শুরুতেই আপনাকে একটি সম্ভাব্য অপরিচিত শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক। শব্দটি হলো লোগোফাইল (logophile)। ক্যামব্রিজ ডিকশনারী অনুযায়ী এর অর্থ শব্দপ্রেমী, কিংবা শব্দ ভালোবাসে যে ব্যক্তি। তো, আপনি যদি একজন লোগোফাইল হয়ে থাকেন, আপনার মনে প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক, কীভাবে ডিকশনারিতে নতুন শব্দ যুক্ত হয়।
এই গুরুদায়িত্বটি যারা পালন করে থাকেন, তাদেরকে বলা হয়ে থাকে লেক্সিকোগ্রাফার (lexicographer)। শব্দটির বাংলা পরিভাষা হলো শব্দকোষ-সঙ্কলক বা অভিধানকার। তবে তারা যে স্রেফ নিজেদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী ডিকশনারিতে নতুন শব্দ যোগ করেন, তা কিন্তু নয়। এজন্য তাদেরকে একটি লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এবং শেষ পর্যন্ত তারা যতটা না নতুন শব্দকে ডিকশনারিতে যোগ করার সিদ্ধান্ত নেন, তার চেয়ে বেশি শব্দগুলোই নিজে থেকে ডিকশনারিতে প্রবেশের অধিকার আদায় করে নেয়।
মেরিয়াম-ওয়েবস্টারের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন ডিকশনারি এটি। সেই ১৮০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এবং তারপর থেকে প্রতি বছরই ডিকশনারিতে নতুন নতুন শব্দ যোগ করে আসছে তারা। যেমন এই বছরও দুই দফায় মোট ১১শ’র বেশি শব্দ যোগ করেছে তারা। ৬০০+ শব্দ তারা যোগ করেছে এপ্রিল মাসে, আরো ৫০০+ সেপ্টেম্বরে। নতুন শব্দ সংযোজন বলতে তারা তারা একদম নতুন অনেক শব্দকে যেমন ডিকশনারির পাতায় নিয়ে আসে, তেমনই বিদ্যমান অনেক শব্দেরও নতুন অর্থ লিপিবদ্ধ করে।
পৃথিবীতে এসপেরান্তোর মতো কিছু কৃত্রিম ভাষার প্রচলন রয়েছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ ভাষাই অকৃত্রিম তথা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। এসব ভাষার মূল উপাদান যে শব্দ, সেগুলোর জন্মও প্রাকৃতিকভাবে। কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়াই কোনো একদিন সেগুলো ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে, এবং বহু মানুষের মুখে ঘুরতে ঘুরতে ভাষার চিরস্থায়ী অঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর ডিকশনারিতে নতুন যেসব শব্দ যুক্ত হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।
মেরিয়াম-ওয়েবস্টারসহ পৃথিবীর অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় ডিকশনারির লেক্সিকোগ্রাফারদের কাজই হলো পড়া। প্রচুর পড়েন তারা। প্রতিদিনের একটি বড় সময় তারা কাটান বিভিন্ন নতুন বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং ইলেকট্রনিক প্রকাশনা পড়ে। হেন বিষয় নেই যা তাদের পাঠতালিকা থেকে বাদ যায়। এভাবে পড়ার মাধ্যমে তারা নতুন কোনো শব্দ বা বাক্যাংশের খোঁজ করেন, যা আগে কখনো তাদের চোখে পড়েনি। এছাড়া তারা অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন যে, কোনো শব্দ বা বাক্যাংশের বানান ভিন্নভাবে লেখা হয়েছে কি না, কিংবা বিদ্যমান কোনো শব্দ বা বাক্যাংশকেও নতুন অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না।
যখনই লেক্সিকোগ্রাফার বা অভিধান সম্পাদকরা এমন অভিনব ও চমকপ্রদ কিছুর দেখা পান, তারা তৎক্ষণাৎ সেগুলোকে টুকে রাখেন। সম্ভাব্য সকল তথ্য-উপাত্তও তারা যোগ করেন। যেমন: শব্দ বা বাক্যাংশটির বানান কী, অন্য কোনো শব্দের সাথে মিল রয়েছে কি না, কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ইত্যাদি। পড়া ও টুকে রাখার এই গোটা প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রিডিং অ্যান্ড মার্কিং’।
প্রাথমিকভাবে নতুন কোনো শব্দ বা বাক্যাংশকে শনাক্ত ও চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া সমাপ্ত হলে, তারা এবার সেটিকে তাদের কম্পিউটার সিস্টেমে প্রবেশ করান। এছাড়া তারা একটি ‘সাইটেশন’ও তৈরি করে। সাইটেশনে থাকে প্রধান তিনটি উপাদান: শব্দ বা বাক্যাংশটি, কোন প্রেক্ষাপটে শব্দ বা বাক্যাংশটি ব্যবহৃত হয়েছে, এবং সেটির উৎস সংক্রান্ত বিবলিওগ্রাফিক তথ্য (বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ইত্যাদি)।
প্রধানত তিন বিষয়ের বই, ম্যাগাজিন বা সংবাদপত্রে নতুন শব্দ বা বাক্যাংশের দেখা পাওয়া যায় বেশি। সেই বিষয়গুলো হলো প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং শিল্প। এর কারণ, এই তিন মাধ্যমেই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন হচ্ছে, এবং সেসব আবিষ্কারকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য নতুন নতুন শব্দ বা বাক্যাংশেরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কমিক স্ট্রিপও পাঠকদেরকে নতুন অনেক শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। লেক্সিকোগ্রাফারদের নজর এড়ায় না সেগুলোও।
কিন্তু কোনো শব্দ বা বাক্যাংশের সাইটেশন হলো মানেই যে সেটির ডিকশনারিতে জায়গা পাওয়া নিশ্চিত হয়ে গেল, তা মোটেই নয়। বলা যেতে পারে, একটি লম্বা প্রতিযোগিতার জন্য তাদেরকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হলো মাত্র। এখনো তাদেরকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত কোনো শব্দ বা বাক্যাংশ সব বাধা পেরিয়ে ডিকশনারির পাতায় জায়গা করে নিতে পারবে কি না, তা মূলত তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে: পুনরাবৃত্ত ব্যবহার, ব্যাপক বিস্তৃতি ও অর্থপূর্ণতা।
পুনরাবৃত্ত ব্যবহার: এক্ষেত্রে দেখা হয়, একটি নতুন শব্দ মাত্র কিছুদিন আলোড়ন তুলেই থেমে গেল, নাকি লম্বা সময় ধরেই সেটির ব্যবহার অব্যাহত থাকল। যদি দীর্ঘদিন পরেও শব্দটির আবেদন ও ব্যবহার অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে লেক্সিকোগ্রাফাররা নিশ্চিত হন যে শব্দটি হারিয়ে যেতে নয়, টিকে থাকতেই এসেছে, তাই সেটি আসলেই ডিকশনারিতে জায়গা লাভের যোগ্য দাবিদার। যেমন: OMG দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হলেও, লেক্সিকোগ্রাফাররা শুরুতে এটিকে একটি স্বতন্ত্র শব্দ হিসেবে মেনে নিতে রাজি হননি। কিন্তু একপর্যায়ে (২০০৯ সালে) যখন OMG নিজেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আলাপচারিতায় একটি নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তুলল, তখন মেরিয়াম-ওয়েবস্টারের লেক্সিকোগ্রাফাররা বাধ্য হলেন একে ডিকশনারিতে প্রবেশের সুযোগ করে দিতে। কিন্তু এর আগে প্রায় ১৫ বছর তারা পর্যবেক্ষণের নামে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন শব্দটিকে।
ব্যাপক বিস্তৃতি: একটি শব্দ কেবল বহুল ব্যবহৃত হলেই হবে না, সেটির বিস্তৃতিও ব্যাপক হওয়া আবশ্যক। যদি একটি শব্দ দীর্ঘদিন ধরে কেবল গুটিকতক স্থানেই ব্যবহৃত হয়, যেমন নির্দিষ্ট কোনো পত্রিকায়, কিংবা নির্দিষ্ট কোনো দেশে, তাহলে সেটি ডিকশনারিতে আসবে না। লেক্সিকোগ্রাফারদের যুক্তি হলো, একটি শব্দ ডিকশনারিতে আসতে চাইলে আগে প্রয়োজন বহু মানুষের অনুমোদন। দেখা গেল কোনো শব্দ একজন লেখক ৫০ বছর ধরে ব্যবহার করে গেলেন, কিন্তু তারপরও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খুব বেশি মানুষ সেটি ব্যবহার করতে শুরু করল না, তাহলে ওই শব্দের ডিকশনারিতে আসার কোনো অধিকার নেই। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একাই ১৭০০ নতুন শব্দ বা বাক্যাংশ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু শব্দগুলো শুধু এ কারণেই ডিকশনারিতে জায়গা পায়নি যে সেগুলো শেক্সপিয়ারের সৃষ্টি। বরং শেক্সপিয়ারের দ্বারা সৃষ্ট শব্দগুলোকে পরবর্তীতে বহু মানুষ ব্যবহার করতে শুরু করেছে বলেই সেগুলো ডিকশনারিতে আসতে পেরেছে।
অর্থপূর্ণতা: প্রতিনিয়তই মৌখিক ও লিখিতভাবে নতুন অসংখ্য শব্দ আত্মপ্রকাশ করছে। মাত্র দুই দশক আগেও কেউ bucket list, selfie, unfriend বা sexting শব্দগুলোর অর্থ জানত না। কারণ তখন এই শব্দগুলোর প্রচলন ছিল না। তখন যদি কেউ এই শব্দগুলো ব্যবহার করত, কেউ কিছু বুঝতেই পারত না। কিন্তু এখন এই শব্দগুলো সবাই বুঝতে পারে, কারণ এখন শব্দগুলোর নিজস্ব অর্থবাচকতা রয়েছে। সুতরাং কোনো শব্দ ডিকশনারিতে ঠাঁই পেতে চাইলে অবশ্যই সেটির অর্থ থাকতে হবে। আবার অনেক সময় পূর্ব-প্রচলিত অনেক শব্দের নতুন অর্থও ডিকশনারিতে যুক্ত হয়। যেমন: mouse, cookie ইত্যাদি দিয়ে এখন কেউ আর শুধু একটি প্রাণী বা একটি খাবারকেই বোঝে না। এছাড়া সম্প্রতি ডিকশনারিতে নতুন অর্থ লাভ করেছে peak শব্দটি। একসময় এটি দ্বারা শুধু কোনো কিছুর শীর্ষস্থানকে বোঝানো হলেও, এখন এর মাধ্যমে খ্যাতির সর্বোচ্চ পর্যায়ও বোঝানো হয়ে থাকে।
তো, যেসব শব্দ লেক্সিকোগ্রাফারদের বেঁধে দেয়া তিনটি শর্তই পূরণ করতে পারে, কেবল সেগুলোই যুক্ত হয় ডিকশনারির নতুন সংস্করণে। কিন্তু তাই বলে যেসব শব্দ ডিকশনারিতে যুক্ত হয় না, সেগুলো কি শব্দ নয়? অবশ্যই সেগুলোও শব্দ। একদম আসল শব্দই। শুধু হয়তো বহুল ব্যবহার, ব্যাপক বিস্তৃতি কিংবা অর্থবাচকতার অভাবে সেগুলো ডিকশনারিতে জায়গা পাচ্ছে না। তবু দৈনন্দিন জীবনে সেগুলো অবশ্যই ব্যবহৃত হতে থাকবে, এবং কোনোদিন যদি এমন দেখা যায় যে শব্দগুলো তাদের অতীতের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, তখন লেক্সিকোগ্রাফাররা সেগুলোকেও নির্দ্বিধায় আলিঙ্গন করে নেবেন।
আজকাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন নতুন শব্দ খুব সহজেই জনপ্রিয়তা ও বিস্তৃতি লাভ করছে। কেউ একজন হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিতান্ত মজা করেই কোনো একটি শব্দ ব্যবহার করল, কিন্তু সেটিই ভাইরাল হতে হতে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, মানুষের কাছে শব্দটির একটি আলাদা অর্থ ও তাৎপর্য তৈরি হয়ে গেল। এরকম ক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়িই শব্দগুলো চলে আসবে ডিকশনারির পাতায়, যা ইন্টারনেট-পূর্ববর্তী পৃথিবীতে কল্পনাও করা যেত না।
পরিশেষে অতি ব্যবহারে জরাজীর্ণ উপমাটিই আবারো দেব, “ভাষা হচ্ছে প্রবহমান নদীর মতো।” অর্থাৎ ভাষা কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। ভাষা প্রতিনিয়ত সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, এবং চলার পথে নতুন যা যা সে সামনে পায়, সেগুলোকে গ্রহণ করে, আবার সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুকে পেছনেও ফেলে আসে। অনেক রক্ষণশীল বা উন্নাসিক ব্যক্তিই ভাষার এই প্রবহমনতাকে মেনে নিতে চায় না। তাই ডিকশনারিতে নতুন যেকোনো শব্দের আগমনেই তাদের ভ্রু কুঁচকে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভাষা গুটিকতক অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ভাষার উপর অধিকার রয়েছে সমাজের প্রতিটি মানুষেরই। তাই সমাজের তথাকথিত নিচু শ্রেণীর মুখনিঃসৃত কোনো শব্দ, বাক্যাংশ, এমনকি গালিও যদি বহুল ব্যবহৃত হতে শুরু করে, ব্যাপক বিস্তৃতি পায়, এবং স্বকীয় অর্থও ধারণ করে, তাহলে সেগুলোও ঠিকই জায়গা করে নেবে ডিকশনারিতে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) উদ্ধৃতি-অভিধান
২) বাংলা বানান অভিধান
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/