আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ভাল কাজ করলেও, অনেক সময় দেখা যায় সচেতনতার অভাবে কিংবা সদিচ্ছার অভাবে তাদের গবেষণাগুলো কোনো ভালো কনফারেন্স কিংবা জার্নালে পাবলিশ হয় না। ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে শতকরা পাঁচ থেকে দশ ভাগ শিক্ষার্থী তাদের থিসিস পাবলিশ করে, আর অবশিষ্ট কাজ অবহেলায় অযত্নে পড়ে থাকে থিসিস আর্কাইভে। কিংবা তাদের সেই কাজটি নিয়ে পরে অন্য কেউ একটু ঘষামাজা করে আর পরিসরটা খানিক বৃদ্ধি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়।
কেন আপনার থিসিস পাবলিশ করবেন?
কথাটা বোধহয় এইভাবে বললে ভালো হয়– কেন পাবলিকেশনের উপযোগী থিসিস করবেন? খুব সহজে কথায় এর উত্তর হলো– পাবলিকেশনকে ভালো গবেষণা কাজের প্যারামিটার হিসেবে ধরা যায়– যদি না আপনি কোন ভুঁইফোড় কিংবা ভূয়া কোনো জার্নাল কিংবা কনফারেন্সে পাবলিশ করে না থাকেন। আর আপনি যদি ভবিষ্যতে কোনো সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহী হন তাহলে তা আপনাকে স্কলারশীপ পেতে অবশ্যই সাহায্য করবে। কেননা উচ্চ শিক্ষার পুরোটাই গবেষণাকেন্দ্রিক – এখানে যে একজন ভালো গবেষক হতে পারবে প্রফেসররা তাকেই খুঁজেন। কাজেই আপনার পাবলিকেশন প্রমাণ করবে যে গবেষণার কাজে আপনার হাতেখড়ি হয়ে গেছে।
কোথায় আপনার কাজ পাবলিশ করবেন? – কনফারেন্স না জার্নাল
একজন আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্রের এ ধরনের সিদ্ধান্তটা নেয়া বেশ কঠিন– তাই এক্ষেত্রে সুপারভাইজরের মতামতকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত। আপনার কাজ যদি মৌলিক হয় এবং মানেও খুব ভালো হয় তাহলে তা ন্যাচারের মত জার্নালেও পাবলিশ হওয়ার যোগ্য। জানামতে বাংলাদেশে এখন আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও ন্যাচারের মতো জার্নালে তাদের কাজ পাবলিশ করছে। কাজের মান অনুযায়ী আপনার কাজ আপনি চাইলে কনফারেন্স কিংবা জার্নাল– এই দুইয়ের যেকোনো একটিতে পাবলিশ করতে পারেন। তবে সাধারণত জার্নালের পাবলিকেশনকে বেশি গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। জার্নালে আপনার কাজ পাবলিশ করতে চাইলে তিনটি বিষয় এর দিকে খেয়াল রাখতে হবে–
১. জার্নালের স্কোপ
২. ইস্যু/বছর এবং
৩. ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর
কোনো জার্নালে আপনার পেপারটি পাঠানোর আগে তার স্কোপ জানাটা খুবই জরুরী। এর মানে হলো সেই জার্নালটি কোন কোন বিষয়ের উপর পেপার পাবলিশ করে থাকে। ধরা যাক– আপনি সিরামিক কম্পোজিট ম্যাটারিয়ালস নিয়ে কাজ করেন, এখন আপনি ঠিক করলেন আপনার কাজটি আপনি ম্যাটারিয়াল সায়েন্স রিলেটেড কোন ভালো জার্নালে পাঠাবেন। পাঠালেন ঠিকই, কিন্তু সিরামিক ম্যাটারিয়ালস সম্পর্কিত কাজ তাদের পাবলিকেশনের আওতায় পড়ে না। অন্যদিকে শুধুমাত্র সিরামিক কম্পোজিটের কাজ পাবলিশ করে এমন ভালো ভালো জার্নাল অনেক আছে। সেক্ষেত্রে এডিটর হয়তো আপনাকে একটি ইমেইল করে জানিয়ে দেবে যে, আপনার কাজটি তাদের জার্নালের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, আপনি অন্য কোথাও সাবমিট করুন। কাজেই কোনো জার্নালে পেপার সাবমিট করার আগে তার স্কোপ দেখে নেয়া অতি জরুরী, যাতে সময় নষ্ট না হয়।
আমরা প্রায় সবাই বিশেষত ব্যাচেলর কিংবা মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা চাই আমাদের থিসিসের কাজটি দ্রুত পাবলিশ হোক। সেজন্য একটি জার্নাল প্রতি বছর কয়টি ইস্যু পাবলিশ করে সেটা দেখে নেয়া উচিত। কিছু কিছু জার্নাল আছে বছরে ৪টি ইস্যু পাবলিশ করে। এর মানে তাদের প্রতি বছর প্রচুর পেপার দরকার হয়, এবং এদের সম্পাদনা ব্যবস্থাও দ্রুত, গড়ে তিন মাস। সুতরাং এ ধরনের জার্নালে পেপার সাবমিট করলে দেখা যাবে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে আপনার পেপারটি পাবলিশ হয়ে যাবে, যদি তা পাবলিকেশনের জন্য মনোনীত হয়।
অনেক জার্নাল হয়তো রিভিউ করতে পুরো এক বছর সময় নেয় আবার ভুঁইফোড় জার্নালগুলো দেখা যায় ১০ দিনের মাঝেই আপনার পেপার একসেপ্ট করে তার অনলাইন কপিও রিলিজ দিয়ে দিচ্ছে। সাধারণত ভুঁইফোড় জার্নালগুলো টাকা পেলেই পেপার পাবলিশ করে দেয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা করতে চান না কিন্তু প্রমোশনের জন্য তাদের ঠিকই পাবলিকেশন দেখাতে হয়। সেক্ষেত্রে তারা এইসব ভুঁইফোড় জার্নালে টাকা দিয়ে পাবলিশ করে থাকেন, যেখানে পেপার পাঠালেই দশ দিনের মাঝে একসেপ্টেড হয়ে যায় আর একশো ডলার দিলেই পেপার ছাপিয়ে দেয়। একশো ডলার বিনিয়োগে একরকম বিনা কষ্টে প্রমোশন বাগিয়ে নেয়া- এর চেয়ে ভাল বিনিয়োগ আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
এরপরে আপনাকে দেখতে হবে, জার্নালটির ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কেমন। সহজ বাংলায় ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর বলতে বোঝায়, প্রতি বছর কিংবা একটা নির্দিষ্ট সময়কালে কোনো জার্নালে পাবলিশ হওয়া পেপার কতবার অন্য কোনো পেপারে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন– কোনো জার্নালের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর যদি পাঁচ হয় তাহলে সেখানে পাবলিশ হওয়া পেপার বছরে গড়ে পাঁচটি করে সাইটেশন পায়। তবে হাই ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের জার্নালে পাবলিশ করার জন্য কাজ মৌলিক হওয়া চাই, নতুবা আপনার পেপার রিজেকশনের সম্ভাবনাই বেশি। তাই যারা গবেষণার জগতে একদম নতুন তারা চাইলে শুরুতে কম ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের জার্নালে পেপার পাবলিশ করতে পারেন, যেন উচ্চশিক্ষার্থে আবেদনের সময় আপনার অন্তত একটি পাবলিকেশন হলেও থাকে। আর ভবিষ্যতে আপনার মাস্টার্স, পিএইচডি এবং পোস্ট-ডকের সময় দেখা যাবে আপনার কাজের মান অনুযায়ী হাই ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের জার্নালে আপনার পাবলিকেশন হয়ে গিয়েছে।
অন্যদিকে জার্নালের তুলনায় কনফারেন্সে পাবলিশ করা তুলনামূলক সহজ। তাই আপনার কাজ যদি ছোট পরিসরে হয়ে থাকে তাহলে আপনি কনফারেন্সেও আপনার পেপার পাবলিশ করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনাকে দেখতে হবে সেটি আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স কিনা। নামের আগে হিরো থাকলেই যেমন হিরো হওয়া যায় না, ঠিক তেমনই নামের আগেই ইন্টারন্যাশনাল বসালেই গুণে ও মানে সেই কনফারেন্স আন্তর্জাতিক মানের হয়ে যায় না। ভুঁইফোড় ধরনের কনফারেন্স চেনার সবচেয়ে বড় উপায় হলো– এর অর্গানাইজিং কমিটি এবং এডভাইজার বোর্ডে কারা কারা আছেন তা ভালোভাবে দেখা।
সবার আগে দেখুন অর্গানাইজিং কমিটির মেম্বাররা ভালো গবেষক কিনা, তাদের নিয়মিত পাবলিকেশন হয় কিনা, এবং কমিটিতে বাইরের দেশের কোন কোন গবেষক যুক্ত আছেন, তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপরিচিত কিনা। বাইরের দেশেও প্রচুর আজেবাজে ইউনিভার্সিটি আছে, সুতরাং বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ফ্যাকাল্টির নাম দেখলেই উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। এরপর দেখুন এডভাইজর বোর্ডে কারা আছেন। এই জায়গাটিতেই শুভংকরের ফাঁকিটা বেশি হয়। সমস্যা হলো এই ফাঁকি ধরার সুযোগ কম থাকে। প্রথমত, এডভাইজর কমিটি মেম্বাররা মোটামোটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং ফ্যাকাল্টিদের নাম যুক্ত করে দেয়। যাদের নাম যুক্ত করা হয় তারা হয়তো সেটা জানেও না।
এজন্য খেয়াল করে দেখবেন অনেকসময় তাদের পুরাপুরি রেফারেন্স দেয়া হয় না, তাই সন্দেহ হলে তাদের মেইল করে দেখতে পারেন যে তিনি আসলেই এই কনফারেন্সের সাথে যুক্ত কিনা। এরপর দেখবেন স্কোপ অব কনফারেন্স– অর্থাৎ কনফারেন্সটি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের উপর ফোকাসড কিনা। যেমন– ম্যাটারিয়ালস রিসার্চ নিয়ে কনফারেন্স হলে সেখানে শুধু ম্যাটারিয়ালস ডেভেলপমেন্ট এবং ক্যারেক্টারাইজেশনের উপরই সেশন থাকবে, সেইখানে ফ্লুইড কিংবা থার্মাল ঢুকে যাবে না। অর্থাৎ ম্যাটারিয়াল এর থার্মাল প্রোপার্টিজ নিয়ে কেউ হয়তো কোন কিছু প্রেজেন্ট করতে পারে সেই সেশনে, তার মানে এই না যে সেই কনফারেন্সে গ্যাস টারবাইন ডিজাইন নিয়ে কেউ কথা বলবে।
এরপর দেখবেন কনফারেন্সের একসেপ্টেন্স রেট কেমন কিংবা তাদের রিভিউ প্রসেস আছে কিনা। ভালো ভালো কনফারেন্সে সাবমিট করা পেপার নূন্যতম এক থেকে দুই জন রিভিউয়ার দিয়ে রিভিউ করানো হয়, এবং সেখানে সব পেপার একসেপ্টডও হয় না, এমনকি ওরাল সেশনেও দেখা যাবে সবার এবস্ট্রাক্ট প্রেজেনেটশনের জন্য একসেপ্ট করা হয় না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওরাল প্রেজেন্টেশনকে পোস্টার প্রেজেন্টেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আর কনফারেন্সে পাবলিশড হওয়া পেপারগুলো কোনো আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন প্রসিডিং যেমন– AIP, IEE, ScienceDirect এর অধীনে পাবলিশ হয় কিনা তা-ও দেখবেন। এছাড়া দেখবেন কনফারেন্সের বিভিন্ন সেশনে ইনভাইটেড প্রেজেন্টেশনের সংখ্যা কেমন এবং কারা সেই প্রেজেন্টেশনগুলো দিচ্ছেন। যদি দেখেন ভালো ভালো গবেষক এসে কী-নোট স্পীকার হিসেবে আমন্ত্রণ পাচ্ছেন তাহলে বুঝবেন সেই কনফারেন্সে পেপার সাবমিট করা যায়।
থিসিস থেকে পেপার লেখার নিয়ম-কানুন
থিসিস লেখা হয়ে গেলে সেটিকে পেপারে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া খানিকটা সহজ। মূল লেখাটি লেখাই আছে, শুধু সেটিকে কেটে ছেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ে একতি পেপারে রূপ দিতে হবে। আপনার লেখা পেপারে কী কী পয়েন্ট থাকবে তা শুরুতে ঠিক করে নিন–
১. এবস্ট্রাক্ট
২. ইন্ট্রুডাকশন
৩. রিসার্চ মেথডস (ম্যাথমেটিকাল মডেলিং, এক্সপেরিমেন্টা ডিটেইলস)
৪. রেজাল্ট
৫. ডিসকাশন
৬.কনক্লুশন
৭. একনলেজমেন্ট
৮. রেফারেন্স
শুরুতে জার্নাল কিংবা কনফারেন্সে পেপার সাবমিশনের গাইডলাইন ভালোভাবে পড়ে নিন– যেমন, এবস্ট্রাক্ট কত শব্দের মধ্যে হতে হবে, ইমেজের সাইজ কেমন হবে, রেফারেন্সের নিয়ম ইত্যাদি। পেপারের টাইটেল এবং এবস্ট্রাক্ট এ দুটি লেখার পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করুন। শিরোনামটি যেন খুবই স্পেসিফিক হয় এবং এবস্ট্রাক্ট-এ সংক্ষেপে পেপারে মূল কী সমস্যা নিয়ে কাজ করা হয়েছে, কীভাবে করা হয়েছে এবং ফলাফল কী তা লিখতে হবে। এবস্ট্রাকট লেখার সময় লক্ষ্য রাখবেন যেন প্রাসংগিক কী-ওয়ার্ড ব্যবহার করা হয়। কেউ যদি আপনার রিসার্চের বিষয়টি নিয়ে কী-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ দেয় তাহলে আপনার পেপার এর তথ্য যেন শুরুর দিকেই আসে।
কোনো গল্পের শুরুটা যদি আকর্ষণীয় না হয়, তা যেমন গল্পের শ্রোতা কিংবা পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে না, পেপারের ভূমিকাও ঠিক তেমনই– এটি আপনার গবেষণার সম্পর্কে গল্প বলার প্রথম ধাপ। কাজেই ইন্ট্রুডাকশনে অবশ্যই আপনার কাজের পরিধি, গুরুত্ব, সমসাময়িক কাজের সাথে আপনার কাজের পার্থক্য, আপনি কোন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে কাজটি করেছেন এবং আপনার কাজের ফলাফল সবই সংক্ষেপে উল্লেক করা চাই। আর অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং প্রাসঙ্গিক যত বেশি পারা যায় সমসাময়িক গবেষণার কাজের রেফারেন্স দিয়ে তাদের সাথে আপনার কাজের পার্থক্যটা কোথায়, এবং কেন আপনার কাজ গুরুত্বপূর্ণ সেটি বলার চেষ্টা করবেন।
এরপর রিসার্চ মেথডলোজী, রেজাল্ট, ডিসকাশন এবং কনক্লুশন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আপনার থিসিস থেকেই পুরাটা কপি পেস্ট করতে পারেন, তবে একটু সংক্ষিপ্ত আকারে। এসব সেকশন কীভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এই সিরিজের প্রথম পর্বটি পড়ুন।
তবে রেজাল্ট ও ডিসকাশনে আপনার গ্রাফে সঠিকভাবে লিজেন্ডের ব্যবহার করবেন যাতে করে কেউ রেজাল্ট সেকশনের বর্ণনার সাথে গ্রাফকে সহজেই মেলাতে পারে। একটি গ্রাফে মাল্টিপল প্লট থাকে, ভিন্ন ভিন্ন কালার এবং ভিন্ন ভিন্ন লাইন টাইপ ও সিম্বল ব্যবহার করুন, এবং যখনই সেই গ্রাফও প্রদর্শিত ফলাফল নিয়ে লিখবেন তখনই গ্রাফের কোন লাইন, কোন সিম্বল কী ধরনের তথ্য রিপ্রেজেন্ট করে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিন। গ্রাফ এবং টেবিলের ক্যাপশনেও বিস্তারিত লিখুন।
একাধিক প্লট থাকলে কোন প্লট, কোন লাইন ইত্যাদি কী ধরনের তথ্য রিপ্রেজেন্ট করে তা লিখুন। টেবিলেও ঠিক একইভাবে বিভিন্ন কলামের হেডিং যথাযথভাবে লিখুন। যদি আপনার কাজ এক্সপেরিমেন্টাল হয় এবং তাতে যদি ভিন্ন ভিন্ন স্যাম্পল থাকে তাহলে পেপারে মূল বর্ণনা লেখার সময় সেইগুলোকে বিভিন্ন সাংকেতি নাম যেমন– AS001, AS002; এইভাবে চিহ্নিত করে টেবিলে স্যাম্পল ডিটেইলসের কলামে শুধু সাংকেতিক নামটি দিতে পারেন।
সবশেষে একনলেজমেন্ট এবং রেফারেন্স সেকশন। একনলেজমেন্টে আপনার গবেষণা কাজে কারা সাহায্য করেছে, কোনো সংস্থা যদি আপনার গবেষণার কাজটি স্পন্সর করে থাকে তাহল তাদের নাম এবং আপনার বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা যেই প্রতিষ্ঠানে থেকে আপনি এই কাজটি করেছেন তাদের কথা এই সেকশনে উল্লেখ করুন। আর রেফারেন্স সেকশনে আপনি যেসব পেপার থেকে সাহায্য নিয়েছেন তার সবগুলোর বিস্তারিত শিরোনাম উল্লেখ করুন।
প্রতিটি জার্নাল কিংবা কনফারেন্সের পেপারের রেফারেন্স সেকশন এর কিছু স্পেসিফিক ফরম্যাট থাকে– সেইটি অনুসরণ করুন। লেখা শেষ হয়ে গেলে, পুরো পেপারটি ভালোভাবে রিভিউ করুন– যাতে কোনো ধরনের ভূল না থাকে। প্রয়োজন হলে অন্তত দুই তিনজনকে পড়তে দিন– কারণ একজনের পড়ায় সব ভূল ধরা পড়ে না সাধারণত।
পেপার সাবমিশনের প্রক্রিয়া
আপনার পেপারটি প্রুফ রিড করা হয়ে গেলে যে জার্নালে কিংবা কনফারেন্সে সাবমিট করতে চান তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে একাউন্ট খুলে ফেলুন, এবং সকল অথর, আপনার এবং অন্যান্য অথরের ইন্সটিউশন, ইমেইল এড্রেস, অথর এর ক্রম, এবং করেসপন্ডিং অথরকে হবেন তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করুন। তবে সাবমিশনের সময় আপনাকে সবকিছু আলাদা আলাদাভাবে সাবমিট করতে হবে। যেমন– আপনার মূল লেখাটি একটি ওয়ার্ড ফাইলে, এরপর যদি টেবিল থেকে তাহলে তা অন্য একটি ডকুমেন্টে, সকলপ্রকার চিত্র কিংবা গ্রাফ পৃথকভাবে এবং সেই সাথে রেফারেন্স অন্য আরেকটি ওয়ার্ড ফাইলে সাবমিট করতে হবে। চিত্র কিংবা গ্রাফ কী ফরম্যাটে চায় সেটি ভালো করে দেখুন এবং সে অনুযায়ী আপনার পেপার এ বর্ণনার ক্রমানুসারে আপলোড করুন। যদি আপনার গ্রাফ .eps কিংবা .pdf ফরম্যাটে সাবমিট করে থাকেন তাহলে ভালো করে প্রিভিউতে দেখে নিন সবধরনের সিম্বল ঠিক মতো আছে কিনা।
সবকিছু ঠিক থাকলে একটি কভার লেটার লিখুন, যেখানে ফরমালি এডিটরকে আপনার পেপারটি পাবলিশ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটি লিখবেন, এবং এই কভার লেটারটি সহ আপনার পেপারটি সাবমিট করুন।
পেপার সাবমিশনের পর
ছেলে-মেয়ের মাঝে এংগেইজমেন্ট হলেই যেমন শতভাগ বিয়ের গ্যারান্টি থাকে না, ঠিক তেমনই পেপার সাবমিশন করলেই যে পেপার এক্সেপ্টেড হবে এমন কোনো গ্যারান্টি পাওয়া যায় না। পেপার সাবমিশন করা হলে, শুরুতে জার্নালের এডিটর কিংবা সংশ্লিষ্ট কেউ একবার টেকনিকাল চেক করেন– মূলত এখানে দেখা হয় পেপারের বিষয়বস্তু জার্নালের স্কোপের মাঝে পড়ে কিনা এবং জার্নালের গুণগত মানের সাথে পেপারের গুণগত মানের সামঞ্জস্যতা আছে কিনা। এডিটর যদি মনে করেন আপনার পেপার এই দুই ফিল্টারের মধ্য দিয়ে যেতে পারেনি, তাহলে শুরুতেই আপনাকে জানিয়ে দেবেন যে আপনার পেপারটি তাদের জার্নালে পাবলিশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রথম ধাপ যদি আপনার পেপার অতিক্রম করতে পারে, তাহলে আপনার পেপার রিভিউয়ার দের কাছে পাঠানো হবে। জার্নালগুলাতে সাধারণত রিভিউয়ারদের সাজেশন চাওয়া হয়– তবে আপনি রিভিউয়ার হিসেবে যাদের নাম দেবেন তাদের কাছেই যে এডিটর পেপারটা পাঠাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিছু কিছু রিভিউয়ার আছেন যারা কাজের ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে, তাদের কাছে পেপার পড়লে প্রশ্নবাণে তারা আপনাকে জর্জরিত করে ফেলবে। কিছু রিভিউয়ার একদম শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট– দেখা যাবে দুই থেকে তিনটি ছোট ছোট প্রশ্ন করে শেষে বলে দিয়েছে আপনার কাজটি ভালো হয়েছে। রিভিউয়ারদের রিভিউয়ের ধরনের উপর ভিত্তি করে আপনার পেপারটি পাবলিশ করা হবে কিনা তার চার ধরনের রিপ্লাই আপনি পেতে পারেন।
১. এক্সেপ্টেড
২. এক্সেপ্টেড উইথ মাইনর কারেকশন
৩. এক্সেপ্টেড উইথ মেজর কারেকশন
৪. রিজেক্টেড বা বাতিল
ধরলাম, আপনার পেপারটি তিনজন রিভিউয়ার রিভিউ করেছেন, যদি দুইজন মাইনর কারেকশন দেন আর একজন বলেন এক্সেপ্টেড তাহলে আপনি পড়ে যাবেন দুই নং ক্যাটাগরিতে– অর্থাৎ আপনার পেপারের সামান্য কিছু জায়গায় ঘষা মাজা করা লাগবে। যদি দুইজন মেজর কারেকশন দেন আর একজন মাইনর কারেকশন তাহলে আপনি পড়বেন তিন নং ক্যাটাগরিতে– এর মানে হলো আপনাকে অনেক জায়গায় রিভিউয়ারদের মতামত অনুযায়ী পরিবর্তন করতে হবে, এবং পুনরায় সাবমিশনের পর যদি রিভিউয়ারদের পছন্দ না হয় তাহলে আপনার পেপার বাতিল এর খাতায় ফেলে দেয়া হবে।
আপনি গবেষণার জগতে একদম নতুন, আন্ডারগ্র্যাড কিংবা গ্র্যাড স্টুডেন্ – এজন্য আপনি কোনো ছাড় পাবেন না। হ্যাঁ তবে ছাত্র হলে কনফারেন্সের প্রেজেন্টেশন গুলাতে লোকজন প্রশ্ন কম করে– এই যা সুবিধা। আপনি মেজর কারেকশন কিংবা মাইনর কারেকশন যেইটাই পান না কেন– আপনাকে রিভিউয়ারদের প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এজন্য যদি আপনার পেপারে নতুন কোনো গ্রাফ কিংবা ডাটা যুক্ত করার প্রয়োজন হয় তা-ই আপনাকে করতে হবে। অনেকসময় প্রফেসরদের পোস্ট ডক কিংবা পি এইচ ডি স্টুডেন্টরাও তাদের হয়ে আপনার পেপার রিভিউ করতে পারেন– এবং তাদের অভিজ্ঞতা কম থাকায় হয়তো অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নও করে বসতে পারে।
এক্ষেত্রেও ভদ্রভাবে উত্তর দিন– মনে রাখবেন, কোনোভাবে রিভিউয়ারকে আক্রমণ করা যাবে না। আর রিভিউয়ের প্রশ্নসমূহের জবাব আলাদা একটি ফাইলে জমা দিতে হয়। সেসব প্রশ্নের সাপেক্ষে আপনার পেপারে যদি নতুন কিছু যোগ করেন কিংবা পেপারের যে সেকশনের প্যারাতে সেই প্রশ্নের উত্তর আছে সেই প্যারাগুলো ভিন্ন ভিন্ন কালার দিয়ে হাইলাইট করেন এবং রেসপন্স লিস্ট এ সেইটি উল্লেখ করুন। আর যদি জার্নাল কোন কারণে রিজেক্ট হয় তাহলে আপনার কাজটি আবার রিভিউ করুন, কোনোকিছু পরিবর্তন করা দরকার হলে তা-ই করুন। এরপর অন্য কোনো জার্নালে পাঠিয়ে দিন, তা পাবলিশ করার জন্য।
Featured image: PhD Life