বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন এই একটি দিনের জন্য। নিজের পছন্দের মুভিটা মনোনয়নের তালিকায় থাকুক বা না থাকুক, সবারই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থাকে এই অনুষ্ঠানে। আর এবারের অস্কারকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ যেন একটু বেশিই ছিল, কেননা সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা পরিচালকের মনোনয়নের তালিকায় আছেন সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিভাদের কয়েকজন।
বরাবরের মতোই হলিউডের ডলবি থিয়েটারে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পুরষ্কার বিতরণী হয়ে গেল। আগে থেকে কিছু নাম অনুমিত থাকলেও অনুষ্ঠানটি একঘেয়ে হয়নি মোটেই। অস্কারের এত বছরের ইতিহাসে যা ঘটতে দেখা যায়নি, সেরকম একটা ঘটনাই ঘটে গেছে ৯ই ফেব্রুয়ারি। ৯২তম অস্কার অনুষ্ঠানে যারা বিজয়ী হয়েছেন, তাদের জয়ের কারণগুলো নিয়ে রোর বাংলার আজকের এই আয়োজন।
সেরা চলচ্চিত্র
সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরষ্কারটি সবসময়ে জমিয়ে রাখা হয় শেষ মুহূর্তের জন্য, আর এবারের অস্কারের শেষ মুহূর্তটি আক্ষরিক অর্থেই একটা দক্ষিণ কোরিয়ান টুইস্ট উপহার দিলো বিশ্ববাসীকে। মূলত হলিউডকেন্দ্রিক অস্কার প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের মুভিকে পুরষ্কার দেয়া শুরু করে ১৯৪৭ সালে। তারপরে বিদেশী ভাষার কিছু চলচ্চিত্র মূল বিভাগে মনোনয়ন পেলেও হলিউডকে টপকাতে পারেনি। ৭৩ বছরে এই প্রথম সেই প্রথা ভাঙলো দক্ষিণ কোরিয়া, বং জুন-হো তার জাদুকরী প্রতিভায় জিতে নিলেন সেরা চলচ্চিত্রসহ চারটি অস্কার। ‘প্যারাসাইট’কে জিততে দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন বটে, কিন্তু অসন্তুষ্ট বলা যাবে না কাউকেই। এ বিভাগে মনোনীত অন্যান্য চলচ্চিত্র ছিল ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি, ১৯১৭, ম্যারেজ স্টোরি, জোকার, ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন হলিউড, দ্য আইরিশম্যান, জোজো র্যাবিট এবং লিটল উইমেন। এবং নিঃসন্দেহে গেলো কয়েক বছরের তুলনায় এবছরের ফ্রন্টরানার মুভিগুলো ছিল নিজস্ব মহিমায় অনন্য।
তবে এই অসাধারণ মুভিগুলোর সাথে লড়াই করলেও এ বছরের সবচেয়ে বেশি অ্যাওয়ার্ডজয়ী মুভিটি কিন্তু ছিল ‘প্যারাসাইট’ই। বাধ সাধছিল কেবল অস্কারের সংকীর্ণমনা ইতিহাস। বং জুন-হো তো সরাসরি বলেই দিয়েছিলেন যে, অস্কার কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা নয়, তারা স্থানীয় হলিউডের মুভিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ কোরিয়ান থ্রিলার মুভিগুলোর বিশ্বজনীন প্রভাব অনস্বীকার্য, ‘প্যারাসাইট’ এর জয়ের মাধ্যমে এই ইন্ডাস্ট্রির অন্যান্য সেরা মুভিগুলোও একটা স্বীকৃতি পেয়ে গেল তাই অবশেষে। সেরা চলচ্চিত্র এবং বিদেশী ভাষার সেরা চলচ্চিত্র দুই বিভাগই একইসাথে জয় করে মোট ৪টি অস্কার নিয়ে নিরষ্কুশভাবে বছরের সেরা চলচ্চিত্রের স্বীকৃতি পেয়ে গেলো মুভিটি। স্যাম মেন্ডেসের ‘১৯১৭’-কে নিশ্চিত বাজি ধরে রেখেছিলেন অনেকেই, তবে কেবল টেকনিক্যাল বিভাগগুলোর তিনটি অস্কার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে একে।
সেরা পরিচালক
এ বিভাগে প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান হিসেবে জিতে নিয়েছেন বং জুন-হো। এ বিভাগে মনোনীত অন্যরা ছিলেন মার্টিন স্করসেজি, স্যাম মেন্ডেস, কোয়েন্টিন টারান্টিনো এবং টড ফিলিপ্স। বিশেষ করে মার্টিন স্করসেজি আর কোয়েন্টিন টারান্টিনোর মতো মায়েস্ত্রোকে পেরিয়ে পুরস্কার জেতাটা অবিশ্বাস্য ছিল জুন-হোর কাছেও। স্করসেজির কাছ থেকেই তার চলচ্চিত্র দীক্ষাপ্রাপ্তি বলে দাবি করেছেন নিজের অস্কার স্পিচে। টারান্টিনো নিজেও তার বিশাল সমর্থক। সেই ২০১৩ সালের দিকেই জুন-হোকে নিজের প্রিয় কোরিয়ান পরিচালক বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
কোরিয়ান থ্রিলারের পথিকৃৎ কিম কি দিউক কিংবা কিম হিউন জুং এর পথ ধরে আসা পরিচালকের সামর্থ্য নিয়ে এখন অবশ্য সন্দেহ নেই কারো। তার অন্য কাজগুলোও কিন্তু ‘প্যারাসাইট’ এর চেয়ে পিছিয়ে নেই। কুশলী ট্র্যাকিং শট আর স্যাটায়ারধর্মী কাহিনী তার মূল শক্তি হলেও বিভিন্ন জনরা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে কখনো পিছিয়ে যাননি তিনি।
২০০৬ সালে ‘দ্য হোস্ট’ নির্মাণের সময়ে উচ্চাভিলাষী স্পেশাল ইফেক্টের কাজ নিয়ে ভারি ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু পিছিয়ে যাননি। সেই থেকেই ২০১৩ সালে রেভল্যুশনধর্মী ডিস্টোপিয়ান সাইফাই ‘স্নোপিয়ার্সার’ এর দায়িত্ব পেয়ে যান তিনি। আর ‘মেমোরিস অফ মার্ডার’ তো সিরিয়াল কিলারধর্মী মুভিগুলোর মধ্যে আইকনিক মর্যাদা পেয়েই গেছে। এ সবগুলো কাজগুলোই তার অস্কার জয়ের পথটা সুগম করে এসেছে এতদিন ধরে।
সেরা অভিনেতা
অ্যাওয়ার্ড মৌসুমে এ পর্যন্ত সব জায়গাতেই পুরস্কার জিতে নেয়া হোয়াকিন ফিনিক্সের অস্কার জয় অবধারিতই ছিল বলা যায়। তবে এই জয়ও গড়েছে নতুন ইতিহাস। এই প্রথম কোনো কমিক বইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে কেউ সেরা অভিনেতার অস্কার জয় করলেন। ২০০৮ সালে জোকারের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সহ-অভিনেতা বিভাগে হিথ লেজারের অস্কারজয়ের কথা প্রায় সকল মুভিপ্রেমীরই জানা। ‘দ্য গডফাদার’ এর পরে এই প্রথম একই চরিত্রে অভিনয় করে ভিন্ন দুই অভিনেতা অস্কার জিতলেন। এর আগে রবার্ট ডি নিরো এবং মারলোন ব্র্যান্ডো দুজনই ভিটো করলিয়নের ভূমিকায় অভিনয় করে এই সম্মাননা পেয়েছিলেন।
এ বছর ফিনিক্সের জয়জয়কার হলেও এ পর্যন্ত আসার পথ তার সুগম ছিল না। ‘গ্লাডিয়েটর’, ‘ওয়াক দ্য লাইন’, ‘দ্য মাস্টার’ দিয়ে তিনবার মনোনীত হয়েছিলেন এর আগে। মাঝে অভিনয়ে বিরতি নিলেও ফিরে আসেন ভালোভাবেই। এ সময়কার অন্যতম প্রতিভাবান অভিনেতাদের একজন হিসেবে সবাই মানেও তাকে, কিন্তু কিছুটা আন্ডাররেটেডই রয়ে যাচ্ছিলেন। হিথের অমর পোর্ট্রেয়ালের পরে জোকারের ভূমিকায় ভালো পারফরম্যান্স দেয়ার প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। সেই ভার তিনি বহন করেছেন ৫২ পাউন্ড ওজন কমিয়ে। নিজের অনুপ্রেরণা, অকালপ্রয়াত ভাই রিভার ফিনিক্সের কথাও স্মরণ করেছেন তিনি। সেরা অভিনেতা বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন অ্যাডাম ড্রাইভার, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, অ্যান্টনিও ব্যান্ডেরাস এবং জোনাথন প্রাইস। দীর্ঘ ক্যারিয়ার বিবেচনায় ফিনিক্সই জয়ী, এর সাথে দ্বিমত করার উপায়ও নেই খুব একটা। তবে পর পর দু’বছরে দুবার মনোনয়ন পাওয়া ড্রাইভার হয়তো অচিরেই জেতার আরেকটা সুযোগ পেয়ে যাবেন।
সেরা অভিনেত্রী
সেরা অভিনেত্রী বিভাগে পুরস্কারটি জিতে নিয়েছেন রেনে জেলওয়েগার। ঠিক হোয়াকিনের মতোই রেনে জেলওয়েগার হলিউডের প্রধান সবক’টি অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছেন এই মৌসুমে। এর আগে ‘কোল্ড মাউন্টেন’ এর জন্য সেরা সহ-অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন তিনি ২০০৪ সালে। তার আগে অস্কারজয়ী মিউজিক্যাল ‘শিকাগো’তে অভিনয় করেও সাড়া ফেলেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তার সময় কিছুটা খারাপই যাচ্ছিলো। ব্যক্তিগত জীবন থেকেই অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন হলিউড অভিনেত্রী জুডি গারল্যান্ডের জীবন।
হলিউড ক্লাসিক ‘উইজার্ড অফ অজ’ এর ডরোথি, জুডির নিজের জীবনটা একটুও বর্ণিল ছিল না। অ্যালকোহল আর ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়া একাকী জুডি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন সন্তানদের থেকে, অর্থনৈতিক সংকটও ছিল চরমে। মেকআপের আড়ালে তার ভঙ্গুর মূর্তি নিখুঁতভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন রেনে। এ বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন স্কারলেট জোহানসন, সার্শা রোনান, চার্লিজ থেরন এবং সিনথিয়া এরিভো। তার জোর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সার্শা এবং স্কারলেট। একইসাথে সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা সহ-অভিনেত্রীর ভূমিকায় অস্কার মনোনয়ন পাওয়া স্কারলেটের জীবনের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স ছিল ‘ম্যারেজ স্টোরি’ মুভির নিকোল চরিত্রটি। ক্যারিয়ারের জন্য, কিংবা নিজের অস্তিত্বকে জাগিয়ে তোলার জন্য সংসার ভাঙতে বাধ্য হওয়া নিকোলের সূক্ষ্ণ আবেগগুলো প্রত্যেকেরই হৃদয় স্পর্শ করেছে।
সেরা সহ-অভিনেতা
এ বিভাগে যে ‘ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন হলিউড’ এর ব্র্যাড পিট জিতবেন, তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলেন সবাই। এ বিভাগে মনোনীত বাকি চারজনই অস্কারজয়ী- টম হ্যাঙ্কস, আল পাচিনো, জো পেসি এবং অ্যান্থনি হপকিন্স। প্রায় ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারে বহু স্মরণীয় চরিত্রে আমাদের উপহার দিলেও অভিনেতার অস্কারটি অজ্ঞাত কারণে তার হাতে ধরা দেয়নি এতদিন।
দুর্ভাগ্যবশত তার প্রতিভা প্রায়ই চাপা পড়ে যেত তার স্টারডমের আড়ালে। অথচ, শুধু ‘ফাইট ক্লাব’, ‘অ্যাসাসিনেশন অফ জেসি জেমস’ কিংবা ‘কিউরিয়াস কেস অফ বেঞ্জামিন বাটন’ এর মতো মুভি না, ‘স্ন্যাচ’ কিংবা ‘টুয়েলভ মাংকিজ’ এর মতো মাল্টিস্ট্যারার মুভিগুলো দিয়েও অস্কার জেতার সামর্থ্য রাখতেন তিনি। যা-ই হোক, হলিউডের এই পোস্টার বয়কে অবশেষে অস্কার এনে দিলো হলিউডকেন্দ্রিক নস্টালজিয়া ফ্লিকটি। জেতার পরে জানিয়েছেন, আপাতত ঘন ঘন অভিনয় একটু কমিয়ে দেবেন তিনি, মুভি নির্মাণের প্রতি বেশি নজর দেবেন এবার।
সেরা সহ-অভিনেত্রী
এ বিভাগের পুরষ্কারটি জিতে নিয়ে নিজের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে নিয়েছেন লরা ডার্ন। সাম্প্রতিককালে ‘বিগ লিটল লাইজ’ দিয়ে এমি জিতে নেয়া লরা তার অস্কারটি বাগিয়েছেন ‘ম্যারেজ স্টোরি’ মুভিতে স্বার্থান্বেষী লয়্যারের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য। মুভিটিতে ডিভোর্স নিতে যাওয়া স্বামী-স্ত্রীর কাউকে নেতিবাচক আলোকে দেখানো হয়নি। তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কীভাবে ডিভোর্স লয়্যারেরা পকেট ভারি করে নেয়, সেটাই দেখানো হয়েছে।
আর সেরকম একজন নির্দয় লয়্যারের ভূমিকায় লরা ছিলেন অনন্য। তার চরিত্রে যতবার স্ক্রিনে উপস্থিত হয়েছে, ততবারই মনোযোগ দখল করে নিয়েছে। এ বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন মার্গো রবি, স্কারলেট জোহানসন, ফ্লোরেন্স পাফ এবং ক্যাথি বেটস। বিশেষ করে ‘লিটল ড্রামার গার্ল’ আর ‘মিডসমার’খ্যাত ফ্লোরেন্স পাফের বেশ বড় সম্ভাবনা ছিল। মনে দাগ কাটার মতো অভিনয় করেছেন তিনি ‘লিটল উইমেন’ এ। বিয়ে যে আসলে একটা অর্থনৈতিক চুক্তি, সে বিষয়ে তার মনোলগটি ছিল মুভির হাইপয়েন্টের একটি। ভবিষ্যতে হয়তো তারও সুসময় আসবে।
সেরা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র
এ বিভাগে জিতে নিয়েছে ডিজনির ‘টয় স্টোরি ফোর’। গত বছরের অস্কারজয়ী ‘স্পাইডারম্যান: ইনটু দ্য স্পাইডার-ভার্স’ এর কথা মনে আছে? মুভিটির অ্যানিমেশন এতই অভিনব ছিল যে কমিক বইয়ের ইলাস্ট্রেশন বলে ঠাহর হচ্ছিলো। সেক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে সুপরিচিত এই ফ্র্যাঞ্চাইজ মুভিটি। ভুল বুঝবেন না, টয় স্টোরি সিরিজ আমাদের সবারই প্রিয়। ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম মুভিটি ছিল সর্বপ্রথম থ্রিডি অ্যানিমেশন মুভি। ‘টয় স্টোরি’, ‘শ্রেক’, ‘ফাইন্ডিং নেমো’ এই মুভিগুলোই আধুনিক থ্রিডি অ্যানিমেশনের পথ করে দিয়েছে।
টম হ্যাঙ্কস, টিম অ্যালেনের কণ্ঠে উডি আর বাজের বন্ধুত্ব নিঃসন্দেহে মন জয় করে নেয় সবার। কয়েকটা খেলনার জীবনকাহিনী হলে কী হবে, তৃতীয় পর্বের শেষটা দেখে আবেগতাড়িত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু চতুর্থ পর্বটি ততটা আশা মেটাতে পারেনি, অযথা কাহিনী টেনে ফ্র্যাঞ্চাইজের নাম দিয়ে টাকা আয়ের সহজ উপায় মনে হয়েছে একে। কাহিনীর দিক নেটফ্লিক্সের দুই টুডি অ্যানিমেশন প্রজেক্ট ‘ক্লস’ এবং ‘আই লস্ট মাই বডি’ দুটোই ছিল অনেকাংশে এগিয়ে। আগে ডিজনিতে কাজ করা সের্গিও পাবলো তার গল্প বলার গাঁথুনি আর মনোমুগ্ধকর অ্যানিমেশন দিয়ে মন জয় করেছেন সবার। এদিকে সবার নজরের কিছুটা আড়ালে থাকা ফরাসি অ্যানিমেশন ‘আই লস্ট মাই বডি’ তার ভিন্নধর্মী অস্তিত্ববাদের কাহিনী দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। হয়তো অ্যাকাডেমির সাথে নেটফ্লিক্সের দ্বন্দ্ব কিছুটা হলেও এই সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে।
সেরা চিত্রনাট্য (অরিজিনাল)
এ বিভাগে অনুমিতভাবেই ‘প্যারাসাইট’ মুভির জন্য অস্কার জিতে নিয়েছেন বং জুন-হো এবং হা জি ওন।
এই বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন কোয়েন্টিন টারান্টিনো (ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন হলিউড), নোয়া বমব্যাখ (ম্যারেজ স্টোরি), রিয়ান জনসন (নাইভস আউট), স্যাম মেন্ডেজ, ক্রিস্টি উইলসন-কার্নস (১৯১৭)। নিঃসন্দেহে প্রতিটি কাহিনীই অতুলনীয়, কিন্তু কোরিয়ানদের জনরা-বেন্ডিং কাহিনীর কাছে অন্যগুলো একটু পিছিয়ে গেছে।
শ্রেণীবৈষম্যমূলক চমকপ্রদ এই স্যাটায়ার চমক দিয়েছে প্রতিটি অঙ্কে। প্রথমদিকে হাইস্ট কমেডি, তারপরে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার আর শেষে এসে স্ল্যাশারে রূপ নিয়ে দারুণ এক এক্সপেরিমেন্টের সফল প্রতিফলন হলো ‘প্যারাসাইট’। এই বিভাগেও অস্কার পেয়ে আরেকটি দুর্দান্ত রেকর্ড গড়লেন জুন হো। একই বছর চারটি অস্কার জেতার কৃতিত্ব এর আগে দেখাতে পেরেছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি।
সেরা চিত্রনাট্য (অ্যাডাপ্টেড)
এ বিভাগে ‘জোজো র্যাবিট’ এর জন্য জিতে নিয়েছেন তাইকা ওয়াইতিতি। নিউজিল্যান্ডের এই পরিচালক ‘হান্ট ফর দ্য ওয়াইল্ডারপিপল’, ‘হোয়াট উই ডু ইন দ্য শ্যাডোজ’ দিয়ে নিজের প্রতিভার জানান দিলেও বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান মার্ভেলের ‘থর রাগনারক’ পরিচালনা করে। খুব দ্রুতই তার বিচিত্র হিউমারের ধরন মন জয় করে নেয় সবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস কিংবা সিনেমার সংখ্যা অগণিত। সেই ভয়াল সময়কে ঘিরে শিশুতোষ ফ্যান্টাসির আড়ালে দারুণ এক অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী লিখেছেন ওয়াইতিতি। অস্কারজয়ী প্রথম মাওরি মুভিনির্মাতা তিনি, নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের এই গর্বিত সদস্য অস্কারটি উৎসর্গ করেছেন বিশ্বের সকল আদিবাসীর উদ্দেশ্যে।
এই বিভাগে মনোনীত অন্যরা ছিলেন গ্রেটা গারউইগ (লিটল উইমেন), টড ফিলিপস, স্কট সিলভার (জোকার), অ্যান্থনি ম্যাককার্টেন (দ্য টু পোপস) এবং স্টিভেন জাইলিয়ান (দ্য আইরিশম্যান)। সত্য ঘটনাকে মুভির স্বল্প পরিসরে ফুটিয়ে আনা হয়েছে ‘দ্য টু পোপস’ এবং ‘দ্য আইরিশম্যান’ মুভি দুটোয়। ‘লিটল উইমেন’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে আরো একবার সেলুলয়েডের পর্দায় জীবন্ত করেছেন গ্রেটা গারউইগ। কমিক বইয়ের সুপারভিলেনের চরিত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন টড ফিলিপস এবং স্কট সিলভার। তবে ইদানীংকালে বিনোদন জগতে অনন্য প্রভাব ফেলার কারণেই হয়তো তাইকা একটু এগিয়ে গিয়েছেন অন্যদের চেয়ে।
সেরা চিত্রগ্রহণ
এ বিভাগে ‘১৯১৭’ মুভির জন্য ভিজুয়াল মাস্টারমাইন্ড রজার ডিকিন্স জিতে নিয়েছেন তার দ্বিতীয় অস্কার। ‘অ্যাসাসিনেশন অফ জেসি জেমস’, ‘স্কাইফল’, ‘শশ্যাঙ্ক রেডেম্পশন’, ‘সিকারিও’, ‘বার্টন ফিঙ্ক’ থেকে শুরু করে মনে রাখার মতো বহু কাজ আমাদের উপহার দিয়েছেন এই বর্ষীয়ান চিত্রগ্রাহক। সত্যি বলতে, তার কাজের সৌন্দর্য আসলে ভাষায় প্রকাশ কঠিন। তার বেশিরভাগ শটই বাঁধাই করে রাখার মতো সুন্দর, ১৪ মনোনয়নের ২০১৭ সালের ‘ব্লেড রানার ২০৪৯’ এর জন্য প্রথম অস্কার জেতাটা ছিল লং ওভারডিউ। ‘১৯১৭’ এর কাজটা আবার ছিল অতিমাত্রায় বাস্তব। এক শটের এই মুভিকে বাস্তবসম্মত করার জন্য ফটোগ্রাফির কাজটা এমনভাবে করেছেন, যাতে দর্শকের কাছে মনে হয়েছে যে, যুদ্ধটা তাদের চারপাশেই ঘটছে।
তার ব্রিলিয়ান্ট ক্যামেরাওয়ার্ক ছাড়া এরকম উচ্চাভিলাষী একটা প্রজেক্টকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হত না। এ বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন রডরিগো প্রিটো (দ্য আইরিশম্যান), রজার ডিকিন্স (১৯১৭), জারিন ব্লাশকি (দ্য লাইটহাউজ), রবার্ট রিচার্ডসন (ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন হলিউড) ও লরেন্স শের (জোকার)। ‘দ্য লাইটহাউজ’ এর জারিন ব্লাশকির মাঝেও অফুরন্ত সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে দারুণ কিছু চোখ জুড়ানো কাজ পাওয়ার আশা করাই যায়।
সেরা মিউজিক্যাল স্কোর
এ বিভাগে ‘জোকার’ মুভির থমথমে বিষণ্ন সাউন্ডট্র্যাকের জন্য হিলডুর গোনাডোত্যিরের জয় ছিল অবধারিত। টিভি সিরিজ ‘চেরনোবিল’ দিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন বছরের প্রথমভাগে। পুরষ্কার পাবার পরে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি মুভির প্রযোজকদের একজন, অভিনেতা ব্র্যাডলি কুপারকে; যিনি মাত্র গত বছরেই মিউজিকাল ড্রামা ‘অ্যা স্টার ইজ বর্ন’ দিয়ে সঙ্গীত ক্যারিয়ারেও প্রবেশ করেছেন। এ বিভাগে মনোনীত অন্যরা ছিলেন থমাস নিউম্যান (১৯১৭), আলেক্সান্ডার ডেসপ্লা (লিটল উইমেন), ম্যারেজ স্টোরি (র্যান্ডি নিউম্যান) ও জন উইলিয়ামস (স্টার ওয়ার্স: দ্য রাইজ অব স্কাইওয়াকার)। সেরা অরিজিনাল স্কোর বিভাগে অস্কার জিতে নেয়া প্রথম নারী তিনি। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন তিন নারী অ্যাকশন তারকা সিগোর্নি ওয়েভার, ব্রি লারসন আর গ্যাল গ্যাদোত। আর সুপারভিলেনের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর নির্মাতা হিলডুর নিজেও কোনো সুপারহিরো থেকে কম যান না।
‘দ্য ডার্ক নাইট’ মুভিতে হ্যান্স জিমারের সৃষ্ট জোকারের অনবদ্য থিম নিশ্চয়ই মনে আছে। নতুন জোকারের জন্য উপযুক্ত সাউন্ডট্র্যাক বানানো তাই অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। আর সেই চ্যালেঞ্জ হিলডুর পূরণ করেছেন কেবল স্ক্রিপ্ট পড়েই। ক্যারেক্টার স্টাডিভিত্তিক এই থ্রিলারের মূল বক্তব্য যে কতটা সূক্ষ্ণভাবে অনুধাবন করেছেন, তা এতেই প্রমাণিত হয়। সেলোর তারে ফুটিয়ে তোলা গা ছমছমে সিম্ফোনি দিয়ে আর্থার ফ্লেকের দুঃসহ অভিযানে দর্শককে একাত্ম্য করেছেন। ‘কল মি জোকার’ কিংবা ‘সাবওয়ে’ মাথা থেকে বের করতেও বেগ পেতে হয়েছে। অস্কারটা অবশ্যম্ভাবীভাবেই তার প্রাপ্য ছিল।
সেরা অরিজিনাল সং
এ বিভাগে ‘রকেটম্যান’ মুভির ‘(আই অ্যাম গোনা) লাভ মি অ্যাগেইন’ গানটির জন্য অস্কার জিতে নিয়েছেন স্যার এলটন জন ও বার্নি টপিন্স। গোল্ডেন গ্লোবে সেরা অভিনেতার (মিউজিক্যাল) পুরস্কার জিতে নেয়া ট্যারেন আগারটন দুর্ভাগ্যবশত সেরা অভিনেতার মনোনয়নটাই পাননি। অবশ্য সেটা পুষিয়ে দেবার জন্য না, নিজের বায়োপিকের জন্য লেখা অসাধারণ এই গানটির জন্য স্যার এলটন জনের এমনিতেই এই অস্কারটা প্রাপ্য ছিলো।
এর আগে ১৯৯৫ সালে ‘দ্য লায়ন কিং’ এর জন্য প্রথম অস্কার পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের ক্রিয়েটিভ পার্টনার বার্নি টপিন্সের সাথে মনোনয়ন পাওয়া এই প্রথম, একসাথে ৫৩ বছরের ক্যারিয়ারে বহু অর্জন তাদের, সেটা আরো পূর্ণতা পেলো অস্কার দিয়ে। সত্তর পার করেও তার দেখিয়ে দিলেন, বিশ্বজয়ের ক্ষমতা এখনো আছে তাদের।
সেরা অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম
অন্যান্য বড় বড় বিভাগের কিছুটা আড়ালেই থাকে এই বিভাগটি। কিন্তু ‘হেয়ার লাভ’ দিয়ে অস্কার জিতে নেয়া ম্যাথু চেরি আর ক্যারেন রুপার্টের গল্পটা একটু অন্যরকম। ম্যাথু চেরি ছিলেন আমেরিকান একজন ফুটবলার। ২০০৭ সালে খেলা ছেড়ে দিয়ে ফিল্ম ক্যারিয়ারে মনোযোগ দেন তিনি, আইফোন সিক্স দিয়ে বানিয়েছিলেন নিজের দ্বিতীয় মুভি ‘নাইন রাইডস’। ২০১৬ সালের দিকে একটা টুইট করে ঘোষণা দেন, তার কাছে অস্কার জিতে নেবার মতো একটা অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্ম বানানোর আইডিয়া আছে, আগ্রহী কোনো থ্রিডি গ্রাফিক্স ডিজাইনার যেন তার সাথে যোগাযোগ করেন। মা-মেয়ের কাহিনী নিয়ে বানানো ৬ মিনিটের এই শর্টফিল্মটি ঠিকই তিন বছরের মাথায় তার স্বপ্ন পূরণ করে দিলো।
গতবছরের মতো এবারের অস্কারও ছিল হোস্টবিহীন। এক দর্শক মজা করে বলেছেন, হোস্ট না থাকলে প্যারাসাইট জিতলো কী করে? তবে অ্যাওয়ার্ড বাদে অনুষ্ঠানের একটি বড় চমক র্যাপার এমিনেমের আচমকা পারফরম্যান্স। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে জন হিউজেসের ‘দ্য ব্রেকফাস্ট ক্লাব’, ‘সে এনিথিং’ থেকে শুরু করে ‘টাইটানিক’সহ হলিউডের সেরা কিছু মিউজিকাল মুহূর্তগুলো দেখানো হয়। মন্ট্যাজ শেষ এমিনেমের ‘এইট মাইল’ মুভির একটি দৃশ্য দিয়ে, তারপরই স্বয়ং স্লিম শ্যাডি চলে আসেন মঞ্চে।
সেই ২০০২ সালে এই মুভির হিপহপ গান ‘লুজ ইওরসেলফ’ এর জন্য অস্কার পেয়েছিলেন তিনি। অস্কার পাওয়া হিপহপ জনরার প্রথম গান এটি। ২০০৩ সালের অস্কারে গান গাওয়ার কথা থাকলেও অস্কার পাওয়ার কোনো আশা নেই ভেবে সেবারে অনুষ্ঠানে আসেননি তিনি। সতেরো বছর পর অবশেষে অস্কার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ভক্তদের আনন্দে মাতিয়েছেন তিনি।