জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশের দর্শন আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই চলে আসে ‘নায়ালিজম’ বা ধ্বংসবাদের কথা। নায়ালিজমকে অনেকে বলে থাকেন এটি হচ্ছে অবিশ্বাস এবং নৈরাশ্যবাদের চূড়ান্ত পর্যায়। ধ্বংসবাদের মূলে রয়েছে সকল প্রকার নীতি নৈতিকতার ভিত্তিহীনতার বিশ্বাস। যারা ধ্বংসবাদে বিশ্বাস করে, তাদের নিকট পৃথিবীর সবকিছু অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন। খুব কম সংখ্যক দার্শনিকই নিজেদেরকে নায়ালিস্ট বলে দাবি করেছেন। যারা করেছেন, তাদের মধ্যেও সকলকে আবার প্রকৃত নায়ালিস্ট দাবি করা যায় না। এক্ষেত্রে ধ্বংসবাদের আলোচনায় যে নামটি সবচেয়ে প্রভাবশালী, তা হলো ফ্রেডরিখ নিটশে। অথচ অনেক সমালোচকের মতে, তিনিও প্রকৃত নায়ালিস্ট নন!
নায়ালিজম কী? সহজ ভাষায় বললে চরম নৈরাশ্যবাদ এবং সবকিছুর অর্থহীনতায় বিশ্বাসই নায়ালিজম। কিন্তু এতটুকু বললে ব্যাপারটার অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। নিটশের মতে, নায়ালিজম মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের একটি পর্যায় মাত্র। যখন মানুষ প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতায় ভোগে, তখন তারা ধীরে ধীরে প্রচলিত নীতি নৈতিকতা এবং সত্যের প্রতি বিমুখ হতে থাকে। অসীম হতাশা মানুষের কাছে সবকিছু অর্থহীন করে তোলে ধীরে ধীরে। নিটশের মতে, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর উদ্দেশ্যহীনতায় ভোগা এই পর্যায় মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। কারণ, মানুষ ততদিন নতুন কোনো নিয়ম প্রবর্তন করবে না, যতদিন না পুরাতনের প্রতি তার বিশ্বাস ভেঙে যায়। এ ব্যাপারটি পাঠকের নিকট কিছুটা স্ববিরোধী মনে হতে পারে। তাই বলে রাখা ভালো, ধ্বংসবাদ পরমকারণবাদে বিশ্বাস করে না, পৃথিবীতে কোনো কিছুর পেছনে কোনো যুক্তি বা কারণ আছে বলে বিশ্বাস করে না। ধ্বংসবাদের বিশ্বাস এই যে, সকল জীব ও জড়ের পেছনে আমরা যে কারণ বা উদ্দেশ্য খুঁজে পাই, সেগুলো পরম নয়, সেগুলো আমাদেরই কল্পনা মাত্র!
এখানে এসে ধ্বংসবাদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়। স্বক্রিয় ধ্বংসবাদ এবং নিষ্ক্রিয় ধ্বংসবাদ। প্রথমে নিষ্ক্রিয় ধ্বংসবাদ সম্পর্কেই জানা যাক। নিষ্ক্রিয় ধ্বংসবাদ হচ্ছে বিশ্বাসের ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকার লক্ষণ। এটি একজন মানুষকে দুর্বল করে দেয়, ইচ্ছাশক্তিকে বিলীন করে দেয়। একজন নিষ্ক্রিয় নায়ালিস্টের কাছে যখন সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে, তখন সে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সকল প্রকার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সামাজিক বিশ্বাস আর অভিপ্রায় হারিয়ে সে সবরকম দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়। এই প্রক্রিয়ায় একসময় সে প্রথাগত সমাজ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে নেয়। নিটশে এরূপ ধ্বংসবাদকে “মাদক সেবনে নিদ্রায় যাওয়া”র সাথে তুলনা করেছেন। কারণ প্রচলিত রীতিনীতি উপর কেবল বিশ্বাস হারিয়ে, সেগুলোর পুনর্বিবেচনা না করে নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না।
“ঈশ্বর মৃত। আমরাই তাকে মেরে ফেলেছি!”- নিটশে
ধ্বংসবাদের অধিকতর গ্রহণযোগ্য রূপটি হলো স্বক্রিয় ধ্বংসবাদ। একজন স্বক্রিয় নায়ালিস্ট প্রচলিত ধ্যান-ধারণার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান না। বরং তার ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয় এবং তিনি সেই ধ্যান-ধারণা ও নীতি নিয়ম ভেঙে ফেলতে চান। তৈরি করতে চান নতুন নিয়ম, নতুন প্রথা। স্বক্রিয় নায়ালিস্ট শুধুমাত্র সামাজিক অবস্থার বিচার বিবেচনা করেই ক্ষান্ত হন না, তিনি সেগুলো সমাজ থেকে মুছে ফেলে নতুন কিছু আনয়নের চেষ্টা করেন। নিটশের চোখে এটি ইতিবাচক এবং সমাজকে এগিয়ে নেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণও বটে। এভাবেই নিটশে তার নায়ালিজম বিষয়ক আলোচনার ইতি টেনেছেন। তার মতে, একজন ব্যক্তি যখন স্বক্রিয় নায়ালিস্ট হয়ে উঠবেন, তখন তার নিকট ঈশ্বর মৃত। কারণ সে নিজের কর্তৃত্ব নিজে নিয়ে নিয়েছে এবং নিজের জীবনধারা নিজে ঠিক করে নিচ্ছে। বিজ্ঞান এবং দর্শনের আলোকে সকল প্রকার পবিত্র এবং অশরীরী বিশ্বাস সে নিজ হাতে হত্যা করেছে।
এ পর্যন্ত আসার পর এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেহেতু নিটশের দর্শন ঈশ্বর এবং সার্বিক নীতি নিয়মের ইতি টানে, সেহেতু নিটশে কীরূপ জীবন দর্শনে বিশ্বাসী তা ব্যাখ্যা করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। নিটশের মতে, নৈতিকতা পুরোটাই আপেক্ষিক এবং তা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ভিন্ন হয়। যেমন, একজন কারখানার মালিকের নিকট তার শ্রমিকদের একদিন বেশি ছুটি চাওয়া কিংবা কাজে সামান্য আলস্যকে খারাপ মনে হতে পারে। বিপরীতক্রমে শ্রমিকদের চোখে নানা কারণে মালিককে মন্দ মনে হতে পারে। উভয়পক্ষই নিজেদের দৃষ্টিতে নিজেদের মতো করে নৈতিকতাকে সংজ্ঞায়িত করে নেয়। নিটশে একে বলেছেন ‘মাস্টার মোরালিটি’ এবং ‘স্লেভ মোরালিটি’।
এই স্লেভ মোরালিটি থেকেই আবার অপরাধবোধ বা বিবেকের মতো ব্যাপারগুলোর উৎপত্তি, যেগুলোর কোনো অস্তিত্ব একসময় ছিল না, কিংবা নেই কোনো ঐশ্বরিক ভিত্তি। বরঞ্চ দেনা পাওনার সম্পর্ক থেকেই উৎপত্তি হয় এই ধারণার। “পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে তার বিনিময়ে শাস্তি পেতে হবে, কেননা তা মন্দ কাজ”, এরূপ চিন্তা থেকে সবল মানুষেরা দুর্বল মানুষের মনে অপরাধবোধের সৃষ্টি করে! পশুপাখির জগতে একজনের খাবার অন্যজন ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে কোনোরূপ বিবেকের তাড়না থাকে না। কিন্তু মানুষের সমাজে ‘বিবেক’, ‘অপরাধ’ এর মতো শব্দগুলোর সৃষ্টি হয়েছে মানুষের ভেতরকার পশুপ্রবৃত্তিকে দমন করে রাখার জন্যই।
এই আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, প্রচলিত রীতি নীতিকে নিটশে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত মনে করেন। কিন্তু সমাজে বসবাস করা মানুষ আদতে সেসবেই সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ। মানুষ প্রচলিত কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে না কিংবা চায় না। কারণ তাদের ‘উইল টু পাওয়ার’ নেই। এই ‘উইল টু পাওয়ার’ নিটশের দর্শনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি কেবল শাব্দিক অর্থে ক্ষমতা প্রয়োগ বা লাভের অর্থকে বোঝায় না। বরং ‘উইল টু পাওয়ার’ বলতে নিজের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে বের করে আনার ইচ্ছাশক্তিকে বোঝায়, নিজেকে প্রকাশ করার অভিব্যক্তিকে বোঝায়, অনেক অনেক বিকল্পের মাঝে একটি বেছে নিয়ে জীবনকে উদ্দেশ্যময় করাকে বোঝায়।
খুব সাধারণ একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশকালে একজন শিক্ষার্থীর সামনে কর্মজীবনের অনেকগুলো দরজা থাকে, যেগুলোর মধ্যে একটিতে সে প্রবেশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে যার ‘উইল টু পাওয়ার’ প্রবল, সে নিজের ইচ্ছাকে সামনে রেখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সাংবাদিক হবার জন্য পড়াশোনা করে। কিন্তু যার ‘উইল টু পাওয়ার’ যথেষ্ট সবল নয়, সে পরিবার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে কর্মজীবনেও ব্যর্থতা বয়ে বেড়াতে হয় তার।
নিটশের দর্শন বিষয়ক আলোচনা শেষে রয়েছে ‘সুপারম্যান’ তত্ত্ব। নিটশে তার ‘দাজ স্পুক জারাথুস্ত্রা’ বইয়ে এই তত্ত্বের পরিচয় করিয়ে দেন। এখানে সুপারম্যান বলতে নিটশে কোনো কল্পকাহিনীর ক্ষমতাধর অতিমানবকে বোঝাননি। বরং সুপারম্যান বলতে এমন একজন স্বক্রিয় নায়ালিস্টকে বোঝানো হয়েছে, যিনি সকলের চেয়ে কাজে-কর্মে, চিন্তায়, মননে উৎকৃষ্ট। যখন সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, যারা প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ভেঙে ফেলতে চান, তখন সেসকল মানুষের মধ্য থেকেই কিছু মানুষ এগিয়ে আসবে যারা তাদের অনুপম চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে সমাজ কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন করবেন। নিটশের ব্যবহৃত জার্মান শব্দ ‘উবারমেনশ’ এর আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ হয় ‘ওভারম্যান’। তবে জর্জ বার্নার্ড শ’র নাটক ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ থেকে ওভারম্যানের পরিবর্তে সুপারম্যান জনপ্রিয় হয়।
ফ্রেডরিখ নিটশে ১৮৪৪ সালের ১৫ অক্টোবর প্রুশিয়ার একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে জার্মানির অন্তর্গত। শাল্পফোর্টা নামক একটি নামকরা স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। তবে দুই সেমিস্টার পরই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তন করে লিপজিগে চলে যান এবং দর্শন, ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দর্শনের প্রতি তার আজন্ম ভালোবাসা সৃষ্টি হয় বিখ্যাত দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের দর্শন পড়েই। ১৮৭০ সালে বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন নিটশে। এর দু’বছর পর তার প্রথম বই ‘দ্য বার্থ অব ট্রাজেডি’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ৮০’র দশকের শুরুতেই মানসিক সমস্যায় ভুগে অধ্যাপনা থেকে অব্যহতি দেন তিনি।
অধ্যাপনা ছেড়েই কর্মজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান নিটশে। প্রথমে সুইজারল্যান্ড, পরে ইতালি গিয়ে বাস করেন। পুরো আশির দশকটা তিনি সকলের চোখের আড়ালে, নীরবে নিভৃতে কাটিয়েছেন। তখন তার সময় কাটতো একমনে আকাশের দিকে চেয়ে চিন্তা করে, ব্যস্ত রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে অবিরাম ছুটে চলা মানুষের জীবন পর্যবেক্ষণ করে, ঘন নিবিড় অরণ্যে সবুজ সাগরে অবগাহন করে আর রাতের বেলা লেখালেখি করে।
নিটশে যদিও বিয়ে করবেন না বলেই স্থির ছিলেন, তথাপি নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এক নারীকে তিনবার বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি! দুর্ভাগ্য তার, তিনবারই সেই নারী প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। সম্ভবত এ কারণেই তার মানসিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। মাঝে এক বছর তাকে মানসিক হাসপাতালেও কাটাতে হয়েছে। ১৯০০ সালের ২৫ আগস্ট মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন এই দার্শনিক।
নিটশের সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থগুলোর একটি তালিকা দিয়ে শেষ করবো।
১) দাজ স্পুক জারাথুস্ত্রা
২) হিউম্যান, অল টু হিউম্যান
৩) দ্য উইল টু পাওয়ার
৪) বেয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল
৫) টোয়াইলাইট অব আইডলস
৬) দ্য গে সায়েন্স
৭) দ্য ডন
৮) দ্য অ্যান্টিক্রাইস্ট
ফিচার ছবি: Vision.org