এইচএসসি পরীক্ষা তো বটেই, প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধও প্রায় শেষ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া বা না পাওয়াদের একটা বড় অংশের প্রকাশ্য বা সুপ্ত বাসনা হচ্ছে দেশের বাইরে স্নাতক পর্যায়ে পড়তে যাওয়া। কিন্তু একে তো স্নাতক পর্যায়ে ফুল ফান্ড বৃত্তি খুবই দুর্লভ, তার উপর যে অল্প ক’টা বৃত্তি রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে পর্যাপ্ত জানাশোনার অভাবে অনেকেই আবেদন করতে পারেন না। কেবল সরকারি বিদেশী বৃত্তি, যেগুলো ফুল-ফান্ড এবং বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট কর্তৃক সার্কুলার প্রকাশিত হয়, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের সেরকম ৬টি জনপ্রিয় বৃত্তি নিয়েই আজকের এই লেখা।
রাশিয়ান সরকারি বৃত্তি
এ বৃত্তির অধীনে শতভাগ ফান্ডিং পেতে হলে আপনাকে পড়তে হবে রাশিয়ান ভাষায়। চিন্তা নেই, বৃত্তি পেয়ে গেলে ওদের খরচেই মূল কোর্সের পূর্বে ৭ মাস রাশিয়ান ভাষা ও ২ মাস রাশিয়ান সংস্কৃতির ওপর কোর্স করে নেবেন। টিউশন, বাসস্থান, ভিসা চার্জ সহ সব কিছু এ বৃত্তির অন্তর্ভুক্ত। তবে বিমান যাতায়াত ও খাবার খরচ নিজের। দেড়শ থেকে আড়াইশ ডলারের মতো পড়বে মাসিক খাবার খরচ। আর রাশিয়া পৌঁছে ১০০-১৫০ ডলার দিয়ে স্বাস্থ্য বীমা করাতে হবে।
স্নাতক বা আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায়ের ১৫ এর অধিক বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। বিষয় তালিকায় প্রকৌশলবিদ্যার সাথে আছে চিকিৎসাবিদ্যাও। তবে সেখানে ৬ বছর মেয়াদী ডিগ্রিটি এমবিবিএস নয়, ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি), যেটি বাংলাদেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল এসোসিয়েশন কর্তৃক স্বীকৃত। ডিগ্রিটির বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি শেষ করে আপনি চাইলে প্রাইভেট প্র্যাক্টিসও করতে পারবেন, আবার সরাসরি বিজ্ঞানী হিসেবে ওষুধ ও স্বাস্থ্যে গবেষণা করতে পারবেন। সার্কুলার প্রকাশিত হলে বিষয় তালিকা থেকে বিষয় পছন্দ করতে পারেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সার্কুলার আসে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে। সার্কুলারে প্রদত্ত আবেদন ফর্মের মেডিকেল সার্টিফিকেটের সঙ্গে সকল একাডেমিক সনদ, নম্বরপত্র, জন্মসনদ ও পাসপোর্টের ফটোকপির নোটারাইজড কপি জুড়ে ফাইলটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠাতে হয়। তাদের কর্তৃক সুপারিশকৃত আবেদনকারীরা ঢাকাস্থ ‘রাশিয়ান সেন্টার অব সায়েন্স অব কালচার’-এ মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানে মূলত প্রার্থীর ভাষা ও উপস্থাপনগত দক্ষতা দেখা হয়। এর ভিত্তিতেই হয় চূড়ান্ত মূল্যায়ন। তবে এ বৃত্তির বিশেষ স্কিমে পরমাণু প্রকৌশল পড়তে চান, তাদেরকে পূর্বে গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরের প্রক্রিয়াটি বাকি অন্যদের মতোই।
বৃত্তির সার্কুলার প্রকাশের পর আবেদনের সময় থাকে বড়জোর ৩ থেকে ৫ দিন। তাই কাগজপত্র আগে থেকেই প্রস্তুত রাখুন। বিস্তারিত তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন রাশিয়ান সেন্টার অব সায়েন্স এন্ড কালচার, ধানমন্ডিতে।
আইসিসিআর বৃত্তি (ভারত)
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর সবথেকে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভারতে পড়তে যায়। বৃত্তিটি দেয় মূলত ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর কালচারাল রিলেশন্স। স্নাতক পর্যায়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্যতীত মোটামুটি সব বিষয়েই আবেদন করতে পারবেন। টিউশন খরচ সম্পূর্ণ ফ্রি। থাকা-খাওয়া বাবদ আপনাকে প্রতি মাসে সাড়ে দশ হাজার রুপী দেওয়া হবে। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে সার্কুলার প্রকাশিত হয়। হাইকমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড ফর্ম নামিয়ে নিতে হবে প্রথমে। পিডিএফ ফর্মটিকে পূরণ করে তার সঙ্গে একাডেমিক সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্মসনদ, এইচএসসি সিলেবাস, ক্যারেক্টার ও মেডিকেল সার্টিফিকেট জুড়ে পিডিএফ ফাইল বানাতে হবে। পাসপোর্ট না থাকলেও আবেদনে ‘এপ্লাইড ফর’ লিখে আবেদন করতে পারেন। এরপর দুটি ধাপ –
- উক্ত ফাইলটি হাই কমিশনের মেইলে পাঠানোর পর আপনাকে লিখিত পরীক্ষার তারিখ জানানো হবে। সেদিন লিখিত পরীক্ষায় বসবেন, যেটি হবে কেবল ইংরেজি ভাষার দক্ষতার ওপর।
- লিখিত পরীক্ষায় আপনি উত্তীর্ণ হলে আপনাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হবে। সেখানে পূর্বে মেইলে পাঠানো ফাইলটির হার্ড কপি নিয়ে যেতে হবে।
তারপর আইসিসিআর আপনাকে নির্বাচিত করলে বৃত্তি পেয়ে যাচ্ছেন আপনি! ভাগ্য বেশি ভালো হলে নিজের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়েই পছন্দের বিষয়টি পাবেন, নতুবা যোগ্যতা ও আসন খালি থাকা সাপেক্ষে আইসিসিআর কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে পড়তে হবে।
কেজিএসপি বৃত্তি (দক্ষিণ কোরিয়া)
যে মাধ্যমেই পড়াশোনা করুন না কেন, এই বৃত্তিটিতে আপনাকে বাধ্যতামূলক কোরিয়ান ভাষা শিখতে হবে এক বছর। সেটির পুরো খরচ অবশ্য কর্তৃপক্ষই বহন করবেন। এই বৃত্তিটিতে আবেদন করতে আইইএলটিএস স্কোরের কোনো প্রয়োজন নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়া প্রায় সকল জেনারেল বিষয়ে আবেদন করতে পারেন। তবে শর্ত হচ্ছে হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন, তথা এইচএসসিতে গড়ে পেতে হবে অন্তত ৮০% নম্বর। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির ভেতর যেকোনো সময় সার্কুলার হবে, চোখ রাখুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। টিউশন, থাকা-খাওয়া, ভিসা চার্জ, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স সব কিছু বাবদ পাবেন বেশ ভালো অঙ্কের ভাতা। এমনকি বছরে একবার যাতায়াতের জন্য আপনি পাচ্ছেন রাউন্ড ট্রিপ বিমানের ইকোনমি ক্লাস টিকিট।
এর বাইরে ফুল ফান্ড নিয়ে কোরিয়ায় পড়ার জন্য আরেকটি সরকারি বৃত্তি রয়েছে, যা কেবল মানবিকের শিক্ষার্থীদের জন্য। কোরিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব আর্টসের নিজস্ব এ বৃত্তির অধীনে আপনি ‘সঙ্গীত’, ‘নাট্যকলা’, ‘চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও মাল্টিমিডিয়া’, ‘নৃত্য’ ও ‘ভিজুয়াল আর্ট’ বিষয়ে স্নাতক করতে পারেন। এ বছর আবেদনের শেষ তারিখ ৩০ জুন। বিস্তারিত জানতে এই লিংকে প্রবেশ করুন। আবেদনপত্রের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
সিএসসি বৃত্তি (চীন)
চাইনিজ স্কলারশিপ সেন্টার বা সিএসসি-এর বৃত্তিটিই মূলত চীন সরকারের বৃত্তি, যেটি বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও চীন দূতাবাস যৌথভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে। এর আওতায় আছে প্রায় আড়াইশ’ এর অধিক চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, কৃষি, অর্থনীতি, আইন, ব্যবস্থাপনা বিষয়। শিক্ষা, ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন ও চারুকলার বিষয়গুলোতে ফুল ফান্ডসহ বৃত্তিপ্রদান করা হয়। আপনার চীনা ভাষায় দক্ষতার প্রাতিষ্ঠানিক সনদ না থাকলে বৃত্তির পর আপনাকে চীনে বাধ্যতামূলক চীনা ভাষা শিখতে হবে এক বছর। কেননা পড়াশোনাও হবে সে ভাষাতেই। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে সার্কুলার প্রকাশিত হয় এবং আবেদন প্রক্রিয়া চালু থাকে। নোটারিকৃত একাডেমিক পরীক্ষার সনদ, মার্কশিটের সাথে দুটি প্রত্যয়ন পত্র, মেডিকেল সার্টিফিকেটের সফট কপি সহ প্রথমে এই লিংকে ঢুকে আবেদন করতে হবে। আবেদন প্রক্রিয়া শেষে পুরো ফর্মটি প্রিন্ট করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে।
মেক্সট বা মনবুশো বৃত্তি (জাপান)
উচ্চশিক্ষায় জাপান সবসময়ই এশিয়ার সেরা পছন্দের একটি। সেই জাপানের সবথেকে জনপ্রিয় বৃত্তিটি হচ্ছে মনবুকাগাকুশো বা সংক্ষেপে মনবুশো স্কলারশিপ। এর আরেক নাম মেক্সট বৃত্তি। বিশাল অঙ্কের ভাতার জন্যে এ বৃত্তি বিখ্যাত। কিন্তু এই বৃত্তির আওতায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি মিলিয়ে মাত্র ২০০ জন বাংলাদেশী সুযোগ পান। তার ওপর স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তি দেয়া হয় সবথেকে কম। যা-ই হোক, সাধারণ মার্চের শেষে বা এপ্রিলের মাঝামাঝির দিকে এর সার্কুলার প্রকাশিত হয়। আবেদনের খুঁটিনাটি পাবেন এই হাইপারলিংকড গুগল ড্রাইভ ফাইল থেকে।
আবেদনের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সুপারিশকৃতরা জাপান দূতাবাসে ইংরেজি ও জাপানি ভাষা দক্ষতার ওপর পরীক্ষা দেবেন, বিজ্ঞানে পড়তে আগ্রহীদের জন্য পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের ওপরও ছোটখাট একটি পরীক্ষা দিতে হবে। নির্বাচিতদেরকে তাদের পছন্দসই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রয়োজনীয়তা ও প্রথম পরীক্ষার ফলাফল সাপেক্ষে মেক্সটের অধীনে আরেকটি পরীক্ষায় পাস করতে হবে। সেটিকে উতরালেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত বৃত্তি।
তুর্কি বুরস্লারি বৃত্তি (তুরস্ক)
সাধারণত এপ্রিল মাস থেকে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়, অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সার্কুলার আসে। এই বৃত্তির জন্য প্রথমে একটি নির্দিষ্ট সাইটে ঢুকতে হবে। সেখানে নাম, জন্মতারিখ, ইমেইলসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন সফল হলে আপনার মেইল ঠিকানায় আবেদনের মূল ফর্মের লিংক পৌঁছে যাবে। সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য প্রদান করুন এবং নিজ ছবিও সকল প্রাতিষ্ঠানিক সনদের স্ক্যান কপি আপলোড করুন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয় রয়েছে।
- দু’টি অথবা কমপক্ষে একটি রিকমেন্ডেশন লেটার বা প্রত্যয়ন পত্র দিতে হবে। সরকারি কলেজের কোনো শিক্ষকের রেফারেন্স দিলে ভালো হয়। উল্লেখ্য, যাদের নাম উল্লেখ করবেন, তাদেরকে তুরস্ক দূতাবাস মেইল করে আপনার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবে। তাহলে বুঝতেই পারছেন এর গুরুত্ব কত।
- আবেদনে আপনাকে আইইএলটিএস স্কোর উল্লেখ করতে হবে। তবে আপনি যদি বৃত্তির আবেদনে বেছে বেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ তালিকায় উল্লেখ করেন, যাদের কোর্স মাধ্যম টার্কিশ ভাষা, সেক্ষেত্রে আইইএলটিএসের প্রয়োজন নেই আপনার। তবে টার্কিশ মাধ্যম বেছে না নেওয়াই ভালো, কেননা নতুন একটি ভাষা শিখে ভালো ফলাফল করা কঠিন। আপনি সর্বোচ্চ ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সাথে ১২ টি বিষয় পছন্দ তালিকায় দিতে পারেন। আবেদনের আগে পছন্দকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স প্রোগ্রাম ভালো মতো দেখে নেবেন যে কোন মাধ্যমে আপনাকে পড়তে হবে আর ইংরেজি মাধ্যমে আইইএলটিএস স্কোর কত চেয়েছে। সে অনুযায়ী আপনার অবস্থা বুঝে বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আপনার আবেদনপত্র তুরস্কের দূতাবাস আপনার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠাবে। তাদের পছন্দের সাথে আপনার আবেদনের প্রোফাইল ব্যাটে-বলে মিলে গেলে আপনি হয়ে যাবেন ‘শর্টলিস্টেড’। এই শর্টলিস্ট থেকে আপনাকে ডাকা হবে তুরস্কের দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের জন্য। দ্বিতীয় পরখের সে যাত্রাতেও আপনি উতরে গেলে এক-দেড় মাস পর বৃত্তির অফার লেটারটাও হাতে পেয়ে যাবেন। টিউশন তো সম্পূর্ণই ফ্রি, পাশাপাশি মাসিক ভাতা পাবেন ৭০০ টার্কিশ লিরা।
মেডিকেল স্কুলের জন্য ৯০% এবং অন্যান্য বিষয়ের জন্য আবেদনকারীকে এইচএসসিতে পেতে হবে ৭০% নম্বর। বিস্তারিত জানতে হাইপারলিংকড ওয়েবসাইট ভিজিট করুন, অথবা মেইল করুন এই এড্রেসে – info@turkiyeburslari.org
ফিচার ইমেজ: usnews.com