ধরুন, আপনি একটি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রিজের নিচ দিয়ে একটি রেললাইন ধরে ছুটে আসছে একটি ট্রলি। ব্রিজ পেরিয়ে একটু সামনেই রেললাইনের উপর পাঁচজন মানুষ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। আপনি যদি কিছু না করেন, তাহলে এই পাঁচজনের মৃত্যু নিশ্চিত। ব্রিজের উপর আপনার হাতের নাগালেই একটি সুইচ আছে, যা চাপলে ট্রলিটি বিকল্প একটি ট্র্যাক ধরে এগিয়ে যাবে, কিন্তু সেই ট্র্যাকে অন্য একজন মানুষ একইভাবে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
এখন আপনার হাতে দুটো অপশন। এক, আপনি কিছুই না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। ফলে ট্রলিটি তার নির্ধারিত গতিপথেই এগিয়ে যাবে এবং পাঁচজন মানুষ মারা যাবে। অথবা দুই, আপনি সুইচটি চেপে তাদের ভাগ্যের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারেন। ফলে ঐ পাঁচজন রক্ষা পেয়ে যাবে, কিন্তু ভিন্ন একজন মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। আপনি কী করবেন? পাঁচজনকে বাঁচানোর জন্য একজনকে হত্যা করবেন? নাকি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পাঁচজনকে মারা যেতে দেবেন?
এটি একটি বিখ্যাত থট এক্সপেরিমেন্ট। ১৯৬৭ সালে দার্শনিক ফিলিপা ফুট সর্বপ্রথম গর্ভপাতের নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ সমস্যাটির অবতারনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে আরেকজন দার্শনিক জুডিথ থমসন সমস্যাটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তার হাত ধরেই সমস্যাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং দ্য ট্রলি প্রবলেম কিংবা দ্য ট্রলি ডিলেমা নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে সমস্যাটির অনেকগুলো সংস্করণ দার্শনিকদের আলোচনায় উঠে আসে।
ট্রলি প্রবলেমের একটি বহুল আলোচিত বিকল্প সংস্করণ অনেকটা এরকম- ধরুন আপনি আগের মতোই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। আগের মতোই নিচ দিয়ে একটি ট্রলি এগিয়ে আসছে, যেটি স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে গেলে পাঁচজন নিরাপরাধ মানুষ মারা যাবে। কিন্তু এবার আপনার হাতের পাশে বিকল্প কোনো সুইচ নেই। বরং আপনার পাশেই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে একজন বিশাল আকৃতির আগন্তুক, যাকে ধাক্কা দিয়ে রেললাইনের উপর ফেলে দিলেই কেবল ট্রলিটিকে থামিয়ে ঐ পাঁচজন মানুষকে বাঁচানো যাবে। এবার আপনি কী করবেন? পাঁচজনকে বাঁচানোর জন্য একজনকে সরাসরি হত্যা করবেন?
এ ধরনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সাধারণত দুই ধরনের মতবাদের প্রয়োগ দেখা যায়। একটি হচ্ছে উপযোগবাদী মতবাদ, যার মূল কথা হচ্ছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। এখানে কী করলে অধিক সংখ্যক মানুষ উপকৃত হবে, তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। উপযোগবাদীরা তাই উভয় ক্ষেত্রেই পাঁচজনকে বাঁচানোর জন্য একজনকে হত্যা করার পক্ষে মত দেয়। তাদের দৃষ্টিতে এটিই সমাজের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। অন্যদিকে দ্বিতীয় মতবাদ হচ্ছে নীতিশাস্ত্রীয় মতবাদ। এখানে কোনো অন্যায়ের পেছনে ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও অন্যায়কে নিরুৎসাহিত করা হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতেই হত্যা করা অন্যায়। তাই পাঁচজনকে রক্ষার প্রশ্নেও এরা একজনকে হত্যার বিরুদ্ধে মত দেয়।
তবে বাস্তব জগত যেহেতু মতবাদের উপর শতভাগ ভিত্তি করে চলে না, তাই এরকম নৈতিকতার প্রশ্নে অনেক সময়ই মিশ্র উত্তর পাওয়া যায়। অধিকাংশ মানুষই প্রথম ক্ষেত্রে সুইচ চেপে একজনকে হত্যার পক্ষে মত দেয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ধাক্কা দিয়ে হত্যার বিপক্ষে মত দেয়। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রথম ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই পাঁচজনকে রক্ষার জন্য সুইচ চেপে এক জনকে হত্যা করতে আগ্রহী। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যেখানে ধাক্কা দিয়ে হত্যা করতে হবে, সেখানে অধিকাংশ মানুষই হত্যার বিরোধী। সেক্ষেত্রে তারা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে পাঁচজনকে মৃত্যুবরণ করতে দেখাকেই অধিকতর নৈতিক বলে মনে করেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, উভয় ক্ষেত্রেই যেহেতু মূল ফলাফল একই, অর্থাৎ মাত্র একজনের প্রাণের বিনিময়ে পাঁচজনের প্রাণ রক্ষা করা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে একই মানুষ কেন দুই পরিস্থিতিতে দুই রকম উত্তর দিচ্ছে? দার্শনিক ফিলিপা ফুট ব্যাপারটির ব্যাখ্যা দেন এভাবে, এখানে একটি হচ্ছে মারা যেতে দেওয়া, আর অন্যটি হচ্ছে হত্যা করা। প্রথমটি পরোক্ষভাবে মৃত্যুর পরিবেশ সৃষ্টি করা, অন্যদিকে দ্বিতীয়টি প্রত্যক্ষ হত্যাকাণ্ড।
প্রথম ক্ষেত্রে সুইচ চাপার মাধ্যমে সরাসরি কাউকে হত্যা করা হচ্ছে না, বরং পাঁচজন মৃত্যু পথযাত্রীকে রক্ষা করা হচ্ছে। এর ফল হিসেবে একজনের মৃত্যুর পথ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একজনকে ধাক্কা দিয়ে ব্রিজ থেকে ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এই পার্থক্যের কারণেই মানুষ দুই পরিস্থিতিতে দুই রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
ট্রলি প্রবলেমটির আরেকটি বিকল্প সংস্করণের মাধ্যমে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। ধরুন আপনি একজন ডাক্তার। আপনার অধীনে পাঁচজন রোগী চিকিৎসাধীন আছে, যাদের দুইজনের একটি করে ফুসফুস, অন্য দুইজনের একটি করে কিডনি এবং অপর একজনের একটি হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এই অঙ্গগুলোর ব্যবস্থা না হলে তারা পাঁচজনই মৃত্যুবরণ করবে। ঠিক এমন সময় আরেকজন রোগী এলো ভাঙ্গা পায়ের চিকিৎসা করার জন্য। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন, তার রক্তের গ্রুপসহ কিডনি, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড সবই আপনার মুমূর্ষু রোগীদের চাহিদার সাথে মিলে গেছে। এখন আপনি কি ঐ পাঁচ রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য এই নতুন রোগীকে হত্যা করবেন?
এক্ষেত্রে খুবই সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া কেউই নতুন রোগীকে হত্যার পক্ষে মত দেয় না। কিন্তু ঠিক কী কারণে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? এর একটি ব্যাখ্যা উঠে এসেছে ২০০১ সালে দার্শনিক জশুয়া গ্রীনির চালানো একটি পরীক্ষায়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেওয়ার সময় তিনি fMRI মেশিনের মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। তার গবেষণা থেকে দেখা যায়, যখন মানুষকে সুইচ চেপে পরোক্ষভাবে একজনকে মারা যেতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়, তখন তার মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশটি বেশি সক্রিয় থাকে। মস্তিষ্কের এই অংশটি যুক্তি এবং সমস্যা সমাধানের কাজ করে থাকে।
অন্যদিকে একই ব্যক্তিকে যখন ধাক্কা দিয়ে রেললাইনে ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে কাউকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়, তখন তার মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশ বেশি সক্রিয় থাকে। এই অংশটি মূলত আবেগীয় ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দার্শনিক জশুয়া গ্রীনি সিদ্ধান্তে আসেন, যখন মানুষ নিজে সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কথা চিন্তা করে, তখন তার মধ্যে যুক্তির চেয়ে বরং আবেগীয় অংশটি বেশি কাজ করে। সেকারণেই একজনের বিনিময়ে পাঁচজনের প্রাণ রক্ষা করার সম্ভাবনা থাকলেও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উদাহরণের ক্ষেত্রে মানুষ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
বিশ্বের সব মানুষ অবশ্য একইভাবে চিন্তা করে না। এই সমস্যাগুলোই একদল মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনীর সামনে উপস্থাপন করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী কেভিন ডাটন। তিনি লক্ষ্য করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনোবিকারগ্রস্ত খুনীরা পাঁচজনকে বাঁচানোর জন্য একজনকে হত্যার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছে। একইরকম একটি গবেষণা পরিচালনা করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ঝিন ঝিয়াং। তিনি বৌদ্ধ সন্নাসীদের উপর পরিচালিত জরিপ থেকে লক্ষ্য করেন, তারা সাধারণ চাইনিজ অথবা আমেরিকানদের তুলনায় আগন্তুককে ব্রিজ থেকে ফেলে হত্যা করার পক্ষে বেশি মত দিয়েছেন। ধারণা করা হয়, বৌদ্ধ সন্নাসীরা যেকোনো সমস্যা ঠাণ্ডা মাথায় যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে পারে বলেই তারা উপযোগবাদীদের মতো সিদ্ধান্ত দেয়। অন্যদিকে মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনীরা তাদের আবেগ এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতির অভাব থেকে এ ধরনের উত্তর দেয়।
অনেকের কাছেই ট্রলি প্রবলেমের মতো এ ধরনের সমস্যাকে অপ্রয়োজনীয় বা নিছক তত্ত্বীয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে প্রায়ই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তারা কি একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসীকে হত্যা করতে গিয়ে কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে পাঁচজনক বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করবেন? নাকি তাকে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে তার দ্বারা আরো বেশি বেসামরিক জনগণের মৃত্যুর ঝুঁকি নেবেন?
বর্তমানে ড্রোন আক্রমণে বেসামরিক জনগণের হতাহতের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে। এর সাথেও অনেকে ট্রলি প্রবলেমের প্রথম উদাহরণের তুলনা করেন। কারণ গতানুগতিক সম্মুখ যুদ্ধের তুলনায় ড্রোন আক্রমণ অনেকটাই পরোক্ষ হত্যাকাণ্ড, যা অনেক ক্ষেত্রেই ড্রোন নিয়ন্ত্রকের আবেগকে যথেষ্ট নাড়া দিতে পারে না।
When you apply the “trolley problem” to self-driving cars things start to get difficult https://t.co/zZTBrbQ21T #technology pic.twitter.com/2xGLWUFfgJ
— World Economic Forum (@wef) March 20, 2017
প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, এ ধরনের দার্শনিক সমস্যাগুলোও ততই তাদের তত্ত্বীয় গণ্ডি ছেড়ে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। ট্রলি সমস্যার বাস্তবিক প্রয়োগের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সেলফ ড্রাইভিং কারের সফটওয়্যারে এর ব্যবহার। সেলফ ড্রাইভিং কার যদি কখনো এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে, যেখানে তাকে হয়তো সামনের গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে ঐ গাড়ির পাঁচজনকে হত্যা করার ঝুঁকি নিতে হবে, অথবা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া নিরীহ এক পথচারীকে হত্যা করতে হবে, তাহলে সে কী সিদ্ধান্ত নেবে? এক্ষেত্রে সঠিক উত্তর কী হবে তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক থেকেই যাবে, কিন্তু তারপরেও একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
ফিচার ইমেজ- Youtube