সিনেমা হলে আয়েশ করে বসেছেন ছবি দেখতে, হাতে পপকর্ন। চারপাশের স্পিকার দিয়ে কানফাটানো শব্দে সিনেমা চলবে, এই আশা নিয়ে যারা সায়েন্স ফিকশন হরর ছবি অ্যা কোয়াইট প্লেস দেখতে গেছেন, তাদের হাতের পপকর্ন হাতেই রয়ে যাবে।
ধেয়ে আসছে ভয়ানক খুনী, তার হাত থেকে বাঁচার জন্য দম বন্ধ করে লুকিয়ে আছে ভিক্টিম, হরর মুভিতে এরকম দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। “হ্যালোউইন” এ মাইকেল মেয়ার্সের হাত থেকে জেমি লি কার্টিসের লুকিয়ে থাকা কিংবা “দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস” এ সিরিয়াল কিলারের বেজমেন্টে জোডি ফস্টারের পা টিপে চলার দৃশ্যগুলো এখন আইকনিক। কিন্তু কেবল পীড়াদায়ক নিঃশব্দতার সাসপেন্সকে পুঁজি করে পুরো একটি মুভি বানিয়ে ফেলা একটু ঝুঁকির ব্যাপারই বটে। সংলাপ ছাড়া কাহিনী আগাবে কীভাবে? চিৎকার তো দূরের কথা, কোনো শব্দ ছাড়া সন্তান জন্ম দেবার কষ্ট ফুটিয়ে তোলাও তো অসম্ভব।
কাহিনীর পটভূমি ২০২০ সালের পৃথিবী। রহস্যময় এক পৈশাচিক জন্তুর আক্রমণে পৃথিবীতে মানুষ এখন বিলুপ্তপ্রায়। সেই জন্তুদের চোখ নেই, কিন্তু আছে প্রবল শক্তিশালী শ্রবণেন্দ্রিয়। হিংস্র এই প্রাণীগুলোকে মারার কোনো উপায় নেই, কিন্তু একটু শব্দ করা মাত্রই তারা যেকোনো প্রান্ত থেকে ছুটে এসে মুহূর্তে টুঁটি ছিঁড়ে ফেলবে। কোথা থেকে এই জন্তুগুলো আসলো, কিংবা অন্য মানুষদের কী পরিণতি হয়েছে এসব বাদ দিয়ে কাহিনী এগিয়েছে কেবলই অ্যাবট পরিবারের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে।
লি আর ইভিলিন অ্যাবট সন্তানদেরকে নিয়ে এই ভয়াল পৃথিবীতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে নানাভাবে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার লি তাদের ফার্মহাউজকে নানা কায়দায় সাউন্ডপ্রুফ করার চেষ্টা করেছে। তাদের মেয়ে রিগানের জন্মগতভাবে বধির হওয়াটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছে এক অর্থে, আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে দক্ষ তারা সবাই। তবে এই আশীর্বাদ আবার অভিশাপও বটে, কারণ কিছুই না শুনতে পারা রিগান কোনো আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার সুযোগও পায় কম। তাদের কিশোর ছেলে মার্কাস স্বভাবতই হতাশ হয়ে পড়েছে। রিগানের শ্রবণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য লি তার ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। সেই সাথে পুরোদস্তুর বিজ্ঞানী হয়ে অভেদ্য চামড়ার অধিকারী প্রাণীগুলোর দুর্বলতাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে তার গবেষণাগারে।
কাহিনী মূলত এটুকুই, কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফি, সাউন্ড ডিজাইন এবং সবার মধ্যেকার কেমিস্ট্রি আর শক্তিশালী পরিচালনা মিলিয়ে ৯০ মিনিটের মুভিটি হয়ে উঠেছে শ্বাসরুদ্ধকর, একটুও একঘেয়ে লাগার উপায় নেই। আরেকটি বড় গুণ হলো কেবল রাতের অন্ধকারে না, উজ্জ্বল দিবালোকের কিছু দৃশ্যেও দর্শকদের বুক কেঁপে উঠবে। দানবের সিজিআই ইফেক্টও যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার। বধির রিগানের চোখ দিয়ে বিভিন্ন দৃশ্যধারণ করা হয়েছে, এমনকি দানবগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েও পৃথিবীকে দেখানো হয়েছে। অন্ধ হলেও নৃশংস প্রাণীগুলো মূলত সুপারসনিক হিয়ারিং এর উপর নির্ভর করে চলে। বাদুড় যেমন প্রতিধ্বনির শুনে ওড়ে অনেকটা সেরকম, তবে এদের কানগুলো অনেকগুণ বেশি বিবর্তিত।
ম্যান ভার্সাস নেচার ঘরানার অন্য মুভিগুলো যেখানে অ্যাকশনকে প্রাধান্য দেয়া হয়, সেখানে অ্যা কোয়াইট প্লেস প্রাধান্য দিয়েছে ফ্যামিলি ডাইনামিককে। কোনো সংলাপ না থাকলেও মনে হবে, একটি সত্যিকারের পরিবারের সদস্যদেরকেই যেন দেখছি। ক্ষোভ, অনুশোচনা কিংবা ভালোবাসা তো বটেই; উল্লাসে ফেটে পড়া কিংবা কান্নায় ভেঙে পড়ার মতো দৃশ্যগুলোকেও ফুটে উঠেছে কেবল মুখের অভিব্যক্তি দিয়েই। “আমরা কী ভালো বাবা-মা হতে পারবো?” কিংবা “আমাদের সন্তানদেরকে কি ঠিকমত নিরাপত্তা দিতে পারবো?” এই প্রশ্নগুলো সব বাবা-মাকেই তাড়া করে ফেরে। মুভির এক অংশে এক সন্তানের স্বার্থে যখন তাদের অন্য সন্তান বিপদের মুখোমুখি, তখন ইভিলিনের কণ্ঠে হাহাকারের মতো শোনা যায়,
What are we if we can’t protect them
বিন্দুমাত্র শব্দ না করে কীভাবে জীবনধারণ সম্ভব? লেখক এবং পরিচালক নানাভাবে তার জবাব দিয়েছেন বুদ্ধিদীপ্ত স্ক্রিপ্টে। তারপরেও অনেকের কিছু প্রশ্নের জবাব এখনো আসেনি, সেগুলোর জবাব উঠে আসতে পারে সিক্যুয়েলে। ডায়লগের অতি স্বল্পতার কারণে দর্শকের একাগ্র মনোযোগ ধরে রাখতে পারে নজরকাড়া ভিজুয়াল। প্রচ্ছন্ন কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর যোগ করা হয়েছে যাতে একে পুরোপুরি সাইলেন্ট ফিল্ম না মনে হয়।
পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক অন্যান্য মুভির মতো এখানে ধূসর প্রান্তর কিংবা হিমশীতল পরিবেশ এখানে অনুপস্থিত। বনে গাছের আড়ালে রোদের উঁকিঝুঁকি, পাথরের গা বেয়ে ঝর্ণার পানির কলকল শব্দ কিংবা সবুজ শস্যক্ষেত দেখে আপাতদৃষ্টিতে একে ভয়ানক ডিস্টোপিয়া বলে মনে হবে না। ঘটনাক্রমে ফার্মহাউজে চলে আসা একটি জন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য সন্তানসম্ভবা ইভিলিনের প্রচেষ্টার দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে মুভির সেরা দৃশ্যগুলোর একটি। কালজয়ী অন্যান্য থ্রিলার দৃশ্যের সাথে একে স্থান দিতেও দ্বিধা করছেন না অনেকে।
স্কট বেক আর ব্রায়ান উডস নামের দুই লেখক এ কোয়াইট প্লেসের প্রাথমিক স্ক্রিপ্ট জন ক্রাসিন্সকিকে দেখাতে নিয়ে যান। এই স্ক্রিপ্টটি লেখার পেছনে তাদের অনুপ্রেরণা ছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের সাইলেন্ট মুভিগুলো। পরবর্তীতে প্যারামাউন্ট কর্তৃপক্ষ জন ক্রাসিনস্কিকে স্ক্রিপ্টটা পুনরায় একটু ভিন্ন ধাঁচে লেখার দায়িত্ব দেয়। সেই সাথে বড় এই প্রোডাকশন হাউজের তত্ত্বাবধানে মুভিটি পরিচালনার দায়িত্বও পেয়ে যান ক্রাসিনস্কি। প্রথমে স্ক্রিপ্টটি ছিল পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক ধাঁচের সারভাইভাল ড্রামা, কিছুটা প্রিডেটর কিংবা ক্লোভারফিল্ড সিরিজের মুভিগুলোর মতো। কিন্তু অ্যাকশন বা হরর নয়, সদ্যই দ্বিতীয় সন্তানের বাবা হওয়া ক্রাসিনস্কিকে সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের চরম পর্যায়ের ত্যাগ স্বীকারের ন্যারেটিভটাই বেশি আকৃষ্ট করে।
এর আগে দুবার পরিচালনা করা ক্রাসিনস্কি নিজে পরিচালনা করা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। তবে স্ত্রী ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমিলি ব্লান্টের অনুপ্রেরণায় দায়িত্বটি নিতে রাজি হয়ে যান। কাহিনীতে কিছু পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে তাকে অ্যালিয়েন, নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন, ইন দ্য বেডরুম মুভিগুলো প্রভাবিত করেছে। পরবর্তীতে স্ক্রিপ্টটি পড়ার পরে ব্লান্ট নিজেও ইভিলিন অ্যাবটের চরিত্রটি করার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠেন। তাদের মেয়ে রিগান অ্যাবটের ভূমিকায় ক্রাসিনস্কি সত্যিকারের একজন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী অভিনেত্রীকে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যান মিলিসেন্ট সিমন্ডসকে। ২০১৬ সালের মিনিসিরিজ দ্য নাইট ম্যানেজার এবং ২০১৭ সালের চলচ্চিত্র সাবারবিকনে অভিনয় করা নোয়া জুপকে মার্কাসের ভূমিকায় পছন্দ করা হয়।
বিখ্যাত অ্যান্থলজিক্যাল টিভি সিরিজ “দ্য টোয়াইলাইট জোন” এর “দ্য সাইলেন্স” নামক একটি পর্বে দেখা যায়, একজন মানুষকে ১ বছর চুপ থাকার বিনিময়ে ৫,০০,০০০ ডলার সাধা হচ্ছে। সেই মানুষটি ভয়ানক বাচাল থাকার পরেও নানাভাবে ত্যাগ স্বীকার করে শেষপর্যন্ত ঠিকই সেই অর্থ আদায় করে ছাড়েন। প্রচলিত হরর ঘরানার বাইরে একটু ভিন্ন পথে যাওয়া কাহিনীনির্ভর এবং চিন্তার খোরাক জোগানো মুভিগুলোর তালিকায় নতুন সংযোজন হলো অ্যা কোয়াইট প্লেস। গত কয়েক বছরের কিছু সেরা ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র দ্য বাবাডুক, দ্য উইচ, ডোন্ট ব্রেথ, গেট আউট ইত্যাদির সাথে অনেকেই একে এক কাতারে রাখছেন।
অভিনব ধাঁচের এ চলচ্চিত্রটি বিশ্বব্যাপী মুক্তি পায় এ বছরের ৬ এপ্রিল। মাত্র ২১ মিলিয়ন ডলার বাজেটের মুভিটি আয় করে নেয় ৩২৬ মিলিয়ন ডলার! প্যারামাউন্ট ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানি ২০১৫ সালের মিশন ইম্পসিবল: রোগ নেশনের পর এই মুভিটি দিয়েই আবার সফলতার মুখ দেখল। সেই সাথে সর্বস্তরের দর্শক-সমালোচকদের কাছেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তারই প্রমাণ আইএমডিবিতে ৭.৯/১০, রোটেন টমাটোসে ৯৫% ফ্রেশ রেটিং এবং মেটাক্রিটিকে ৮২% পজিটিভ রেটিং। বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রেখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় একে নিয়ে তুমুল আলোচনা। বিখ্যাত হরর ঔপন্যাসিক স্টিফেন কিং এই সার্ভাইভাল হররকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।
মূলত এমি নমিনেশন এনে দেওয়া সিরিজ দ্য অফিস আর সামথিং বোরোড, লাইসেন্স টু ওয়েড, থার্টিন আওয়ার্স মুভিগুলোর জন্যই জন ক্রাসিনস্কি সুপরিচিত। তবে হরর জনরায় প্রবেশ করার পরে তার সাফল্য অন্য সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে। অভিনেতা, লেখক এবং উদীয়মান পরিচালক তিনক্ষেত্রেই দারুণ সফল হবার কারণে টাইমে ম্যাগাজিন তাদের The 100 most influential people in the world in 2018 লিস্টে তাকে স্থান দিয়েছে।
তীব্র প্রতিযোগিতা, স্কুলে সন্ত্রাসী হামলা, বুলিং, আত্মহত্যা ইত্যাদির জন্য আজকালকার অনেক শিশু-কিশোরদের কাছে পৃথিবী এখন নির্মম। এসব কারণে আজকালকার উৎকণ্ঠিত মা-বাবাদের মানসিক অবস্থাকেই ক্রাসিনস্কি রূপকার্থে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন আর সফলও হয়েছেন। গত বছরের গেট আউটের মতোই এ বছরের অ্যা কোয়াইট প্লেস অস্কার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অবাক হবার কিছু নেই।