বিনা বাক্য ব্যয়েই একজন সাধারণ মানুষ বহু কথা বলতে পারে। ৪৩টি মৌখিক পেশির সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে সে দশ হাজারেরও বেশি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারে। সেই সাথে হাতের ইশারা, দেহভঙ্গি ও চোখের চাহনির মাধ্যমেও সে অসংখ্য ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। এসব নির্বাক মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ মুখ ফুটে বলা কথার চেয়েও বেশি অর্থপূর্ণ ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে।
কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন মানুষ লিখতে বসে। যখন সে কাউকে টেক্সট করে, মেইল করে, কিংবা দাপ্তরিক কাজের উদ্দেশ্যে কিছু লেখে, বারবার তাকে সঠিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটল কি না, এ নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হয়। লেখার শেষে ইমোজি, ‘হাহাহা’ বা ‘এলওএল’ ব্যবহার করায় পেশাদারিত্ব নষ্ট হবে কি না, কিংবা স্বল্প পরিচিত কাউকে মেসেজে চোখ টেপা বা জিভ বের করা ইমোজি পাঠানো অভদ্রতা হবে কি না, এরকম বিষয় নিয়ে তাকে নিত্য দোলাচলে দুলতে হয়। তবে অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির ব্যবহার নিয়ে মানুষকে অস্বস্তিতে ভুগতে হয়, সেটি হলো বিস্ময় চিহ্ন (!)।
অনেকেই জেনে বিস্মিত হতে পারেন, বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করা না করাকে কেন্দ্র করেও অনেকের সম্পর্কে ভাঙন ধরতে পারে! সেরকমই একটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছিলাম বিশ্ববিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘সেইনফিল্ড’-এর একটি পর্বে। এলেইনের বান্ধবী মায়রার বাচ্চা হয়েছে, ফোনে এ খবর পেয়ে সেটি কাগজে নোট করে রাখার সময় তার প্রেমিক শেষে বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করেনি কেন, এই নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত হয়, এবং একপর্যায়ে তাদের ব্রেক-আপও হয়ে যায়।
এলেইন: দেখেছো বিষয়টা? তুমি লিখেছো “মায়রার বাচ্চা হয়েছে” কিন্তু তুমি সেখানে বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করোনি।
জেক: তো?
এলেইন: কিছুই না, বাদ দাও। আমার কাছে স্রেফ বিষয়টাকে অদ্ভূত মনে হয়েছে।
জেক: এখানে অদ্ভূত মনে হওয়ার কী আছে?
এলেইন: বেশ, যদি তোমার কোনো ঘনিষ্ট বন্ধুর বাচ্চা হতো এবং আমাকে সেই মেসেজটি টুকে রাখতে হতো, আমি সেখানে একটা বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করতাম।
জেক: বেশ, আমি হয়তো তোমার মতো যত্রতত্র বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করি না।
এলেইন: তোমার কাছে কি মনে হয় না কারও সন্তান জন্মগ্রহণের খবর একটা বিস্ময় চিহ্নের দাবিদার?
জেক: অ্যাই, দেখো, আমি শুধু মেসেজটা টুকে রেখেছি। আমি জানতাম না আমাকে প্রতিটা কলের অনুভূতিও ধরে রাখতে হবে।
এলেইন: আমি শুধু ভেবেছিলাম আমার বন্ধুর বাচ্চা হওয়ার খবরে তুমি আরেকটু বেশি উত্তেজিত হবে।
জেক: আমি উত্তেজিত। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, আমি বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করি না।
এলেইন: ভালো তো, জেক। তোমার এখন থেকে ওগুলো ব্যবহার করা শিখতে হবে! এই যে এখন আমি যেভাবে কথা বলছি, আমি এই প্রতিটা বাক্যের শেষে বিস্ময় চিহ্ন বসাতাম! এই যে এটায়! এবং এটায়ও!
জেক: বেশ, তুমি এটার শেষেও বসাতে পারো — আমি চলে যাচ্ছি!
হ্যাঁ পাঠক, মানুষের জীবনে বিস্ময় চিহ্ন ঠিক এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু বিস্ময় চিহ্ন আসলে কী? কেন, কখন, কোথায়, কীভাবে এটি ব্যবহার করতে হবে? তাতে লাভটাই বা কী?
বিস্ময় চিহ্ন কী?
আন্তন চেখভের একটি গল্প আছে; নাম ‘দ্য এক্সক্লেমেশন মার্ক’। সেখানে আমরা দেখতে পাই, ইয়েফিম পেরেকলাদিন নামের এক স্কুল পরিদর্শক তার সহকর্মীর সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ার পর, তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, বিস্ময় চিহ্ন কেন কাজে লাগে। তার স্ত্রী বলে, এটা দিয়ে উল্লাস, ক্রোধ, আনন্দ, রাগ প্রকাশ করতে হয়। তখন সে উপলব্ধি করে, তার চল্লিশ বছরের চাকরি জীবনে সে এত এত দাপ্তরিক প্রতিবেদন লিখে এসেছে, কিন্তু কখনোই তার এসব আবেগের কোনোটি প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়েনি।
এরপর থেকে পেরেকলাদিন ক্রমাগত বিস্ময় চিহ্ন নিয়ে ভাবতে থাকে। সে যাকে বলে, পুরোপুরি অবসেসড হয়ে ওঠে এই বিস্ময় চিহ্নের ব্যাপারে। বিস্ময় চিহ্ন যেন তাকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে, তাকে উপহাস করে বলতে থাকে, তুমি মানুষ নও, তুমি যন্ত্র! তোমার মধ্যে কোনো আবেগ অনুভূতি নেই! এ কথা যে সত্য নয়, তা প্রকাশ করতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। একদিন এক ভিজিটর’স বুকে তার নাম স্বাক্ষর করার দরকার পড়ে। সেখানে সে নিজের নামের পাশে তিনটি বিস্ময় চিহ্ন বসিয়ে দেয়। এবং এই কাজের মাধ্যমে সে উল্লসিত অনুভব করে, সাথে ক্রুদ্ধও হয়। সে আনন্দিত হয়, পাশাপাশি রাগে ফেটেও পড়ে।
সুতরাং এ কথা তো এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে, বিস্ময় চিহ্নের কাজ হলো মানবীয় আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। কিন্তু কবে থেকে এর প্রচলন শুরু হলো?
যেভাবে প্রচলন শুরু হয় বিস্ময় চিহ্নের
খুব বেশিদিন আগের কথা নয় কিন্তু। বরং বেশ সাম্প্রতিক ঘটনাই বলা যায় এটিকে। চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইটালিয়ান কবি ইয়াকোপো আলপোলেইয়ো দা উরবিসাগলিয়া প্রথম বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করেন। তিনি ভাবাবেগপূর্ণ শব্দ বা বাক্যের শেষে এই চিহ্ন ব্যবহার করেন। প্রাথমিকভাবে তার সিদ্ধান্ত ছিল এমন যে, বিস্ময় চিহ্ন দিয়ে শেষ হওয়া শব্দ বা বাক্য অপেক্ষাকৃত উচ্চস্বরে বা জোর দিয়ে পড়তে হবে। তিনি এই চিহ্নের নাম দেন punctus exclamativus বা punctus admirativus। এভাবে কয়েকশো বছর বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার চলে।
১৭০০ সালের পর কোনো এক সময় স্প্যানিশরা এর দুটি নতুন সংস্করণ বের করে: কখনও তারা বিস্ময় চিহ্নটিকে উল্টে দিয়ে উপরে ফোঁটা ও নীচে দাঁড়ির মতো করে ব্যবহার করতে থাকে, আবার কখনও একটি শব্দের শুরুতে বিস্ময় চিহ্নটি উল্টোভাবে আর শেষে সোজাভাবে ব্যবহার করতে থাকে। মিশনারি ও ইউরোপীয় উপনিবেশিকদের হাত ধরে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, এবং সম্ভাব্য সকল ভাষার লিখিত রূপেই নতুন যতিচিহ্ন হিসেবে বিস্ময় চিহ্নের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। কিন্ত এর ফলে নতুন একটি সমস্যাও দেখা দেয়।
বিস্ময় চিহ্নকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সমস্যা
উনিশ শতকের শুরুর দিকে যখন প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় রচিত অন্যতম মাস্টারপিস ‘বেউলফ’ যখন আবিষ্কৃত হলো, তখন সম্পাদকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক দল চায় মহাকাব্যটির প্রথম শব্দ Hwæt এর পর বিস্ময় চিহ্ন বসাতে, আর অন্য দল চায় ফাঁকা রাখতে। শব্দটির অর্থ হলো শোনো, ঠিক যেভাবে চলতি ইংরেজি ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘Heyo!‘ বা ‘Yo!‘। যারা বিস্ময় চিহ্ন বসানোর পক্ষে ছিল, তাদের যুক্তি ছিল এমন যে, শব্দটি দ্বারা দৃষ্টি বা মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে, তাই এখানে বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করাই ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ (যেহেতু ততদিনে ইংরেজি ব্যাকরণও বিস্ময় চিহ্নকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে)।
কিন্তু এখানে বিষয়টি এতটা সোজাসাপ্টাও ছিল না। যেহেতু মহাকাব্যের একদম প্রথম শব্দেই বিস্ময় চিহ্ন বসবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, এর উপর পুরো কবিতার মেজাজও পুরোপুরি নির্ভর করত। মহাকাব্যটি যে আবৃত্তি করবে, সে যদি শুরুর ‘শোনো’ কথাটি অনেক জোর দিয়ে বলে, তার মানে সে খুবই উত্তেজিত। পরে পুরো মহাকাব্য জুড়েই তার সেই উত্তেজনা প্রবাহিত হবে, এবং সেই অনুযায়ীই কবিতার বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা দাঁড়া করাতে হবে। কিন্তু আসলেই কবিতার লেখক নিজে উত্তেজিত ছিলেন কি না, সেটি তো জানার কোনো উপায় নেই!
বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস-বৃদ্ধি
বর্তমান সময়ে কথাসাহিত্যে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার মোটামুটি একটি সহনশীল পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন কোনো কোনো লেখক খুব বেশি মাত্রায় বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করতেন, আবার কোনো কোনো লেখকের কাছে এটি ছিল দুই চোখের বিষ।
হারমান মেলভিল (১৮১৯-১৮৯১) বিস্ময় চিহ্নকে ব্যবহার করেছিলেন আবেগ প্রকাশের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে। তার শ্রেষ্ঠ রচনা ‘মবি ডিক’-এ তিনি ১,৬৮৩ বার বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু বিংশ শতকের শুরুর দিক থেকেই বিস্ময় চিহ্নের কদর কমতে থাকে। এর পেছনে প্রধানত দায়ী ছিল সংবাদপত্র। হলুদ সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা তাদের কাগজের কাটতি বাড়ানোর উদ্দেশে, যেকোনো সাধারণ সংবাদকে অতিরঞ্জিত করতে শুরু করে, এবং সেগুলো যেন মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় তা নিশ্চিত করতে শিরোনামে যথেচ্ছ বিস্ময় চিহ্ন প্রয়োগ করতে থাকে। প্রথম প্রথম এই ফন্দিতে কাজ হলেও, একপর্যায়ে পাঠকরা বিরক্ত হয়ে ওঠে, সংবাদ শিরোনামে বিস্ময় চিহ্ন দেখলেই মনে করতে থাকে নির্ঘাত এই সংবাদের পুরোটা সত্য নয়। এই কারণেই, আজও বিশ্বের অনেক সংবাদপত্রের শিরোনামেই এমনকি দরকার থাকা সত্ত্বেও বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া হয়।
বিস্ময় চিহ্নের দরপতনের আরেকটি কারণ বিভিন্ন আবেগবহুল উপন্যাসে এর খুব বেশি মাত্রায় ব্যবহার। এরকম একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন মিসেস সাউথওর্থ (১৮১৯-১৮৯৯)। তার ‘হার মাদার’স সিক্রেট’ উপন্যাসে বিস্ময় চিহ্ন ছিল ১,৮৩৪টি। আর ‘হিডেন হ্যান্ড’ উপন্যাসে ১,৫৮০টি। লেবু বেশি কচলালে যেমন তেতো হয়ে যায়, বিস্ময় চিহ্নের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই হয়েছিল। বিশেষ করে নারী ঔপন্যাসিকদের রচনায় বিস্ময় চিহ্ন বেশি থাকত বলে, এবং সেখানে যেকোনো ছোটখাট আবেগের বহিঃপ্রকাশেই বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহৃত হতো বলে, একশ্রেণীর পাঠকগোষ্ঠী ও সমালোচকের উদ্ভব ঘটে, যারা বিস্ময় চিহ্নকে ‘মেয়েলী’ ও ‘নারীসুলভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। তাদের মতে, কোনো পুরুষ ঔপন্যাসিকের লেখাতেই অতিরিক্ত বিস্ময় চিহ্ন থাকা উচিৎ না।
যে সময়ের কথা বলছি, তখনকার সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের একজন ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১), এবং ঘটনাক্রমে তিনি ব্যক্তিজীবনে ও তার সৃষ্টিকর্মে যেমন পুরুষালি ছিলেন, তেমনই তার রচনায়ও বিস্ময় চিহ্ন থাকত একেবারেই কম। ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’ উপন্যাসে কয়টি বিস্ময় চিহ্ন ছিল, জানেন? মাত্র একটি!
হেমিংওয়ের প্রভাব পড়েছিল তার সমসাময়িক এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের উপরও। শুরুতে তিনি অনেক বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করলেও, একসময় তাতে রাশ টানেন। তার ‘টেলস ফ্রম দ্য জ্যাজ এজ’ উপন্যাসে বিস্ময় চিহ্ন ছিল ৫৪৪টি, কিন্তু ‘টেন্ডার ইজ দ্য নাইট’-এ তা কমে দাঁড়ায় ২৪৮টি। শুধু বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহারই কমিয়ে দেননি তিনি, এর উপর এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে একবার তিনি বলেছিলেন, “সব বিস্ময় চিহ্ন কেটে দাও। বিস্ময় চিহ্ন অনেকটা যেন নিজের কৌতুকে নিজেই হাসা।“
এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের দিনের লেখকদের মাঝেও জারি রয়েছে। বেশিরভাগ লেখকই মনে করেন, বিস্ময় চিহ্নের কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই, এটি অহেতুক লেখার সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক গতিকে ব্যহত করে। লেখক যদি এমনভাবে একটি লেখা লিখতে পারেন যে পাঠক এমনিতেই সেটির মাঝে ডুবে যাবে এবং সেই লেখার সকল আবেগকে নিজে থেকেই ধরতে পারবে, তাহলে আর আলাদা করে বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করে কেন পাঠককে বুঝিয়ে দিতে হবে লেখার কোথায় মেজাজ কেমন? এভাবেই কথাসাহিত্যে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার একেবারেই কমে এসেছে। কেবলমাত্র এড়ানো যায় না এমন জায়গাতেই বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহারের চেষ্টা করেন লেখকরা।
বিজ্ঞাপনশিল্পে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার
তবে কথাসাহিত্যে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার কমে গেলে কী হয়েছে, একে উদারহস্তে গ্রহণ করেছে অন্য একটি শিল্প: বিজ্ঞাপন শিল্প। পত্রিকার সম্পাদকরা যেমন পাঠকের নজর কাড়তে শিরোনামে বিস্ময় চিহ্ন বসাতেন, সেই দেখাদেখি বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করতে শুরু করে বিজ্ঞাপনদাতারাও। তাদেরও বিশ্বাস, একটি বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করলেই পাঠকের আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তাই ১৯৩০’র দশকের তুলনায় ১৯৪০ ও ৫০’র দশকে সংপাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবধান বেড়ে দ্বিগুণ হয়।
ইন্টারোব্যাং
বিজ্ঞাপনে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার যখন তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়ই বিস্ময় চিহ্নের ইতিহাসে ঘটে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন। উদ্ভব ঘটে ‘ইন্টারোব্যাং’ (Interrobang) এর। ভাবছেন সেটি আবার কী জিনিস? খুবই সহজ। পাশাপাশি প্রশ্নবোধক চিহ্ন ও বিস্ময় চিহ্ন দেখেছেন কখনও? সেটির কথাই বলছি। জিনিসটি এমন: “?!” তবে শুরুতে প্রশ্নবোধকের উপর বিস্ময় চিহ্ন আকারে, কিংবা দুটি একসাথে মিলে একটি নতুন রূপে ব্যবহৃত হতো।
Interrogation এর Interro এবং কমিক বুকে বহুল প্রচলিত স্ল্যাং টার্ম Bang মিলিত হয়ে গঠন করেছে Interrobang। বিস্ময়মিশ্রিত প্রশ্ন উত্থাপনের ক্ষেত্রে এই বিশেষ চিহ্নটি ব্যবহার করা হয়, যা শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে, একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধান মার্টিন স্পেকটারের হাত ধরে। কেবল পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেই এটি এক নতুন মাত্রা যোগ করে না, পাশাপাশি এর বহুল প্রচলন শুরু হয় অন্যান্য জায়গায়তেও। খুব দ্রুতই এটি এত বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, সেই সময়ের জনপ্রিয় ইংরেজি ফন্ট ‘আমেরিকানা’য় এই চিহ্নটি যোগ করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন টাইপরাইটারেও এই চিহ্নের সংযোজন ঘটে।
বিস্ময় চিহ্নের আরও কিছু রূপ
ইন্টারোব্যাংয়ের পর বিস্ময় চিহ্নের আরও নতুন কিছু রূপের আবির্ভাব ঘটে ১৯৬৬ সালে, ফরাসি লেখক হেরভে বাজিনের মাধ্যমে। Acclamation Point দিয়ে কাউকে স্বাগত বা শুভকামনা জানানো শুরু হয়, নিঃসন্দেহভাবে কিছু বলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় Conviction Point, এবং কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত জানানোর ক্ষেত্রে Authority Point।
তবে বর্তমান সময়ে উপরের চারটি চিহ্নের কোনোটিরই খুব একটা জনপ্রিয়তা নেই। ব্যাকরণগত দিক থেকে, এবং দৈনন্দিন লিখিত আলাপচারিতায়, আদি ও অকৃত্রিম বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহারই অব্যহত রয়েছে। এবং বর্তমান সময়ে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছু ধারণাও গড়ে উঠেছে।
বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহারের প্রচলিত ধারণা
নারীরা পুরুষদের চেয়ে বিস্ময় চিহ্ন বেশি ব্যবহার করে। ২০০৬ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছিল, মেইল লেখার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করে, এবং এর পেছনে মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে নিজেদেরকে বন্ধুভাবাপন্ন প্রকাশ করা। তাছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, নারীরা যত সহজে যেকোনো বিষয়ে নিজেদের আবেগ প্রকাশ করতে চায়, পুরুষেরা তা চায় না। এজন্য তারা নারীদের মতো অত বেশি বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করে না। ঠিক একইভাবে ২০১২ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি ইমোটিকন ব্যবহার করে, এবং ২০০৯ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, নারীদের মধ্যে একটি বাক্য বা শব্দকে বেশি ফোকাস করতে বড় হাতের অক্ষর দিয়ে লেখা, বা শব্দের শেষ অক্ষরটি একাধিকবার ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন অনেক নারীই লিখে থাকেন, I love ONLY YOU কিংবা I love youuuuu…
এছাড়া অনেকের কাছেই মনে হয়, বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার না করলে লিখিত আলাপনে আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। ধরুন, আপনি সামনাসামনি কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরে খেতে যাবে? সে উত্তরে মুখে যা বলল, এর পাশাপাশি তার মৌখিক অভিব্যক্তি দেখেই আপনি বুঝে যাবেন, সে আসলেই যেতে ইচ্ছুক কি না। কিন্তু যদি কথাবার্তা সব চ্যাটিংয়ে হয়:
You: Wanna go for lunch?
She: Yeah.
এখান থেকে কিন্তু তার মনের অনুভূতি সম্পর্কে আপনি কিছুই আঁচ করতে পারলেন না। আপনি ভাবতে শুরু করলেন, হয়তো সে আসলে যেতে ইচ্ছুক না, কেবলই ভদ্রতা করে বা আপনাকে আঘাত করতে চায় না বলে হ্যাঁ বলেছে। কিন্তু এই ধরনের কোনো সমস্যাই আর থাকতো না, যদি সে হ্যাঁ বলার পর এক বা একাধিক বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করত। সেক্ষেত্রে আলাপটি হতো এমন:
You: Wanna go for lunch?
She: Yeah!
পেশাদার মেইলেও বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার নিয়ে নারী-পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যদি একজন পুরুষের কাছে একটি পেশাদার মেইল আসে তার কোনো নারী সহকর্মীর কাছে, এবং সেখানে বিস্ময় চিহ্নের উপস্থিতি থাকে, তাহলে ৪৯% পুরুষই মনে করে এটি পেশাদারিত্বেরই অংশ। কিন্তু মেইল প্রেরক যদি কোনো পুরুষ সহকর্মী হয়, তাহলে মাত্র ৩৬% পুরুষের কাছে সেটিকে পেশাদারী আচরণ বলে মনে হয়।
বিস্ময় চিহ্ন একটি ব্যবহার করা হবে নাকি একাধিক, এর উপরও অনেক কিছুই নির্ভর করে। ধরুন আপনাকে কেউ এমন কিছু জিজ্ঞেস করল যার উত্তর হ্যাঁ-তে হবে। আপনি যদি লেখেন, Yeah!, তাহলে সব ঠিকঠাক মনে হবে। কিন্তু আপনি যদি লেখেন, Yeah!!!, তাহলে অপর প্রান্তের মানুষটির মনে হতেই পারে, আপনি হয়তো তার সাথে মজা বা সারকাজম করছেন। অনেকে আবার একাধিক বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহারকে ছেলেমানুষি বলেও মনে করে। ভাবে, আপনি হয়তো চিৎকার করছেন।
শেষ কথা
সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন, বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহারকে আপনি এতদিন যতটা সাদামাটা ভেবে এসেছেন, এটি মোটেই ততটা সাদামাটা নয়, বরং অনেক বেশি জটিল। এই পুরো লেখা পড়ে আসার পরও হয়তো আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না যে, পরবর্তীবার আপনার ভালোবাসার মানুষকে মেসেজ দেয়ার সময় আপনার বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করা উচিৎ হবে কি না, কিংবা কোনো ফরমাল চিঠিতে আপনি বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করবেন কি না। কারণ এটি এমন একটি রহস্য যা চিরকাল বজায় থাকবে। আপনি কেবল নিজের বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিস্ময় চিহ্নের পরিমিত কিন্তু কার্যকর প্রয়োগ ঘটাতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনার প্রতি খুব সহজ একটি উপদেশ থাকবে: যেখানে নিজেকে আন্তরিক বা বন্ধুভাবাপন্ন দেখানো জরুরি, সেখানে বিস্ময় চিহ্ন ব্যবহার করুন; কিন্তু যেখানে আপনার সিরিয়াস হওয়া দরকার, সেখানে সিরিয়াসই থাকুন, বিস্ময় চিহ্ন নয়, বরং দাঁড়ি বা প্রশ্নবোধকই ব্যবহার করুন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/