আমরা কী স্বাধীন? আমরা যা করি তা কী সবই নিজের ইচ্ছায়? নাকি সবকিছু নিয়তির খেলা? এই বিতর্কে যাবার আগে একটি গল্প শোনানো যাক। গ্রিক পুরাণে বর্ণিত বিখ্যাত ইডিপাসের নাম শুনে থাকবেন। তার জন্মের পূর্বেই এক বিখ্যাত জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, ইডিপাস বড় হয়ে তার বাবাকে হত্যা করবেন এবং মাকে বিয়ে করবেন। শুনতে অদ্ভুত হলেও ইডিপাসের বাবা জ্যোতিষীর কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছিলেন এবং জন্মের পরপরই ইডিপাসকে এক জঙ্গলে নিয়ে রেখে এলেন, যেন ইডিপাসকে বন্য প্রাণী খেয়ে ফেলে! কিন্তু, বনে হরিণ শিকার করতে আসা এক শিকারি ফুটফুটে শিশু ইডিপাসকে খুঁজে পেলেন এবং নিজের সাথে নিয়ে গেলেন। ইডিপাস ঐ শিকারির পরিবারে বড় হলেন এবং একসময় জানতে পারলেন যে বর্তমান বাবা-মা তার প্রকৃত বাবা-মা নয়।
এ কথা জানার পর তিনি যখন নিজের প্রকৃত বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইলেন, তখন তাকে জানানো হলো সেই জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। ইডিপাস মনে মনে ভীষণ চটে গেলেন এবং ঠিক করলেন যে নিয়তিকে ভুল প্রমাণিত করবেন। তিনি কাউকে না জানিয়ে অজানা এক দেশে চলে গেলেন। সেখানে একদিন এক অপরিচিত লোককে তিনি ভুলবশত হত্যা করেন। পরে মনে অনুশোচনা জন্মালে তিনি ঐ ব্যক্তির স্ত্রীকে বিয়ে করেন। আর এরপরই তিনি জানলেন সেই মর্মান্তিক সত্য। ঐ অপরিচিত ব্যক্তিটি ছিল তার বাবা আর যাকে তিনি বিয়ে করেছেন, তার মা! নিজের সাথে এমন অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে যাবার পর ইডিপাস আসলে কাকে দোষ দেবেন? তার নিজের ইচ্ছাকে? নাকি ভাগ্যকে?
অনেকেই বিশ্বাস করেন, মানুষ মাত্রই স্বাধীন এবং মানুষ যেকোনো কাজ নিজের ইচ্ছাতেই করে থাকে। এই বিশ্বাসকে দর্শনের ভাষায় উদারবাদী বিশ্বাস বলে। উদারবাদীরা বিশ্বাস করেন, মানুষ সকল কাজ নিজের ইচ্ছাতেই করে। অন্যদিকে আরেকদল বিশ্বাস করেন, সবকিছু নিয়তির উপর নির্ভর করে। তারা অবশ্যই ইডিপাসের ঘটনাটিকে উদাহরণ হিসেবে টানবেন! এই দলের বিশ্বাস হচ্ছে নিয়তিবাদ। তবে এই দুই দলের বাইরে আরেকদল আছে, যারা সমঝোতায় বিশ্বাস করেন। এই শ্রেণীর বিশ্বাস এই যে, পৃথিবীতে সবকিছু মানুষের ইচ্ছাশক্তিতে ঘটে না, আবার সব কিছুই নিয়তির উপর নির্ভরশীল না। ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কিন্তু একইসাথে দুটি বিশ্বাস কী আদৌ যৌক্তিক? অথবা উদারবাদী আর নিয়তিবাদী বিশ্বাসের মধ্যে কোনটি সঠিক? এই আলোচনার শেষে সেই সিদ্ধান্ত আপনারই নিতে হবে পাঠক।
উদারবাদী বিশ্বাসের কেন্দ্রে রয়েছে আরেকটি দর্শন যার নাম, ‘প্রিন্সিপ্যাল অব অলটারনেট পসিবিলিটিজ’। এই দর্শনের মূলকথা হচ্ছে, কোনো কাজকে তখনই স্বাধীন বা স্বচ্ছন্দ বলা যাবে যখন সে কাজের সমতুল্য একটি বা একাধিক বিকল্প থাকবে। অর্থাৎ, একটি কাজ সম্পন্ন করে আপনি তখনই দাবি করতে পারবেন যে কাজটি আপনি নিজের ইচ্ছাতে করেছেন, যখন আপনার হাতে এক বা একাধিক বিকল্প থাকবে। সত্যিকারের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ হতে হলে তার বিকল্প থাকতে হবে, এ কথায় আবার নিয়তিবাদ বিশ্বাস করে না। নিয়তিবাদে কোনো বিকল্প নেই। বরং নিয়তিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে মানুষ আসলে তা-ই করে যা তার করার কথা ছিল বা পূর্বনির্ধারিত ছিল।
মনে করুন, এক ব্যক্তির কাছে সকালের নাস্তায় রুটি এবং ভাত রয়েছে। তিনি রুটি না খেয়ে ভাত খেলেন। এটি কি তিনি নিজের ইচ্ছায় করেছেন নাকি তার নিয়তি তাকে করিয়েছে? এরকম দৃশ্যকল্পে নিয়তিবাদকে ভুল প্রমাণ করতে উদারবাদীরা দুটি পরিভাষা ব্যবহার করেন। একটি ‘ইভেন্ট কজেশন’ বা ঘটনার কার্যকরণ এবং অন্যটি ‘এজেন্ট কজেশন’ বা ‘প্রতিনিধির কার্যকরণ’। ঘটনার কার্যকরণ বলতে বোঝায় সকল ভৌত ঘটনাই পূর্ববর্তী কোনো ভৌত ঘটনার ধারাবাহিকতায় ঘটে। যেমন, কেউ একজন একটি পাথর পুকুরে ছুড়ে মারলে সেটি কিছুক্ষণ বাতাসে থেকে পানিতে তলিয়ে যায়। প্রথমত, পাথরটির মাটি থেকে শূন্যে ভাসার কারণ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যিনি একে ছুঁড়ে মেরেছেন। আবার পাথরটি পানিতে তলিয়ে যাবার কারণ হচ্ছে সেটি উড়তে উড়তে গিয়ে পানিতে পড়েছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ঘটনাই পূর্ববর্তী ঘটনার ধারাবাহিকতায় ঘটেছে। তাই ভৌত জগতকে উদারবাদীরাও নিয়তিবাদী মনে করেন।
আর প্রতিনিধির কার্যকরণ বলতে বোঝায় যেকোনো ঘটনার উৎসের ইচ্ছা। যে ব্যক্তি পাথর ছুড়ে মারলেন, তিনি তা না করলে পাথরটি মাটিতেই পড়ে থাকতো। অর্থাৎ, পাথরের পুকুরের তলদেশে চলে যাওয়া মোটেও দৈব নয়। এর পেছনে একজন ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছাশক্তিই কাজ করছে। উদারবাদীরা মনে করেন, পৃথিবীর যা কিছু আপাতদৃষ্টিতে দৈব মনে হয়, তার পেছনেই কোনো না কোনোভাবে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। ভাবছেন উদারবাদের জয় হয়ে গেল? না, এত সহজেই নিয়তিবাদীরা হাল ছেড়ে দেবেন না। আলোচনার এ পর্যায়ে এসে নিয়তিবাদীরা পাল্টা প্রশ্ন রাখলেন যে এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিটাই বা কিভাবে এলো? ঐ ব্যক্তি কেন পাথরটি ছুঁড়ে মারার সিদ্ধান্তই নিলেন? কেন তিনি সেটি ফেলে চলে গেলেন না? এগুলো কী স্বতস্ফুর্ত? এই প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে কিন্তু জয়ের পাল্লা নিয়তিবাদীদের দিকেই ভারী হবে।
এবার উদারবাদীরা দাবি করলো যে, এর পেছনে আর কোনো কারণ নেই। ঐ ব্যক্তির ইচ্ছা হয়েছে তাই সে পাথরটি ছুঁড়ে মেরেছে, এর পেছনে কারণ খোঁজার প্রয়োজন নেই। কিন্তু দর্শনের বিতর্ক এভাবে চলে না। প্রয়োজন অকাট্য যুক্তির। উদারবাদকে আরো কোণঠাসা করতে তেমনই এক যুক্তি নিয়ে হাজির হলেন অষ্টাদশ শতকের জার্মান দার্শনিক ঢোলবাখ। তার মতে, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, সবই এক অবিচ্ছিন্ন শৃঙ্খলের অংশ। আর এই যুক্তি ‘রিডাকশনিজম’ বা খণ্ডতাবাদ তত্ত্বের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা কি না বিশ্বাস করে যে পৃথিবীর সকল কাজকর্মের আদি উৎস খুঁজতে গেলে সেগুলো এক বিন্দুতেই মিলিত হবে। যেহেতু উদারবাদীরা মনে করেন যে মানুষের মন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম, তাই ঢোলবাখ একটি সহজ সমীকরণের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তকে নিয়তির অন্তর্গত বলে প্রমাণ করেছেন।
মানুষের ইচ্ছা তার মানসিক ব্যাপার→ মানসিক ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিস্ক দ্বারা→ মস্তিস্ক একটি জীবতাত্ত্বিক ব্যাপার→ জীবতাত্ত্বিক ঘটনাগুলো আদিভৌতিক→ আর সকল ভৌতিক ঘটনাই নিয়তির উপর নির্ভরশীল, যা উদারবাদীরাও বিশ্বাস করেন!
এই যুক্তি দেখে উদারবাদীরা প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন, তাহলে রুটি আর ভাতের মধ্যে একটিকে বেছে নেবার ব্যাপারটির সমাধান কী হবে। ঢোলবাখ যুক্তি দেখালেন যে, কোনো কাজের পেছনের উদ্দেশ্য অনেক সময় অদৃশ্য থাকে যা আমাদের অবচেতন মনে কাজ করতে থাকে। ঐ ব্যক্তি হয়তোবা খেতে বসার কিছুক্ষণ আগে টিভিতে ভাতের ছবি দেখেছিলেন কিংবা বইয়ে পড়েছিলেন যা তাকে ভাতের দিকে আগ্রহী করে তোলে। আবার হয়তো তিনি আগেরদিন রুটি খেয়েছেন, তাই আজ আর রুটি খেতে ইচ্ছা করেনি। তার মতে, যেকোনো কাজ যা আপাত দৃষ্টিতে স্ব-ইচ্ছায় করা হয়েছে বলে মনে হবে, তার পেছনের বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা আর প্রকৃতি খুঁজে বের করতে পারলে তা নিয়তিবাদী বলে প্রমাণ হয়ে যাবে।
এবার উদারবাদীরা তাদের সর্বশেষ যুক্তি প্রদান করলো। নিজের ইচ্ছায় খাবার না খেয়ে যদি ঐ ব্যক্তি টস করার মাধ্যমে কোনটি খাবেন সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে কী হতো? নিয়তিবাদের উত্তর, এই টসের হেড হলে কোন খাবার আর টেল হলে কোন খাবার খাওয়া হবে তা তো ঐ ব্যক্তিই ঠিক করে দিয়েছেন, তাহলে ব্যাপারটা আগের মতোই রইলো! আপনি উদারবাদী হলে এতক্ষণে রেগে গিয়েছেন হয়তো। রেগে এই লেখাটা পড়া বন্ধ করে দিন, তবু তা আপনার নিজের ইচ্ছায় হলো না। কারণ, এই লেখার সার্বিক তথ্যগুলোই আপনাকে রাগিয়ে দিয়েছে, আর সে রাগের জন্যই আপনি পড়া বন্ধ করেছেন। এখানে নিজের ইচ্ছা কোথায়? আপনি চাইলেও নিজের ইচ্ছাকে স্বাধীন প্রমাণ করতে পারছেন না। তাহলে কী উদারবাদ আর স্বাধীন ইচ্ছা হেরেই গেল? না, এখনই সব শেষ নয়। ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত পড়ুন। উল্লেখ্য, পুরোটা পড়ে যাওয়াও আপনার নিজের স্বাধীন ইচ্ছা হলো না। কারণ, স্বাধীন ইচ্ছার জয় হতে পারে, লেখক এরকম আভাস দেয়ায় আপনি পুরোটা পড়তে যাচ্ছেন!
উদারবাদে বিশ্বাসীদের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসে ‘কম্প্যাটিবিলিজম’ বা সামঞ্জস্যতাবাদ। এই তত্ত্ব বিশ্বাস করে যে পৃথিবীর সব কাজই পূর্বনির্ধারিত, তবে কিছু কাজ এক অর্থে স্বাধীন সিদ্ধান্তের উপরও নির্ভর করে। ধরুন, রাস্তার মাঝে পড়ে থাকা একটি পাথর দেখতে পেয়ে আপনি সেটি সরিয়ে ফেলার জন্য সেটির দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। এখন দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমত, আপনি পৌঁছার পূর্বেই কেউ পাথরটি সরিয়ে ফেলতে পারে। কিংবা আপনি নিজে গিয়েই সেটি সরিয়ে ফেলবেন। উভয় ক্ষেত্রে পথরটির রাস্তা থেকে সরে যাওয়া নির্ধারিতই ছিল। কেবল দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কেউ না আসলে আপনি নিজে সরিয়েছেন, যা এক অর্থে স্বাধীন সিদ্ধান্ত।
২০০০ সালে একটি বিরল ঘটনা ঘটেছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে। সে বছর এক ব্যক্তিকে পেডোফিলিয়ার দায়ে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় যে তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্সে একটি টিউমার হয়েছে, যা তাকে অস্বাভাবিক আচরণের দিকে ধাবিত করেছে। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্সই সকল যৌন চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। টিউমার অপারেশন করার পর লোকটি সুস্থ হয়ে ওঠেন। যেহেতু টিউমারের উপর লোকটির কোনো হাত নেই, তাহলে তো ধরে নেয়া যায় ব্যাপারটা নিয়তির জন্য ঘটে। তবে, সামঞ্জস্যবাদ বিপরীত মেরুর উদাহরণ দিয়ে সাম্যাবস্থা বজায় রাখে। এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির আচরণ তার অনিচ্ছায় নির্ধারিত হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন হয়। যেমন অনেকে মদ পান করে কান্না করতে শুরু করেন। তার সেই কান্নাকে ইচ্ছাধীন না বললেও, তার মদ খাওয়াটা নিশ্চয়ই ইচ্ছাধীন ছিল?
একটু আগেই আমরা অলটারনেট পসিবিলিটিজ সম্পর্কে জেনেছি। এই তত্ত্ব বলে যে, কোনো কাজকে তখনই স্বাধীন বলা যাবে যখন তার এক বা একাধিক বিকল্প থাকবে। এর একটি অনুসিদ্ধান্ত এরূপ যে, যদি কোনো ব্যক্তির হাতে আর কোনো বিকল্প না থাকে, তাহলে সে তার কাজের জন্য দায়ী নন। কিন্তু এই দর্শনকে চ্যালেঞ্জ জানায় ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট কেস’। আমেরিকান দার্শনিক হেনরি ফ্রাঙ্কফুর্ট, অলটারনেট পসিবিলিটিজকে ভুল প্রমাণ করতে একটি কাল্পনিক দৃশ্যকল্পের অবতারণা করেছিলেন যা ফ্রাঙ্কফুর্ট কেস নামে পরিচিত। ফ্রাঙ্কফুর্টের এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির হাতে যদি অন্য কোনো বিকল্প না-ও থাকে, তাহলেও সে তার কাজের জন্য নৈতিকভাবে দায়ী।
ফ্রাঙ্কফুর্ট কেস: ডোনাল্ড নামক এক ব্যক্তি জীবনভর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের ভোট দেন। আসন্ন নির্বাচনেও তিনি ডেমোক্রেটদের ভোট দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন, যদি আমেরিকা ইরাক যুদ্ধে হেরে না যায়। এদিকে আমেরিকার ইরাক যুদ্ধে হেরে যাবার সম্ভাবনা থাকায় ডোনাল্ডের ভোট নিয়ে চিন্তিত ডেমোক্রেটিক পার্টি। তারা ডোনাল্ডের মস্তিষ্কে একটি ছোট ডিভাইস বসিয়ে দিল, যা তাকে ডেমোক্রেটদের বাক্সে ভোট দিতে বাধ্য করবে। তবে, যন্ত্রটি তখনই চালু হবে যখন আমেরিকা ইরাক যুদ্ধে হেরে যাবে এবং ডোনাল্ড রিপাবলিকানদের ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু দেখা গেল, নির্বাচনের আগে আমেরিকা যুদ্ধে হারলো না এবং ডেমোক্রেটদেরই ভোট দিল ডোনাল্ড। তার মাথায় বসানো যন্ত্রটি আর চালু করতে হয়নি।
এবার ভাবুন, ডোনাল্ডের হাতে কী ভোট দেয়ার জন্য দুটি বিকল্প ছিল নাকি একটি? আপনার উত্তর দুটি হলে আপনি ভুল। কারণ, সে যদি রিপাবলিকানদের ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও নিত, তাহলে তার মাথার যন্ত্রটি চালু হয়ে যেত এবং সে আদতে ভোটটা ডেমোক্রেটদের বাক্সেই ফেলতো! অলটারনেট পসিবিলিটিজ বলে, এখানে তার কোনো দায়ভার নেই। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট দাবি করলেন, এই দৃশ্যকল্পে ডোনাল্ড অবশ্যই নৈতিকভাবে দায়ী। কেননা, মার্কিনদের যুদ্ধে হেরে যাবার সম্ভাবনা ছিল (যদিও তখনো হেরে যায়নি) জেনেও সে ডেমোক্রেটদেরই ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও সে চাইলেই রিপাবলিকানদের বাক্সে ভোটটা ফেলতে পারতো না, তথাপি সে রিপাবলিকানদের ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্তত নিজের নৈতিক দায়ভার এড়াতে পারতো! এবার বলুন, ফ্রাঙ্কফুর্টের ভাবনার সাথে আপনি একমত পোষণ করেন কি না।
ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রধান যুক্তি হচ্ছে, বহিরাগত প্রভাব বা কারণ যা-ই হোক না কেন, একজন মানুষ তার কাজের জন্য তার নিজের ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তের দ্বারা দায়ী। যদি কেউ ভালো কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু বহিঃস্থ কোনো প্রভাবের কারণে বাধ্য হয়ে খারাপ কাজ করে, তাহলে সে নৈতিকভাবে বিশুদ্ধ। আর এজন্যই ফ্রাঙ্কফুর্ট মনে করেন, জনের ডেমোক্রেটদের ভোট দেয়াটা নিয়তির উপর নির্ভরশীল হলেও, রিপাবলিকানদের ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সে নৈতিক দায় এড়াতে পারতো, যা সম্পূর্ণরূপে তার ইচ্ছাধীন ছিল। এভাবে নিয়তিবাদ আর উদারবাদের মধ্যে সামঞ্জস্য গড়ে দেন ফ্রাঙ্কফুর্ট।
সামঞ্জস্যবাদের অন্যতম সমর্থক মার্কিন দার্শনিক পল চার্চল্যান্ড এক্ষেত্রে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষ কতটুকু স্বাধীন বা নিজের ইচ্ছাধীন, এই প্রশ্নটাই অবান্তর। তার চেয়ে বরং প্রশ্ন করা উচিৎ, মানুষের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কতটুকু। আপনি ধূমপান করতে চান না। কিন্তু বন্ধুদের আড্ডায় এবং তাদের প্ররোচনায় একদিন করেই ফেললেন। তখন কী নিয়তিকে দোষ দেবেন, নাকি বন্ধুদের? আপনি যদি উদারবাদী হয়ে বলেন যে ব্যাপারটা আপনার ইচ্ছাধীন ছিল, তাহলে প্রশ্ন থাকবে এর আগে কেন শুরু করেননি। বন্ধুদের প্রভাবের সূত্র ধরেই তো শুরু করেছেন। আবার যদি নিয়তিবাদে নিজেকে সঁপে দিয়ে দায়ভার ভাগ্যের ঘাড়ে চাপান, তাহলে প্রশ্ন থাকবে, আপনার ব্যক্তিত্ব বন্ধুদের প্রভাব পাশ কাঁটাতে পারলো না কেন? চার্চল্যান্ডের মতে, দোষ আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবের। আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বলেই ধূমপান শুরু করেছেন। এখানে কিছুটা ইচ্ছা কিছুটা ভাগ্য কাজ করছে। চার্চল্যান্ডের এই দর্শন, উদারবাদ আর নিয়তিবাদকে আরো শক্ত করে সামঞ্জস্যবাদের নামে একীভূত করে।
নিয়তিবাদের বিশ্বাস, পৃথিবীর সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত এবং পূর্ববত কোনো ঘটনার জের ধরেই ঘটে। আর উদারবাদের বিশ্বাস, মানুষ যা করে তা নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বলেই করে। কিন্তু সামঞ্জস্যবাদ বলে, নিয়তি আর স্বাধীন ইচ্ছা পরস্পর একসূত্রে গাঁথা।
আপনি কোনটা বেছে নেবেন পাঠক? আলোচনার এ পর্যন্ত পড়ে থাকলে আপনার কাছে একটি প্রশ্ন রাখা যাক। আপনি কী লেখাটা নিজের ইচ্ছাতেই পড়েছেন? নাকি পূর্ববর্তী কোনো ঘটনার ধারাবাহিকতায় প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন?
ফিচার ছবি: youtube.com