২০১২ সালে মার্কিন অধ্যাপক হ্যারি লিন্ডসল এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তিনি দেখলেন, যদিও তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই ইন্টারনেট থেকে কেনে, কিন্তু তাদের ক্লাসের পাঠ্যবই কেনার ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় বইয়ের দোকান থেকেই কিনতে পছন্দ করে। পোশাক-পরিচ্ছদ, মোবাইল ফোন, খাবার-দাবার ইত্যাদি সব কিছু কিনতেই তারা ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হলেও শুধু পাঠ্যবইয়ের বেলায় কেন এই ব্যতিক্রম? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু চমকপ্রদ ব্যাপারের খোঁজ পেলেন।
তিনি দেখলেন, তার ছাত্রদের স্মার্টফোন, ল্যাপটপ থাকলেও তাদের মধ্যে খুব স্বল্প সংখ্যক ছাত্রই ই-টেক্সট বুক কেনে। পাঠ্যবই কিনতে তারা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বইয়ের দোকানেই যায়। সেমিস্টার শেষে বইটি পড়া শেষ হয়ে গেলে সেটি তারা আবার ওই দোকানেই অল্প দামে বিক্রি করে দেয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা অনেকেই ব্যাপারটির সাথে পরিচিত। এক সেমিস্টারে পড়া শেষে যে বইয়ের আর প্রয়োজন হয় না, আমরা সেই বইটি যে দোকান থেকে কিনি সেখানেই কম দামে বিক্রি করে দেই বা অন্য কোনো বইয়ের সাথে বদল করে নিই। অনেকে আবার দোকানে না গিয়ে অনলাইনেও বই বিক্রি করে দেয়।
মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই হয়তো ভাবেন এই ব্যাপারটি কেবল আমাদের দেশেই হয়। কিন্তু না, সেমিস্টার শেষে পড়া বই বিক্রি করে দেওয়ার প্রচলন বিশ্বের অনেক জায়গাতেই আছে, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বুকেই আছে। ব্যবহৃত বইয়ের বাজার এতটাই বড় যে, বই প্রকাশকরা একে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই বিবেচনা করেন। এটিই একটি পূর্ণাঙ্গ ইন্ডাস্ট্রি হয়ে গেছে সেখানে। এখানেই শেষ নয়, এছাড়াও আছে বই ভাড়া দেওয়ার ব্যবসাও। আমরা এই ধারণাটির সাথেও পরিচিত, ছোটবেলায় আমরা অনেকেই বইয়ের দোকান থেকে কমিক বা থ্রিলার বই ভাড়া নিতাম, এখনও নেওয়া যায় কোথাও কোথাও। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের পাঠ্যবইও তেমনি ভাড়া পাওয়া যায়, এমন দোকানকে বলে ‘বুক রেন্টাল স্টোর’। যে সেমিস্টারে যা যা বই লাগে, সেগুলো ভাড়া নেওয়া এবং সেমিস্টার শেষে ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়।
এখন এই দুটি ব্যবসা মডেলই প্রকাশকদের জন্যে মারাত্নক সমস্যা স্বরূপ। কেননা এতে মূল বই প্রকাশকদের কাছে কোনো মুনাফা পৌঁছায় না। একই বই বারবার বিক্রি হয়ে শুধু হাত বদল হতে থাকায় বই প্রকাশকদের মাথায় হাত পড়ে। কারণ নতুন বইয়ের বিক্রি কমে যাওয়ায় মুনাফাও কমে যায়। আবার পুরনো বই বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার এই সমান্তরাল প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিয়েও তাদের খুব একটা কাবু করা সম্ভব নয়। সুতরাং ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ব্যবসায়িকভাবেই মোকাবেলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাদের সামনে।
বই ব্যবসার প্রথাগত পদ্ধতি
সার বিশ্বে অনেক নামকরা বই প্রকাশক আছে; যেমন- পিয়ারসন, ম্যাকগ্রিউ হিলস, ইত্যাদি। এদের প্রকাশিত অনেক বই আমরা বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ে থাকি। প্রথাগত বই ব্যবসায় প্রকাশক এক বা একাধিক সম্পাদক নিয়োগ করেন। সম্পাদকরা যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন তা হলো কী বিষয়ে পাঠ্যবই তারা বাজারে ছাড়বেন, সেটিতে কী কী বিষয়বস্তু রাখা হবে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন লেখক বা অধ্যাপক বইটি লিখবেন, সেটার বাজারে সম্ভাব্য চাহিদা কেমন হবে ইত্যাদি। সম্পাদকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। এ শিক্ষক বা লেখকগণ পাণ্ডুলিপি লিখে সম্পাদকদের দেন, তারা এসব পাণ্ডুলিপিকে যথাযথ সম্পাদনাপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যবইয়ে পরিণত করেন।
এরপর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে গিয়ে তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বইটি ছাত্রদের পড়াতে উৎসাহিত করেন, যাতে ছাত্ররা বইটি কেনে। পদ্ধতিটি ব্যয়বহুল, কেননা এতে বিক্রয় প্রতিনিধিদের যাওয়া-আসার খরচ, শিক্ষক ও লেখকদের বিনোদিত করা সহ (উপহারসামগ্রী, বইয়ের সৌজন্য সংখ্যা দেওয়া) বিভিন্ন খরচ থাকে। কিন্তু শুরু থেকেই এভাবে বই ব্যবসা চলে আসছে।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা: বৈচিত্রে সমাধান
পুরনো বই ভাড়ার দেওয়ার ব্যবসাকে টেক্কা দিতে প্রকাশকরা ঘন ঘন বইয়ের নতুন সংস্করণ বের করা শুরু করলেন; যেমন- কোনো বইয়ের গড়ে প্রতি বছরে একটি করে নতুন সংস্করণ বের করে বলা হলো, প্রতিটি নতুন সংস্করণ হালনাগাদকৃত তথ্য সমৃদ্ধ। কিন্তু ছাত্ররা যদি দেখে যে, নতুন সংস্করণে এমন আহামরি কোনো নতুনত্ব নেই, তখন এই সংস্করণ প্রকাশের পদক্ষেপ বাজারকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না।
আরেকটি কৌশল প্রকাশকরা গ্রহণ করলেন, সেটা হলো বইয়ের আন্তর্জাতিক সংস্করণ বের করা। যেমন- বড় প্রকাশক প্রতিষ্ঠানের সব বইয়েরই একটি করে এশীয় সংস্করণ থাকে, যেটি মূল কপি থেকে বেশ সস্তা হয়। এসব বই ছাপানো হয় সাদা-কালোতে, অপেক্ষাকৃত কম দামি কাগজে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ছাত্ররাও ওই বইগুলো কিনতে পারে। আমাদের দেশেও এসব বই পাওয়া যায়। যদিও অনেকে অতি সস্তা দামের ফটোকপি করা বই কিনতে অভ্যস্ত হওয়ায় এসব বইও তাদের কাছে ব্যয়বহুল ঠেকতে পারে।
এই কৌশলে প্রকাশকরা কিছু সফলতা পেলেও দেখা দিল নতুন সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্ররা দেখল, তারা চাইলেই কম দামি আন্তর্জাতিক সংস্করণের বই অনলাইনে অর্ডার করে পেয়ে যেতে পারে। ফলে তারা কম দামি এশীয় সংস্করণের বই অনলাইন মারফত কেনা শুরু করল! প্রকাশকরা তখন মূল বইয়ের বিষয়বস্তু আর আন্তর্জাতিক সংস্করণের বিষয়বস্তু আলাদা করে ফেললেন এই ঝামেলা এড়াতে।
আরেকটি পন্থার প্রচলন করলেন প্রকাশকরা, যেটা ছিল খুবই কার্যকরী। এটি পাঠ্যবইয়ের প্রচলিত ধারণাটিকেই আমূল পাল্টে দেয়। ইন্টারনেট চালুর পর প্রকাশনা সংস্থাগুলো মূল বইয়ের পিডিএফ বা ই-বুক বের করল। কিন্তু এটি তেমন জনপ্রিয়তা পেল না। কারণ কম্পিউটারে পাঠ্যবই পড়া খুব একটা আরামপ্রদ ছিল না। তখন আমাজন কিন্ডল বা আইপ্যাডও বের হয়নি। ছাত্ররা পিডিএফ বইয়ে কাগুজে বইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ লাইন দাগাতে বা লেখার পাশে দরকারি নোট লিখতে পারত না। প্রকাশকরা তখন তাদের বইগুলোর জন্যে অনলাইন প্লাটফর্ম, ফোরাম ইত্যাদি বানাতে শুরু করেন। বইয়ের সাথে সিডির ভেতরে দরকারি সফটওয়ার ও লার্নিং টুলস, গাণিতিক সমস্যা সম্পর্কিত হোম ওয়ার্ক ইত্যাদি সরবরাহ করতে শুরু করেন। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল।
ছাত্র এবং শিক্ষক সবাই এটিকে পছন্দ করল। প্রকাশকরা এরপর থেকে শিক্ষকদের কাছে তাদের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়ার বদলে, কার অনলাইন প্লাটফর্ম কত ভালো, সেটি নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এতে বেশ কিছু সুবিধা হয়েছিল। এর ফলেই ই-বুক ধারণাটি জনপ্রিয়তা পায়, আর এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আমাজন কিন্ডল ও ২০১০ সালে আইপ্যাডের মতো চমৎকার ডিভাইসগুলো বাজারে আসে। ছাত্ররা এসব ব্যবহার করে বাস্তবসম্মত বিষয়াদি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়, শিক্ষকরাও নতুন এসব পাঠ্য উপকরণগুলো যুগোপযোগী বলেই রায় দিলেন।
বই ব্যবসার অর্থনৈতিক দিকগুলো
সাধারণভাবে ধরা হয়, সমস্ত বই বিক্রি করে যে আয় হবে, তার ১০ ভাগ বইগুলো ছাপাতে খরচ হয়, সেটি হার্ডকভার বা পেপার ব্যাক যে আকারেই হোক না কেন। যেমন- কোনো বইয়ের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা হলে, ২.৫০ টাকা খরচ হয়েছে বইটি প্রিন্ট করতে। খুচরা বিক্রেতারা বইয়ের কভারে লিখিত মূল্যের অর্ধেক প্রকাশককে দিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে প্রকাশক পাবেন ১২.৫০ টাকা। এদিকে প্রকাশক আবার ২.৫০ টাকা আগেই খরচ করেছেন বই ছাপাতে। বইয়ের লেখক রয়ালটি হিসেবে বইটির মূল দামের ১৫% টাকা পান, ফলে ২৫ টাকার একটি বই থেকে লেখক পাবেন ৩.৭৫ টাকা।
এবার আসা যাক ই-বুকের ক্ষেত্রে ব্যবসা কেমন সে ব্যাপারে। স্বাভাবিকভাবেই ই-বুকের ক্ষেত্রে বই ছাপানোর কোনো ব্যাপার নেই। ফলে পাঠক একই দাম দিয়ে ই-বুক কিনতে চাইবে না, কারণ ছাপানোর খরচ বেঁচে যাচ্ছে। ফলে ২৫ টাকার বইয়ের দাম হবে প্রায় অর্ধেক, ধরা যাক ১৩ টাকা। ই-বুকে প্রকাশক পান ৭০% অর্থাৎ ৯.১০ টাকা। লেখক পাবেন ২৫% অর্থাৎ ২.২৮ টাকা। এখানে লক্ষ্যণীয়, ছাপানো বইয়ের থেকে ই-বুকে লেখকের রয়ালটির শতকরা পরিমাণ বেশি হলেও, ই-বুকের দাম কম হওয়ায় লেখক এক্ষেত্রে কম টাকা পান। ই-বুকে ছাপানোর খরচ নেই- এমন যুক্তিতে পাঠক এখানে হার্ডকভার বইয়ের সমান দাম দিতে চাইবে না কখনোই, যদিও বাস্তবতা হলো ছাপানো বইয়ের দামের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশই ব্যয় হয় ছাপানোর পুরো প্রক্রিয়ায়।
ই-বুকের অনেক সুবিধা, এটিকে বলা হয় চিরসবুজ সংস্করণ। কারণ সময়ের সাথে সাথে বইয়ের কোনো তথ্য পরিবর্তনের দরকার হলে, সেটি বইটির অনলাইন প্লাটফর্মে আপডেট করে দিলেই পাঠক তা জেনে যায়, এজন্য আয়োজন করে নতুন সংস্করণের প্রয়োজন পড়ে না। আপনি আপনার ই-বুক রিডারের ভেতর দরকারি কয়েক হাজার বই নিয়ে ঘুরতে পারেন। ট্রেনে করে ভ্রমণে যাচ্ছেন, চট করে ব্যাগ থেকে বের করতে পারেন শেষের কবিতা না হয় সঞ্চয়িতা, না হয় যা ইচ্ছা সেই বইয়েরই একটা কপি! কারণ আপনার ই-বুক রিডারে তো রয়েছে হাজারেরও বেশি বই! সুতরাং কোন বই ঝোলা থেকে বেরোবে, তা সম্পূর্ণই আপনার মর্জি। এর থেকে দারুণ ব্যাপার আর কী হতে পারে ?
তথ্যসূত্র: Crafting & executing strategy, Arthur A. thompson, 2014, page: C31.