মেগাডেথ: ডেভ মাসটেইনের অনবদ্য সৃষ্টি

ফুল ভলিউমে ভ্যান হ্যালেন ব্যান্ডের গান ‘রানিং উইথ দ্য ডেভিল’ এর বেসলাইন বাজাচ্ছিলেন এলেফসন। হঠাৎ দেখলেন, রুমের এসির বাইরের অংশে একটি ফুলের টব উড়ে এসে পড়ল উপর থেকে। বন্ধু গ্রেগকে নিয়ে দ্রুত উপরে যান তিনি। উপরের ফ্ল্যাটে নক করলে দরজা খোলেন ডেভ মাসটেইন। টবের কথা জিজ্ঞেস না করে তিনি সিগারেট চান ডেভের কাছে। জবাবে মুখের উপর দরজা বন্ধ করেন ডেভ। একটু পর এলেফসন আবার নক করেন, এবার বিয়ার পানের প্রস্তাব দেন।

সে রাতেই বারে বসে স্বপ্ন বুনন হয় আজকের মেগাডেথের। ৩৬ বছর ধরে হেভি মেটালের অন্তর্ভুক্ত থ্র্যাশ মেটাল জনরার মুকুটহীন রাজা বলা যায় মেগাডেথকে। শ্রেষ্ঠ চার হেভি মেটাল ব্যান্ডকে একত্রে ‘দ্য বিগ ফোর’ বলা হয়। এই ব্যান্ডগুলো হলো: মেটালিকা, মেগাডেথ, স্লেয়ার, অ্যানথ্রাক্স। ১৯৮৩ সালে ডেভ মাসটেইন এবং ডেভিড এলেফসন গড়ে তোলেন মেগাডেথ। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক, মেগাডেথ এবং ফ্রন্টম্যান ডেভ মাসটেইন এর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা জীবনের কাহিনী।

ডেভ মাসটেইনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা

দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার লা মেসায় ১৯৬১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, জন এবং এমিলি মাসটেইনের ঘর আলো করে জন্ম নেন ডেভিড স্কট মাসটেইন। তার শৈশব আর পাঁচটা আমেরিকান শিশুর মতো সুখের ছিল না। মদ্যপ বাবার নির্যাতনের শিকার হতে হতো তাকে।

বয়স যখন চার, তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বোন ডেবির হাত ধরে সঙ্গীতজগতে প্রবেশের অনুপ্রেরণা পান ডেভ। ক্যাট স্টিভেনসের মতো বিখ্যাত গায়কের গান শুনে তিনি প্রথম মেলোডির প্রেমে পড়েন। আট বছর বয়সে মায়ের কাছ থেকে প্রথম গিটার উপহার পান ডেভ।

শৈশবে ডেভ; Image source: twitter.com/DaveMustaine

১৫ বছর বয়সেই ডেভ বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় বাসা নেন। হাতের টাকা শেষ হয়ে গেলে মাদক বিক্রির কাজ শুরু করেন এবং নিজেও আসক্ত হয়ে পড়েন মাদকে। একইসাথে চলতে থাকে রক-হেভি মেটাল মিউজিক চর্চা। মন খারাপের সঙ্গী ছিল শুধু গিটার।

প্রথম ব্যান্ড এবং মেটালিকা

১৭ বছর বয়সে ডেভ হাই স্কুল ড্রপআউট করেন এবং প্রথম ইলেক্ট্রিক গিটার কিনেন। ১৯৭৯ সালে তিনি তার প্রথম ব্যান্ড প্যানিকে লিড গিটারিস্ট হিসেবে বাজানো শুরু করেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যান্ডের দুই সদস্য মারা গেলে দু’ বছর পরে ব্যান্ডটি ভেঙে যায়।

‘প্যানিক-এ’ বাজানোর সময়; Image source: tumblr.com

এরপর কেটে যায় কিছু সময়। গিটার চর্চার পাশাপাশি মাদক গ্রহণের চর্চাও ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন ডেভ। এমন কোনো মাদক নেই, যা তিনি গ্রহণ করেননি। ৫৮ বছরের জীবনে ডেভকে ১৭ বার রিহ্যাবে যেতে হয়েছে অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের জন্য।

১৯৮১ সালে ডেভ পত্রিকায় দেখেন মেটালিকা নামক একটি ব্যান্ড লিড গিটারিস্ট নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। তিনি যোগাযোগ করেন এবং অবধারিতভাবেই যোগ দেন মেটালিকায়। এমনকি ইন্টারভিউও দেয়া লাগেনি তার। প্র্যাক্টিসরুমে তার বাজানো শুনেই মেটালিকার জেমস হেটফিল্ড ও লারস আলরিক সিদ্ধান্ত নেন ডেভকে নেওয়ার।

মেটালিকায় ডেভ মাসটেইন (বাম থেকে দ্বিতীয়); Image source: metalheadzone.com

মেটালিকায় ডেভ থ্র্যাশ জনরার আসল অস্তিত্ব খুঁজে পান। নিজেকে সর্বোচ্চভাবে বিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সঙ্গীতচর্চায়। কিন্তু বাদ সাধে তার অতিরিক্ত মাদকাসক্তি। মেটালিকার কমবেশি সবাই মাদক গ্রহণ করলেও ডেভ ছিলেন অতিরিক্ত আসক্ত। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অন্য সদস্যদের সাথে বাজে ব্যবহার এবং শোগুলোতে দেরি করে আসা ছিল তার নিত্য কাজ।

একদিন ডেভের পোষা কুকুর মেটালিকার বেসিস্ট রন ম্যাকগভনির গাড়িতে আঁচড় দিলে জেমস তার কুকুরকে লাথি দিয়ে বসেন। এ নিয়ে তার সাথে জেমস আর লারসের মারামারি হয়। এরপরেই জেমস আর লারস, ডেভকে ব্যান্ড থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মেটালিকার প্রথম অ্যালবাম ‘কিল’এম অল’এর রেকর্ডিং শেষ হওয়ার আগেই ডেভকে ব্যান্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়।

জেমস হেটফিল্ড ও ডেভ মাসটেইন (ডানে); Image source: twitter.com/DaveMustaine

‘কিল’এম অল’ অ্যালবামের চারটি গানে ডেভ মাসটেইনের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল। এমন আকস্মিক বহিষ্কার তার জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। মেটালিকা ছিল তার পরিবারের মতো। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে মেটালিকার ডকুমেন্টারির এক সাক্ষাৎকারে ডেভ বিষাদ নিয়ে বলেছিলেন,

“আমাকে কোনো দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়নি কোনো সতর্কবার্তাও…”

মেগাডেথ

ডেভকে ১১ এপ্রিল, ১৯৮৩ সালে মেটালিকা থেকে বের করে দেয়া হয়। সেদিনই জেমস ডেভকে লস অ্যাঞ্জেলেসগামী বাসে উঠিয়ে দেয়। বাসে বসে ডেভ সদ্য বহিষ্কার হওয়ার ধাক্কা সামলিয়ে উঠার আগেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন, প্রতিশোধ নিতে হবে। এ প্রতিশোধ হবে মধুর। কোনো হানাহানি, রক্তপাতহীন প্রতিশোধ।

বাসে বসে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে নিচে পায়ের কাছে একটি হ্যান্ডবিল পান তিনি। তুলে দেখেন, সেটি তৎকালীন ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর অ্যালান ক্র্যানস্টনের প্রচারণার হ্যান্ডবিল। সেখানে চোখ বোলাতে গিয়ে হঠাৎ একটি বাক্যাংশে চোখ আটকে যায়। লেখাটি ছিল-

“The arsenal of megadeath can’t be rid no matter what the peace treaties come to.”

এই বাক্যাংশের মেগাডেথ শব্দটি থেকেই আসে ব্যান্ডের নাম। কিন্তু ভুল বানানে। তিনি Death থেকে A অক্ষরটি বাদ দিয়ে নাম রাখেন ‘Megadeth’।

অ্যালান ক্র্যানস্টন ও তার উক্তি; Image source: azquotes.com

ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে ডেভ চাকরিক্ষেত্রের সহকর্মীদের সাথে কিছুদিনের জন্য ‘ফলেন এঞ্জেলস’ নামে একটি ব্যান্ড খোলেন। কিন্তু অন্য সদস্যদের সাথে যথার্থ রসায়নের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। হাতে কিছু টাকা জমলে তিনি চাকরি ছেড়ে হলিউডে বাসা নিয়ে থাকা শুরু করেন। বলা যায়, সেখানেই মেগাডেথের জন্ম। কয়েকবার লাইনআপ বদলের পর স্থিতিশীল লাইনআপ ছিল এমন-

রিদম গিটার, ভোকাল: ডেভ মাসটেইন

লিড গিটার: ক্রিস পোল্যান্ড

বেস: ডেভিড এলেফসন

ড্রামস: গার স্যামুয়েলসন

বাম থেকে ডেভিড এলেফসন, ডেভ মাসটেইন, ক্রিস পোল্যান্ড ও গার স্যামুয়েলসন; Image source: megadeth.com

১৯৮৫ সালে প্রথম অ্যালবাম ‘কিলিং ইজ মাই বিজনেস…অ্যান্ড বিজনেস ইজ গুড!’ প্রকাশ করে মেগাডেথ।

প্রথম অ্যালবাম ‘কিলিং ইজ মাই বিজনেস…অ্যান্ড বিজনেস ইজ গুড!’; Image source: cdandlp.com

অ্যালবাম বের হওয়ার পরই হেভি মেটালপ্রেমীদের নজরে আসতে শুরু করে ব্যান্ডটি। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে নিয়মিত এবং মাঝে মাঝে দেশের বাইরেও বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যান্ডের সাথে সফর করে মেগাডেথ।

১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘পিস সেলস…বাট হু’জ বায়িং?’ প্রকাশ পায়। এই অ্যালবামকে অন্যতম ক্লাসিক হেভি মেটাল অ্যালবাম হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।

দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘পিস সেলস…বাট হু’জ বায়িং?’ এর কভার; Image source: hammeronlineshop.com

এই অ্যালবামে মেগাডেথের লোগো নির্ধারণ করে প্রকাশিত হয় এবং তা এখনো বহাল আছে। গানগুলোর কারণে তো জনপ্রিয় বটেই, অ্যালবামের কভার আর্টটিও সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয় বিভিন্ন কারণে।

মেগাডেথ বরাবরই রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং মানুষের বিরুদ্ধে ক্ষমতাশীলদের শক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে গান লিখে আসছে। কভারে দেখা যায়, জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় কার্যালয় অপশক্তির আঘাতে বিধ্বস্ত। যে সংস্থা সারা পৃথিবীর মানুষের শান্তি বজায় রাখার জন্য বদ্ধপরিকর, সে সংস্থা আজ অস্তিত্বহীন। সেটির সামনে মেগাডেথের মাসকট ভিক র‍্যাটেলহেড বিজ্ঞাপন ঝুলিয়েছে- শান্তি বিক্রি হবে, কিন্তু শান্তি কেনার কেউ নেই।

ভিক র‍্যাটেলহেড হলো মেগাডেথের মাসকট। ডেভ মাসটেইনের আরেকটি সৃষ্টি, আরেকটি প্রতিবাদের ভাষা। এর ধারণা ডেভ প্রথম দিয়েছিলেন তার ‘স্কাল বিনিথ দ্য স্কিন’ গানে। Vic  শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ Victim  থেকে। আর Rattlehead  শব্দটি ডেভ তার মায়ের কাছ থেকে নিয়েছেন। গিটার বাজানোর সময় হেডব্যাং দিলে মা তাকে র‍্যাটেলহেড বলে ডাকতেন।

ভিক র‍্যাটেলহেড একটি কঙ্কালের অবয়ব, যা মূর্ত করে, “See no evil, hear no evil, speak no evil”। অর্থাৎ, খারাপ কিছু দেখবো না, শুনবো না এবং বলবো না। ভিক প্রহসনের চাপে ক্লিষ্ট এক নিষিদ্ধ প্রতিবাদের চিহ্ন। ভিকের চোখ, কান লোহার মুখোশ ও ঢাকনা দ্বারা বন্ধ। মুখ লোহার আংটা দিয়ে আটকানো। ধর্মীয় দমন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই মূলত এই মাসকটের জন্ম।

ভিক র‍্যাটেলহেড; Image source: deviantart.com/gitzmisiti

এর মধ্যে আবার মেগাডেথের লাইনআপে পরিবর্তন আসে। অর্থ আত্মসাতের দায়ে লিড গিটারিস্ট ক্রিস পোল্যান্ড এবং ড্রামার গার স্যামুয়েলসনকে ব্যান্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাদের জায়গায় যোগ দেন গিটারে জেফ ইয়াং এবং ড্রামসে চাক বেহলার।

বাম থেকে চাক বেহলার, ডেভিড এলেফসন, ডেভ মাসটেইন ও জেফ ইয়াং; Image source: megadeth.com

নতুন লাইনআপ নিয়ে অ্যালবাম ‘সো ফার, সো গুড…সো হোয়াট!’ মুক্তি দেয়া হয়। মেটালিকার বেসিস্ট এবং ডেভের বন্ধু ক্লিফ বার্টন মারা গেলে ডেভ এই অ্যালবামের একটি গান ‘ইন মাই ডার্কেস্ট আওয়ার’ লেখেন ক্লিফের স্মৃতির উদ্দেশে।

মেটালিকার বেসিস্ট ক্লিফ বার্টন, যার স্মৃতির উদ্দেশ্যে গান লেখেন ডেভ; Image source: pinterest.com

মেগাডেথের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও ঘন ঘন লাইনআপ পরিবর্তনের জন্য অনেকের কাছে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যান্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভক্তদের মনে দুশ্চিন্তা ভর করে। এই লাইনআপ থেকেও গিটারিস্ট এবং ড্রামারকে বের করে দেয়া হয় কিছুদিন পর। তাদের জায়গায় যোগ দেন গিটারে মার্টি ফ্রিয়েডম্যান এবং ড্রামসে নিক মেনজা।

বাম থেকে মার্টি ফ্রিয়েডম্যান, ডেভ মাসটেইন, নিক মেনজা ও ডেভিড এলেফসন; Image source: megadeth.com

নব্বইয়ের দশকের এই লাইনআপকে মেগাডেথের শ্রেষ্ঠ লাইনআপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ১০ বছর ছিল ব্যান্ডের স্বর্ণযুগ। এই ১০ বছরে মেগাডেথ তার ভক্তদেরকে উপহার দেয় পাঁচটি অ্যালবাম। যার মধ্যে ‘রাস্ট ইন পিস’ অন্যতম। ১৯৯০ সালে বের হওয়া এই অ্যালবাম বিশ্ব জুড়ে মেটালপ্রেমীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ থ্র্যাশ মেটাল অ্যালবাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘রাস্ট ইন পিস’।

মূল গিটারিস্ট মার্টি ফ্রিয়েডম্যানের বৈচিত্র্যময় এবং দ্রুত গতির সোলো, ডেভ মাসটেইনের ব্যাতিক্রমী রিফ এবং গিটার শ্রেডিং, সবমিলিয়ে এই অ্যালবামের প্রতিটি গানই অনন্য। অ্যালবামের গানগুলো আজো মেটালপ্রেমীদের প্লে-লিস্টে বেজে চলে নিরন্তর। ‘টর্নেডো অভ সোলস’ গানটির সোলোকে হেভি মেটাল জন্রার ইতিহাসে সেরা সোলো বলা হয়। ‘হ্যাংগার এইটিন’ গানটিও ব্যতিক্রম এর ১১টি সোলোর জন্য। সাধারণত কোনো হেভি মেটাল গানে এতগুলো সোলো শুনা যায় না।

পাঁচটি অ্যালবামের মধ্যে ‘কাউন্টডাউন টু এক্সটিংশন (১৯৯২)’ অ্যালবামটি বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল হয়। বাকি তিনটি অ্যালবাম ‘ইউথ্যানেসিয়া (১৯৯৪)’, ক্রিপ্টিক রাইটিংস (১৯৯৭), ‘রিস্ক (১৯৯৯)’ দিয়ে মেগাডেথ থ্র্যাশ মেটাল শ্রোতাদের মনে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়।

১০ বছর পর এই লাইনআপও ভেঙে যায়। সঙ্গীতের রুচি না মেলার কারণে ব্যান্ড থেকে সরে দাঁড়ান মার্টি ফ্রিয়েডম্যান ও নিক মেনজা। তারপর ড্রামার হিসেবে যোগ দেন জিমি ডি গ্র্যাসো আর গিটারে অ্যাল পিটেরলি। নতুন লাইনআপ নিয়ে নবম অ্যালবাম প্রকাশ করে মেগাডেথ, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড নিডস অ্যা হিরো (২০০১)’।

বিরতি

২০০২ সালে ডেভ কিডনিতে অপারেশনের পর চেয়ারে বসে বিশ্রামের সময় বাঁহাত বেকায়দায় রেখে ঘুমিয়ে পড়লে রেডিয়াল নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্ত হন। এ কারণে তার বাঁহাত প্রায় অচল হয়ে যায়। এ অবস্থায় গিটার বাজানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই তিনি ব্যান্ড কিছুদিনের জন্য ভেঙে দেবার ঘোষণা দেন। 

গিটার বাজানোর জন্য বাঁহাত আবার সচল করতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা গ্রহণ করেন ডেভ। এর মধ্যেই নিজের ব্যক্তিগত জীবনে পরিবর্তন আনেন তিনি। অনিয়মের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন সপরিবারে।

নতুন করে ফিরে আসা

২০০৪ সালে ডেভ মাসটেইন আবার ব্যান্ডযাত্রা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু এর মাঝে বেসিস্ট ডেভিড এলেফসনের সাথে আর্থিক কারণে দ্বন্দ্ব হওয়ায় ডেভিড ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান। বেসিস্ট হিসাবে জিমি লি এবং ড্রামসে ভিনি কোলাইউটাকে নিয়োগ দেন ডেভ। ফিরে আসার পর অ্যাল পিটেরলিকে গিটারিস্ট হিসেবে নেননি ডেভ। দশম অ্যালবাম ‘দ্য সিস্টেম হ্যাজ ফেইলড (২০০৪)এ গিটার বাজানোর জন্য সাবেক গিটারিস্ট ক্রিস পোল্যান্ডকে স্বাগত জানান তিনি।

দশম অ্যালবাম ‘দ্য সিস্টেম হ্যাজ ফেইলড’ এর কভার; Image source: megadeth.com

দশম অ্যালবামের কভার আর্ট দিয়ে আবার সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে মেগাডেথ। তৎকালীন আমেরিকার টালমাটাল রাজনৈতিক অবস্থা যেন এক অ্যালবাম কভারেই ফুটে উঠেছিল।

আর্টে দেখা যায়, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভিক র‍্যাটেলহেড ‘নন গিল্টি ভার্ডিক্ট’ বিক্রি করছে। ক্রেতা আর কেউ নন, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ! পাশে স্যালুটরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে হিলারি ক্লিনটন আর তার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। বুশের পেছনে দাঁড়িয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড চেনি এবং তার হাতে একটি ব্রিফকেস, যাতে লেখা ‘প্ল্যান-বি’। এমন ব্যাতিক্রমী এবং সময়ের সাথে মিল রেখে তৈরী কভার সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। গানগুলোও হয়েছিল জনপ্রিয়।

এরপর লাইন আপে আবার পরিবর্তন আসে। ড্রামসে শন ড্রোভার, গিটারে গ্লেন ড্রোভার এবং বেসিস্ট জেমস ম্যাকডোনকে নিয়ে সফর শুরু করে মেগাডেথ। এই বেসিস্ট কিছুদিন পরে ব্যান্ড ত্যাগ করেন ব্যাক্তিগত কারণে। ব্যাসিস্ট জেমস লোমেনজোকে নতুন অ্যালবামের রেকর্ডিং শুরু হয়।

নতুন অ্যালবাম ইউনাইটেড অ্যাবোমিনেশনস (২০০৭) প্রকাশের পর গিটারিস্ট গ্লেন ড্রোভার ব্যাক্তিগত কারণে ব্যান্ড থেকে বেরিয়ে যান। নতুন গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন ক্রিস বোডারিক। এই লাইন আপ নিয়ে মেগাডেথ আরো তিনটি অ্যালবাম- এন্ডগেম (২০০৯), থার্টিন (২০১১), সুপার কলাইডার (২০১৩) প্রকাশ করে।

২০১৪ সালে শন ড্রোভার ব্যক্তিগত কারণে ব্যান্ড ত্যাগ করেন। এরপর ক্রিস বোডারিক ও মিউজিকাল টেস্ট না মেলার কারণে ব্যান্ড ছেড়ে যাবার ঘোষণা দেন। নতুন গিটারিস্ট এবং ড্রামার নেয়ার জন্য অডিশন শুরু করে মেগাডেথ এবং ২০১৫ সালে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন কিকো লরেইরো আর ড্রামসে ক্রিস এডলার।

বাম থেকে ডেভিড এলেফসন, ক্রিস এডলার, ডেভ মাসটেইন ও কিকো লরেইরো; Image source: megadeth.com

২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় নতুন অ্যালবাম ‘ডিস্টোপিয়া’। প্রথম সপ্তাহেই অ্যালবামের ৪৮ হাজার কপি বিক্রি হয় এবং বিলবোর্ডের টপচার্টে দ্বিতীয় স্থান করে নেয়। এর মধ্যে ড্রামার ক্রিস এডলার ব্যান্ড ত্যাগ করেন। ড্রামসে যোগ দেন ডার্ক ভের্বোন। এখন পর্যন্ত এই লাইন আপ নিয়েই আছে মেগাডেথ।

যত অর্জন

মেগাডেথের অর্জনের ঝুলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ১৯৯১-১৯৯৬, টানা ছয় বছর গ্র্যামির বেস্ট মেটাল পারফরম্যান্সের জন্য মনোনীত হয় ব্যান্ডটি। মোট ১২ বার গ্র্যামিতে মনোনীত হওয়ার পর ২০১৭ সালে ‘ডিস্টোপিয়া’ অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাকের জন্য বেস্ট মেটাল পারফরম্যান্স এর গ্র্যামি পায় মেগাডেথ। বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৪০ মিলিয়ন কপি অ্যালবাম বিক্রি করেছে মেগাডেথ। এখন পর্যন্ত সাতবার বিলবোর্ডের টপ চার্টের সেরা দশে স্থান করে নেয় ব্যান্ডটি। আশির দশকের আমেরিকার আন্ডারগ্রাউন্ড সিন থেকে উঠে আসা খুব কম মেটাল ব্যান্ডই এত বেশি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে।

গ্র্যামি হাতে মেগাডেথের সদস্যরা; Image source: grammy.com

শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৪ জন সদস্য বদল হয়েছে মেগাডেথের। এতবার সদস্য বদলের পরেও সাফল্য ধরে রাখার মূলে রয়েছে ডেভ মাসটেইন ও ডেভিড এলেফসনের সৃজনশীলতা, স্বকীয়তা, পরিশ্রম এবং হেভি মেটাল সংগীতের প্রতি ভালোবাসা।

লাউডওয়ার ম্যাগাজিন মেগাডেথকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তিনটি থ্র্যাশ মেটাল ব্যান্ডের একটি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। গিটার ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন সর্বকালের সেরা ১০০ জন গিটারিস্টের মধ্যে দ্বাদশ স্থানে রেখেছে ডেভ মাসটেইনকে। এছাড়াও ডেভ মাসটেইন এবং মার্টি ফ্রিয়েডম্যান জুটিকে শ্রেষ্ঠ ১০০ গিটারিস্ট জুটির তালিকায় ঊনবিংশ স্থানে রেখেছে গিটার ওয়ার্ল্ড।

আমেরিকার থ্র্যাশ মেটাল বিপ্লবের অন্যতম কান্ডারী মেগাডেথ। হেভি মেটাল সংগীত ও যে প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই ব্যান্ড।

ক্যান্সার এবং বর্তমান অবস্থা

জুন ১৭, ২০১৯। এদিন ডেভ মাসটেইন মিডিয়াকে জানান, তিনি গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত। কোটি কোটি মেগাডেথ ভক্তের মনে জমে আশঙ্কার মেঘ। এই কি তবে শেষ? এখানেই কি ইতি ঘটবে ৩৫ বছরের মেটাল যাত্রার?

কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেয়ার মানুষ নন। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এতদূর আসার পর সামান্য ক্যান্সারের কাছে হার মানার পাত্র নন ডেভ। শুরু হয় পুরোদমে চিকিৎসা। তায়েকোয়ান্দো ও উকিডোকান কারাটেতে ব্ল্যাক বেল্টধারী ডেভ শারীরিক ও মানসিকভাবে দৃঢ় ছিলেন। ফলে এক বছরের ও কম সময়ে ক্যান্সারমুক্ত হন তিনি।

কখনো হার না মানা, উত্তাল ডেভ মাসটেইন; Image source: grammy.com

আজকের গপ্পোসপ্পো শেষ করা যাক মেগাডেথের গান ‘হলি ওয়ার্স…দ্য পানিশমেন্ট ডিউ’ এর কিছু লাইন দিয়ে। সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ লিরিক, কমপ্লেক্স মিউজিক স্টাইল এবং থ্র্যাশ মেটালের পাগলামো দিয়েই মেগাডেথ বেঁচে থাকবে তাদের ভক্তদের মনে। এই দশক পেরিয়ে আরো কয়েক দশক পর্যন্ত। চলুক মেগাডেথের অবিরাম জয়যাত্রা!

“Brother will kill brother,
Spilling blood across the land.
Killing for religion,
Something I don’t understand..!”

 

 

This is a Bangla article. It is written about Heavy Metal band Megadeth and it’s frontman Dave Mustaine’s life. All necessary links are given inside.

Featured Image: megadeth.com

References:

  • Megadeth.com
  • The Rolling Stone Magazine: February 3, 2020
  • The Rolling Stone Magazine: November 26, 2019
  • The Rolling Stone Magazine: March 2, 2018
  • An illustrated history of Megadeth’s Vic Rattlehead by Chris Chantler. www.loudersound.com,
  • Artist biography by Stephen Thomas. www.allmusic.com
  • Megadeth VH-1 Behind the Music (Doccumentary) , youtube- youtube.com/watch?v=DJ7uoBof64g
  • uDiscover Music: Dave Mustaine Reflects on 35 years of Megadeth. Youtube-youtube.com/watch?v=j4VL3c7mKYo
  • Metallica- Lars & Dave Mustaine Interview. Youtube- youtube.com/watch?v=aShnuQsuBzU
  • Loudwire- Dave Mustaine: Fact or Fiction? Youtube-youtube.com/watch?v=czF_UZMxQ1w

Related Articles

Exit mobile version