোনো একটি নতুন পণ্যের বাজার খোলা হলো। সে বাজারে বাংলাদেশী অনেক ছোটখাটো উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করলো, অংশ নিলো পাশের দেশ ভারতের বিলিয়নিয়ার কয়েকজন ব্যবসায়ীও। এখন বাজারে যদি সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকে, তাহলে ভারতীয় বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীদের সামনে বাংলাদেশী ছোট পরিসরের উদ্যোক্তারা টিকতেই পারবে না। কারণ, বিলিয়নিয়াররা তাদের বিপুল পুঁজির কল্যাণে অধিক মানসম্পন্ন পণ্য অল্প খরচেই উৎপাদন করতে পারবে, পণ্য অধিক বিকোনোর জন্য দেবে নানা ধরনের অফার। এমন অবস্থায় ছোট ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকার বিদেশী ধনী ব্যবসায়ীদের পণ্যে অধিক করারোপ করে যেন সে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় এবং ক্রেতারা দেশীয় পণ্যের দিকে ঝোঁকে। অথচ, নব্যউদারবাদ সরকারের হস্তক্ষেপের সে সুযোগটাই রাখছে না। ফলে অচিরেই ছোট ব্যবসায়ীদের পাততাড়ি গুটিয়ে বাজার ছেড়ে দিতে হয়!
এরকম আরো অনেক সমস্যাই নব্য উদারবাদের সৃষ্টি। এ ব্যবস্থায় জাকারবার্গের অঢেল সম্পত্তির জন্য তার মেধার প্রশংসা করা হয়, আর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে আত্মহত্যা করা মানুষটির ব্যর্থতার জন্য তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। অথচ, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলো পর্যাপ্ত শিক্ষা, পরিচর্যা, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ পেলে তাদের অবস্থার কি পরিবর্তন হতো না? জাকারবার্গের একটি আইডিয়া কত শত মানুষের মেধার উপর ভিত্তি করে আজকের রূপ নিয়েছে, তার হিসাব নেই, তাহলে সম্পদ কেন শুধু তার হাতে পুঞ্জীভূত হবে- সে প্রশ্ন যৌক্তিক নয় কি? কিংবা, জন্ম থেকে পৃথিবীর তাবৎ নির্মম চেহারা দেখতে দেখতে বড় হওয়া মানুষটির দারিদ্র্যের জন্য তার ‘অযোগ্যতা’কে দোষ দেয়া কতটা অমানবিক, তা ভাবা উচিত নয় কি?
কাঠামোগত সমস্যাকে চিহ্নিত না করে বেকারত্বের জন্য বেকার তরুণদের উপর অযোগ্যতার দায় চাপায় নব্যউদারবাদ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, বাড়িভাড়া, পরিবহন ভাড়া সবকিছুর বৃদ্ধি আর বেতন স্থির থাকার পর যখন মধ্যবিত্ত সমাজ সঞ্চয় করতে ব্যর্থ হয়, নব্যউদারবাদ বলে- এটি তাদের অপরিণামদর্শিতার ফল। “মানুষ মানুষের জন্য” ভুলে গিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলো এখন পিছিয়ে পড়াদের সাহায্য করতে হাত না বাড়িয়ে বরং অসীম প্রতিযোগিতার এ সমাজে নিজেকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে চিন্তায় মত্ত থাকে। আর পিছিয়ে পড়া সে মানুষগুলো যখন হতাশ হয়ে পড়ে, বিষণ্ণতায় ভোগে, কেউ কেউ আত্মহত্যা করে, নব্যউদারবাদ তাদের জন্য একটিই শব্দ খরচ করে, ‘লুজার’! পল ভারহেগ তার বই ‘হোয়াট অ্যাবাউট মি’ তে লিখেছিলেন, বিষণ্ণতা, একাকিত্ব, উদ্বেগ, হতাশাসহ নানাবিধ মানসিক ব্যাধিও নব্যউদারবাদের ফসল। তার কথার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো আজকের ব্রিটেন। নব্যউদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ ব্রিটেনকে এখন বলা হয় ‘ইউরোপের একাকিত্বের রাজধানী’!
১৮৯৮ সালে একজন ইতালিয়ান অর্থনীতিবিদ ইতালির অর্থনৈতিক অবস্থাকে বোঝাতে প্রথম নব্যউদারবাদ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তবে তিনি এ শব্দটির বিশেষ কোনো সংজ্ঞায়ন বা গুরুত্বারোপ করেননি। নব্যউদারবাদ মূলত একটি অর্থনৈতিক ভাবধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৩৮ সালে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘ওয়াল্টার লিপম্যান কনফারেন্সে’ লুডভিগ মাইজেজ এবং ফ্রেডরিখ হায়েকের বক্তৃতায় নব্যউদারবাদ প্রথম এর আনুষ্ঠানিক আকৃতি পায়। তারা সে সম্মেলনে ব্রিটেনে রুজভেল্টের হাত ধরে ‘সামাজিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণ রাষ্ট্রমুখী চিন্তাভাবনাকে নাম দেন ‘কালেক্টিভিজম’ বা সংহতিবাদ, যার সাথে হিটলারের নাৎসি জার্মানির সামঞ্জস্য দেখানো হয়!
এরপর ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয় হায়েকের বই ‘দ্য রোড টু সার্ফডম’, যেখানে দাবি করা হয় যে প্রচলিত ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং রাষ্ট্রকে সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। হায়েকের এ দাবি ছিল নব্যউদারবাদের জন্য বড় ধরনের অগ্রগতি। ব্রিটেন আর আমেরিকার ধনিক শ্রেণী লক্ষ্য করলেন, হায়েকের ব্যবস্থার সমর্থন তাদেরকে কর ও অন্যান্য সরকারি সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পারে! বুঝতেই পারছেন, এ ভাবাদর্শের সমর্থকগোষ্ঠী কারা। প্রথম যে প্রতিষ্ঠানটি নব্যউদারবাদ প্রত্যক্ষভাবে প্রচার শুরু করে, সেটির নাম ‘মন্ট পেলেরিন সোসাইটি’। সংগঠনটি সমাজের সর্বোচ্চ ধনীদের অর্থায়নে চলতো!
এই মন্ট পেলেরিন সোসাইটির হাত ধরে একপ্রকার ভাবাদর্শগত আন্দোলন গড়ে উঠতে লাগলো, যার মূল লক্ষ্য ছিল নব্যউদারবাদের বিস্তৃতি। প্রথমে এটি বিশ্বব্যাপী নব্যউদারবাদের সমর্থকগোষ্ঠীকে সংযুক্ত করলো, যাদের মাঝে বড় বড় ব্যবসায়ী ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর নামকরা সাংবাদিকেরা ছিলেন। এর পরের ধাপটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নব্য উদারবাদের বিস্তৃতির জন্য যুগান্তকারী। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, কাটো ইনস্টিটিউট, সেন্টার ফর পলিসি ইনস্টিটিউটের মতো আরো বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করলো এই সংগঠন, যেন নতুন সৃষ্ট এ অর্থনৈতিক ধারা নিয়ে আরো গবেষণার মাধ্যমে একে উন্নত করা হয়।
তবে এতকিছুর পরও নব্য উদারবাদ সিংহভাগের নিকট ব্রাত্য হয়েই ছিল। বিশেষ করে জন মেনার্ড কেইনসের অর্থনৈতিক ভাবাদর্শের কাছেই কোণঠাসা হয়ে ছিল এই নতুন মতবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপের যুদ্ধপীড়িত দেশগুলোর পাশাপাশি আমেরিকাও অর্থনৈতিক মুক্তির সমাধান খুঁজে পেল কেনেসিয়ান অর্থনীতিতে। কিন্তু নব্যউদারবাদের জন্য এ সময়টাও ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে না পেলেও এ সময় ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে নব্য উদারবাদ, তৈরি হয় এর একটি শক্ত সমর্থকগোষ্ঠী।
ওঁত পেতে থাকা শিকারীর মতোই নব্যউদারবাদও অপেক্ষায় ছিল সঠিক সময়ের। সে সময়টা চলে আসে সত্তরের দশকে, যখন কেনেসিয়ান অর্থনীতির খোলস বেরিয়ে পড়ে, দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। তখন সে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি পরিপূর্ণ বিকল্প প্যাকেজ হিসেবে প্রস্তুত হয়েই ছিল নব্যউদারবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের জিমি কার্টার সরকার প্রথমবারের মতো সে প্যাকেজে হাত দেন। পুরো নব্যউদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো গ্রহণ না করলেও তিনি এই প্যাকেজের বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করেন, যেগুলো সফল হয়। কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পায় নব্যউদারনীতিবাদ।
এরপর আসে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা। ১৯৭৩ সালে সিআইএ’র প্রত্যক্ষ সহায়তায় চিলির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করে গদিনসীন হন স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে কুখ্যাত জেনারেল পিনোশে। আমেরিকার অভিপ্রায় ছিল, পিনোশের মাধ্যমে সেখানে নব্যউদারবাদের বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা চালানো। হলোও তা-ই। ক্ষমতায় বসেই রাতারাতি চিলির অর্থনৈতিক কাঠামো আমূল পাল্টে দিলেন পিনোশে। পিনোশের আগ্রাসী ক্ষমতা গ্রহণে ইতোমধ্যে স্তম্ভিত আর ভীত হয়ে পড়েছিল দেশের মানুষ। এমতাবস্থায় বাজার ব্যবস্থায় হঠাৎ নব্যউদারবাদের আগমনে সর্বসাধারণের মাঝে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। কোনো দেশের চূড়ান্ত সংকটের মুখে, যখন মানুষের সকল মনোযোগ সেই সংকটের দিকে থাকে, তখন নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো বসিয়ে দেয়াকে নাওমি ক্লেইন ‘শক ডকট্রিন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শক ডকট্রিন প্রয়োগের মাধ্যমে চিলি হয়েছিল নব্যউদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণ রূপে গ্রহণ করা প্রথম দেশ। দেখা গেলো, চিলিতে এ অর্থনৈতিক কাঠামো সফল হচ্ছে। এটি বাজারে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করছে। কিন্তু কাদের স্বাধীনতা? রাঘব বোয়ালদের অবশ্যই! এরপর ৮০’র দশকে ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার এবং আমেরিকায় রোনাল্ড রিগ্যান ক্ষমতায় গিয়ে স্ব স্ব দেশকে পরিপূর্ণ নব্যউদারবাদী করে তোলার ঘোষণা দেন। এ দুই দেশে তখন শুরু হলো ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার, ব্যাপক হারে কমে গেল কর, বাজার ব্যবস্থায় সরকারি আইনকানুন শিথিল হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিলুপ্ত হলো, সকল প্রকার জনসেবামূলক কাজ বেসরকারিকরণ করা হলো।
আর আমেরিকা যে পথে যায়, সে পথে তারা সকলকেই নিয়ে যায়। আমেরিকা আর ব্রিটেনে নব্যউদারবাদ জেঁকে বসার পর বিশ্বব্যাপী শুরু হলো আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা, যারা দরিদ্র আর উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও নব্যউদারবাদের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য কাজ শুরু করে। ‘মাসট্রিশট ট্রিটি’র মাধ্যমে ইউরোপেও ছোঁয়া লাগলো নয়া এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। সবশেষ ৯০’র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অর্থনৈতিক কাঠামো হিসেবে আবির্ভূত হলো নব্যউদারবাদ নামে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা বাজার অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনে, বেসরকারিকরণ, অপ্রতিবিধান, সরকারি ভর্তুকি হ্রাস, কর ব্যবস্থার সংস্কার ও সংকোচন, মুক্তবাজার, অবাধ ব্যক্তিমালিকানার অধিকার সহ নানাবিধ একমুখী অর্থনৈতিক সংস্কারের সমর্থন করে।
তারপর থেকে বিশ্বব্যাপী দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চললো নব্যউদারবাদী নাটক, যে নাটকে কেবল এক শ্রেণীই সফল থেকে সফলতর হতে থাকলো। সর্বগ্রাসী এক স্বাধীনতার নাম করে দেশে দেশে বাজারগুলো দখল করতে থাকলো গুটিকয়েক বিত্তশালী দেশের বড় বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে দেশীয়ভাবে নয়া এই নীতির প্রয়োগ সুবিধাজনক হচ্ছিল না, সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে নানাবিধ অর্থনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করা হলো, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আদালত তৈরি হলো, যেগুলো দ্বারা দেশীয় কাঠামোকে চেপে ধরা যায়। দেশীয় সংসদ যখন বহিরাগত পণ্যের উপর করারোপ করতে চাইলো, জ্বালানির মূল্য সহনীয় মাত্রায় রাখতে বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আইন প্রয়োগ করতে চাইলো, দেশীয় খনিজ সম্পদ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলো, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বহুজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে সংসদকে হার মানালো।
পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, রেলের মতো সরকারি জনসেবামূলক খাতগুলোকে বেসরকারিকরণ করে সেগুলোতে বৈশ্বিক পুঁজিপতিদের টোল ওঠানোর সুযোগ করে দিয়েছে নব্যউদারবাদ। এই টোল শুধু জনগণই দিচ্ছে না, সরকারও দিচ্ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ফলে একটি দেশের সামগ্রিক সম্পদ ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। সরকারকে একটি বড় প্রজেক্টের কাজ করে দিয়ে বছরের পর বছর বিভিন্ন শর্তে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানিগুলো। ফলে রেলের মতো পরিবহন খাত আর তেল-গ্যাসে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হয় সরকারকে।
নব্যউদারবাদী ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হলো একচেটিয়াত্ব। ছোট-বড়, দেশী-বিদেশী, সকলের জন্য সমশর্তের বাজার ব্যবস্থায় সহজেই সকল প্রতিযোগীকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় বিদেশী বিত্তবান প্রতিযোগী এবং বাজারে কায়েম করে একচেটিয়াত্ব। আর এরূপ একচেটিয়াত্ব বৈশ্বিক সম্পদকেই মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে আবদ্ধ করে দিচ্ছে। এর সহজতম উদাহরণ হতে পারে মেক্সিকোর কার্লোস স্লিম, যিনি বেসরকারিকরণের সময় মেক্সিকোর সিংহভাগ টেলিফোন আর মোবাইল নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ পান। ফলাফল? কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন।
তবে নব্যউদারবাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সম্ভবত অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হলো ভোটাধিকার। কিন্তু নব্যউদারবাদ সেই ভোটের ক্ষমতাকে সংকুচিত করে এনেছে। কেননা নব্যউদারবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাই কমে আসছে, সব চলে যাচ্ছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আর ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে। নির্বাচন আর ভোটও এখন বাজারের পণ্য, যা কেনাবেচা হয়। ফলে অধিক ক্রয় ক্ষমতাসম্পন্ন ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণীই নিয়ন্ত্রণ করছে নির্বাচন ব্যবস্থা, বেছে নিচ্ছে এমন কোনো সরকার, যারা তাদের স্বার্থে কাজ করবে আর উপেক্ষিত থাকবে সিংহভাগ জনগোষ্ঠী। দিনকে দিন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণী তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা একেবারেই হারিয়ে ফেলছে। ফলে সরকারগুলো জনগণের সাথে নৈতিকভাবে সম্পর্কচ্যুত হয়, প্রশাসন আর আমলাতন্ত্র ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয় এবং এই আমলাতন্ত্রই নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে জনবিচ্ছিন্ন সরকারকে সমর্থন দেয়, পুনরায় নির্বাচিত করে, সৃষ্টি হয় একদলীয় শাসন কাঠামো, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। তুরস্ক, মিসর এই অবস্থার সর্বোত্তম উদাহরণ।
নব্যউদারবাদ বাজারের অদৃশ্য হাতের মতোই এক অদৃশ্য ব্যবস্থা, যা আমাদের শ্রমটুকু কৌশলে বের করে নিয়ে মুনাফা তুলে দিচ্ছে গুটিকয়েকের হাতে। প্রশ্ন উঠতে পারে, অধিকাংশই যখন নব্যউদারবাদের কুফল ভোগ করছে, তাহলে এ ব্যবস্থা টিকে আছে কেমন করে? এ ব্যবস্থা টিকে আছে এজন্য যে এটি বাহুবল প্রয়োগ না করে মনস্তাত্ত্বিক কৌশল প্রয়োগ করে, মানুষের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সমাজের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সর্বত্র রয়েছে এ ব্যবস্থার নীরব সমর্থক, যাদের কলম সমালোচনার আদলে এ ব্যবস্থার সমর্থনে সরব! তারা কেন সরব, কীভাবে সরব, তা খুঁজে বের করা খুবই জরুরি। বিশ্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বাসযোগ্য ও নামকরা অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিক অ্যাফেয়ার্স’ বা আইইএ। এ প্রতিষ্ঠানটি বরাবরই নানা যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে তামাকশিল্পের উপর সরকারি আইন কঠোর হলে বরং তামাকশিল্প অধিক বিকশিত হবে, মানুষ বেশি মাত্রায় ধূমপায়ী হবে। মানুষ সেগুলো বিশ্বাসও করেছে। অথচ ২০১৪ সালে ফাঁস হয়ে গেল যে ১৯৬৩ সাল থেকেই তামাকের পক্ষে ইতিবাচক গবেষণার জন্য ‘ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো’ অর্থায়ন করে আসছে আইইএ’কে! কারা এ ব্যবস্থাকে কীভাবে টিকিয়ে রাখছে, তা বুঝতে পারছেন এবার?
এতসবের পরও নব্যউদারবাদের পক্ষেও যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে, রয়েছে এর কিছু চোখ ধাঁধানো সফলতাও! সেসব সফলতা আদতে কাদের সফলতা এবং কীসের মাপকাঠিতে সফলতা, তা পাঠকের বিবেচ্য। যদি আপনি বিশ্বের ১% মানুষের সাফল্য বিবেচনা করেন, তাহলে নব্যউদারবাদকে সফল বলতেই হয়। কিন্তু এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কখনোই সমাজের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না। কেন করে না তার কয়েকটি কারণ সংক্ষেপে জেনে নিই চলুন।
- নব্যউদারবাদ মুক্তবাণিজ্য আর বিশ্বায়নের প্রচারক। আর এই মুক্তবাণিজ্য ও বিশ্বায়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক কর, কোটা ও অন্যান্য সরকারি শর্ত ছাড়াই উন্নত দেশের বড় বড় বহুজাতিক কর্পোরেশন ও কোম্পানি প্রবেশ করছে অনুন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের বাজারে। এদের প্রভাবে সেখানকার বাজারে প্রাযুক্তিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন আসছে যদিও, তথাপি সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে কর্পোরেশনগুলোই।
- নব্যউদারবাদের সুযোগ নিয়ে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সেসব দেশের স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে জোর দিচ্ছে। তাদের এরূপ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফসল আজকের সিরিয়া, ইয়েমেন!
- আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যাপী নব্যউদারবাদের মূল প্রচারক, যারা বিভিন্ন দেশের সাথে শর্তাধীন বাণিজ্যের মাধ্যমে সেসব দেশের বাজার দখল করে নিচ্ছে।
- নব্য উদারবাদের একটি বড় সফলতা হিসেবে ধরা হয় অসীম ব্যক্তিস্বাধীনতাকে। এই স্বাধীনতা বাজার ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্বাধীনতা অবশ্যই কাম্য, তবে তার সীমা নির্ধারণ প্রয়োজন কি না, সে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে নব্যউদারবাদ। মুক্তবাজার ব্যবস্থায় সম্পদ বিদেশে চলে যাওয়া তো আগেই আলোচিত হয়েছে। সংস্কৃতিতে নব্য উদারবাদ বৈদেশিক সংস্কৃতি ও ভাবধারার অবাধ প্রবেশাধিকার দেয়ায় দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তবে বিদেশী সংস্কৃতি, বিশেষ করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে অনেক সময় দেশী সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটছে, যাকে নব্যউদারবাদীরা ‘আধুনিকায়ন’ বলে অভিহিত করে। একইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠায় জনসেবামূলক এ খাতটি এখন লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুনত্ব আনয়ন করছে ঠিকই, তবে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে। ফলে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে অধিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
- চিকিৎসা খাত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া নব্যউদারবাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি। প্রচুর বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে ওঠায় সরকার এ খাতে যতটা মনোযোগ দেয়া উচিত, ততটা দিচ্ছে না। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যেসব উন্নত প্রযুক্তি আসছে, তা আসছে না সরকারিগুলোতে। এতে করে অমানবিক এক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সমাজের নিচুতলার মানুষজন। দেখা যাচ্ছে, একই রোগে কেউ সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করছে, কেউ বেসরকারি হাসপাতালে মোটা অংকের অর্থ খরচ করে সহজেই আরোগ্য লাভ করছে। তাছাড়া বেসরকারি ক্লিনিকে অধিক আয়ের আশায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের দায়িত্বে অনীহার অভিযোগ তো অতি সাধারণ।
- বিশ্ব জুড়ে অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলো নব্যউদারবাদেরই ফসল। এসকল প্রতিযোগিতায় নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে গলা ফাটানো হলেও আদতে এর মাধ্যমে নারীকে যৌন সুড়সুড়ি দানের পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মিডিয়া ও পণ্যের মালিকেরা। একটি সহজ উদাহরণ হতে পারে ভারত। সেখানে ৯০’র দশকে নব্যউদারবাদী ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল নরসীমা রাওয়ের সরকার কর্তৃক। আর ৯০’র দশকেই ঐশ্বরিয়া রাই, লারা দত্ত, প্রিয়াংকা চোপড়াসহ মোট ৬ জন ভারতীয় নারী বিশ্বসুন্দরী নির্বাচিত হন। এর আগে ভারত থেকে কেবল ১৯৬৬ সালে রিটা ফারিয়া জিতেছিলেন এ খেতাব। ব্যাপারটা কাকতালীয়? মোটেই না। নব্যউদারবাদ গ্রহণের সাথে সাথে বিশ্বের বড় বড় ভোগ্য পণ্য উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১০০ কোটি ক্রেতার এক বিশাল বাজার তৈরি হয় ভারতে। এ বাজারে পণ্য বিপণনের জন্য প্রয়োজন ছিল মডেল বা আইকন, তথা ‘সুন্দরী’। ফলে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ভারত থেকে একাধিক সুন্দরী নির্বাচিত করে পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিজ্ঞাপনের মোড়ক তৈরি করে দেয় এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা। এতে উভয়েরই লাভ। মিডিয়ার লাভ তারা এসব তারকার তারকাখ্যাতি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন থেকে প্রচুর আয় করে নিতে পারে, পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য বিক্রয় করতে পারে, আর সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলো দেশে বিদেশে প্রচুর স্পন্সর পায়। অন্যদিকে ক্ষতি কেবল সাধারণ ক্রেতাদের, যারা তারকাদের কৃত্রিম চাকচিক্যে মোহাচ্ছন্ন হয়ে কষ্টার্জিত অর্থ অপ্রয়োজনীয় ভোগে খরচ করে নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়।
- নব্যউদারবাদের বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে একচেটিয়াত্ব, যা নিয়ে নতুন করে আলোচনা করবার কিছু নেই। একচেটিয়া বাজারে সকল পণ্যের দাম মালিকের ইচ্ছাধীন হয়ে যায়। তাছাড়া প্রতিযোগী না থাকায় পণ্যের মান নিয়ে মাথা ঘামান না মালিক।
- নব্যউদারবাদী কাঠামো উন্নয়নের সংজ্ঞায়ন করেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে। ফলে একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়নের চিত্র ঢাকা পড়ছে চকচকে প্রবৃদ্ধির নিচে। কেননা, এ ব্যবস্থায় সম্পদের প্রবাহ সর্বদা ধনীদের দিকে থাকে এবং একটি দেশে কেবল ছোট একটি ধনীক শ্রেণী আর তাদের গড়া বেসরকারি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার হিসাবই প্রবৃদ্ধিকে স্বাস্থ্যবান করে তুলতে সক্ষম। সিংহভাগ দরিদ্র শ্রেণীর দীর্ঘঃশ্বাস এই চকচকে সংখ্যাটির নিচে ঢাকা পড়ে যায়।
নব্যউদারবাদের আরো বহুবিধ সমস্যা রয়েছে, যেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু সব দোষ এ ব্যবস্থার ঘাড়ে না চাপিয়ে অর্থনীতিবিদদেরও এর দায় নিতে হবে। একটি ক্ষয়িষ্ণু অর্থব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের জন্য কার্যকর নতুন কোনো ব্যবস্থার প্রচলন এখনো পর্যন্ত বিশ্বে হয়নি। ১৯২৯ সালে মুক্তবাণিজ্য নীতি (লেজো ফেয়ার) যখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধ্বস নামালো, তখন কেনেসিয়ান অর্থনীতিই ছিল এর যোগ্য উত্তরসূরী। আবার, ৭০ এর দশকে কেনেসিয়ান অর্থনীতি যখন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল, তখন শূন্যস্থান পূরণ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল নব্যউদারবাদ। কিন্তু তারপর? ২০০৮ সালে যখন নব্যউদারবাদের খোলস বেরিয়ে গেলো, তখন কিন্তু এটির বদলে নতুন কিছু গ্রহণ করার উপায় ছিল না। কারণ, আধুনিক অর্থনীতি যে নতুন করে আর ভাবতেই পারেনি!