সাম্প্রতিককালে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, হুলু, ডিজনি+ সহ বিভিন্ন স্ট্রিমিং সাইটের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণে। এক নিমিষেই ভিনদেশী চলচ্চিত্র এবং ওয়েব সিরিজগুলো চলে এসেছে দর্শকদের হাতের মুঠোয়। ব্রেকিং ব্যাড কিংবা পিকি ব্লাইন্ডার্সের মতো জনপ্রিয় ইংরেজি সিরিজগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার সিরিজও দর্শকদের নজর কেড়েছে। স্প্যানিশ ক্রাইম সিরিজ লা কাসা ডে পাপেল কিংবা জার্মান সাইফাই থ্রিলার ডার্কের জনপ্রিয়তা এদেশে ব্লকবাস্টার মুভির তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। তবে স্প্যানিশ, জার্মান, কোরিয়ান কিংবা মেক্সিকান ভাষার এসব সিরিজ দেখার সময়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষার ব্যবধান।
দর্শকদের সুবিধার কথা চিন্তা করে স্ট্রিমিং সাইটগুলো মুভি এবং সিরিজগুলোতে বিভিন্ন ভাষার সাবটাইটেল যোগ করার পাশাপাশি নানা ভাষার ডাবড ভার্সনও উপস্থাপন করছে। তবে ভ্যারায়েটিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে সব সিরিজের ডাবড ভার্শনকে ‘বাই ডিফল্ট ‘করে রেখেছে। কারণ, তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এভাবেই শো-এর দর্শক বেশি বাড়ে।
অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস দেখিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠা তুর্কি ড্রামা ‘দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি’ আমাদের দেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ডাবিংয়ের কল্যাণে। বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেল দীপ্ত টিভি ২০১৫ সালের শেষের দিক থেকে ‘সুলতান সুলেমান’ নামে এর প্রচার শুরু করে। এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দেশে ডাবিং করা তুর্কি সিরিজের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার জীবনকে ঘিরে নির্মিত ‘দিরিলিস আর্তুগ্রুল’ টিভি সিরিজটি বাংলা ভাষায় ডাবিং করে প্রচার করা শুরু হয় মাছরাঙা টিভিতে, সেটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। মূলত ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি’ তথা ‘সুলতান সুলেমান’-এর সাফল্যই বাংলা ডাবিংয়ের নতুন যুগ আগমনের পথ সুগম করে দিয়েছে। এরই মধ্যে বাংলা ডাবিংকৃত সিরিজ প্রদর্শনে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে বায়োস্কোপ। ‘হুররাম’ ও ‘মারিয়া’র মতো জনপ্রিয় তুর্কি সিরিজ বাংলা ডাবিং হয়ে এসেছে বায়োস্কোপ প্ল্যাটফর্মে। টেলিভিশন চ্যানেলের সাফল্যের পর দেশের স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ডাবিং করা টিভিসিরিজের যাত্রা নিশ্চয়ই পুরো দৃশ্যপটে যোগ করতে যাচ্ছে নতুন অভিজ্ঞতার পরত।
ওদিকে সাবটাইটেল দিয়ে দেখা দর্শকদের মূল অভিযোগ হলো সময়ের সমন্বয়হীনতা। যাদের পড়ার গতি তুলনামূলক ধীর, তারা দৃশ্য উপভোগ করার চেয়ে সাবটাইটেল পড়তেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাহিনীর স্বার্থে। পূর্ণ মনোযোগ দিতে গিয়ে অনেক দর্শকই চাপের মুখে পড়ে যান। ঘন ঘন সংলাপ দেওয়া হলে এক মুহূর্তের জন্য স্ক্রিন থেকে চোখ সরানোর উপায় থাকে না। এদিকে সিনেমাটোগ্রাফি কিংবা দৃশ্যে লুকানো ছোট ছোট ডিটেইলগুলো প্রায়ই তাদের চোখ এড়িয়ে যায়।
সাবটাইটেল দিয়ে দেখার কায়দাটা ধরে ফেলতে পারলে অবশ্য সুবিধা আছে। কাহিনী, অভিনয়, দৃশ্যপট সব মিলিয়ে পুরো প্যাকেজের স্বাদ পুরোদমে আহরণ করা যায় তখন। অভিনেতাদের সংলাপ বুঝতে না পারলেও মূল অভিব্যক্তিটুকু ধরতে পারা যায়, সাথে সংলাপগুলো তো পড়ে নেওয়া যাচ্ছেই। অনেকসময় আবার ডাবিং করার সময়ে মুখের সাথে কথা না মেলায় বিরক্ত লাগতে পারে অনেকের, সাবটাইটেল সেক্ষেত্রে উপযুক্ত মাধ্যম। আর মূল নির্মাতার ভিশন বোঝার জন্যও কিন্তু এর বিকল্প নেই। আবার কঠিন কিংবা অপরিচিত কোনো শব্দের অর্থ আলাদা করে সাবটাইটেলে লিখে দেয়া সম্ভব, কিন্তু ডাবিংয়ের ক্ষেত্রে অনুবাদ করে বলা সংলাপটুকুই ভরসা।
এবছরেই অস্কারে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নেয়া ‘প্যারাসাইট’ মুভির পরিচালক বং জুন হো তার শিরোপাজয়ী বক্তব্যে বলেছিলেন, “এক ইঞ্চি সাবটাইটেলের ব্যবধানটুকু পেরোতে পারলেই দর্শকেরা বিশ্বের অসাধারণ সব চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারবেন।” কিন্তু সাবটাইটেল পড়ার অভ্যাস না থাকার কারণে অনেকেই ভিনদেশী ভাষার শিল্পগুলো এড়িয়ে যেতে বাধ্য হন। ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক। ভালোমানের ডাবিং থাকলে এই দর্শকেরাও বিশ্ব সংস্কৃতির স্বাদ আহরণ করতে পারতেন।
নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশে রাইসুল আনাম আসাদ, তরু মোস্তফাসহ স্বনামধন্য অনেক শিল্পীর কণ্ঠে বিটিভিতে ইরানি ভাষার চলচ্চিত্র দেখেছি আমরা। সেসময়ে প্রচারিত বিদেশী টিভি সিরিজগুলোর কথা ভাবলে এখনও নস্টালজিক হয়ে পড়েন অনেকে। আর সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সেগুলোর জনপ্রিয়তার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে সেগুলোর বাংলা ডাবকৃত ভার্শন। এছাড়াও কার্টুন নেটওয়ার্কে পোকেমন, ড্রাগন বল-জিসহ জনপ্রিয় সব অ্যানিমের ইংলিশ ডাবড ভার্শনও অনেকে শিশু-কিশোরই উপভোগ করেছে এবং করছে।
‘ব্ল্যাক বাটলার’ এর মতো অ্যানিমে, যেখানে মূল চরিত্রগুলো ব্রিটিশ, সেখানে তাদের মুখে ব্রিটিশ ভঙ্গিমায় ইংরেজি শোনাটাই বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, এখানে নিঃসন্দেহে সাবের চেয়ে ডাব এগিয়ে থাকবে। এদিকে স্টেইন’স গেট অ্যানিমেতে রিনতারো ওকাবে চরিত্রের কণ্ঠ দিয়েছেন জন মাইকেল টাটুম। তার অসাধারণ পারফর্মেন্সের ফলে উন্মাদ চরিত্রটির মূল রূপ ভালোভাবেই পৌঁছেছে দর্শকের কাছে। তাই বলে সেখানে অযথা চিৎকার-চেঁচামেচি ছিল এমনটা নয়, নানা সূক্ষ্ণ আবেগ নিয়েও নিরীক্ষা করা লেগেছে তাকে। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের আরেকটি ডাবিং করা চরিত্র হলো ‘মাই হিরো অ্যাকাডেমিয়া’ এর ইডা। এই চরিত্রটি আবার চরম রসিক ধরনের ছিল। এই অ্যানিমেটির কাহিনী আমেরিকান সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমেরিকান প্রেক্ষাপটের ভিজ্যুয়াল স্টাইল আর কাহিনীর সাথে দর্শককে গভীরভাবে সংযুক্ত করে ফেলা সম্ভব একমাত্র ইংরেজি দিয়েই। তাই এখানে মূল ভাষার চেয়ে ইংরেজি ডাবিংটিই দর্শকদের বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ‘ব্ল্যাক বাটলার’ এর মতো। আবার ‘ওয়ান পিস’ এর মতো কালজয়ী অ্যানিমের বেলায় আসল নির্যাসের সিকিভাগও তুলে আনতে পারেনি এর ডাবড ভার্শন।
কমেডির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি ভেবে দেখার মতো। একটি কৌতুক শোনা আর পড়ার মাঝে ব্যবধান আছে। কমেডিক টাইমিং আর ডেলিভারির ওপর অনেক সংলাপের সাফল্য নির্ভর করে। ঠিকমতো ডেলিভারি দিতে পারলে সেটা সাবটাইটেলের চেয়ে অনেকখানিই বেশি বিনোদন দেবে। আবার কোন ভাষার গঠন কেমন তার ওপরেও ব্যাপারটি নির্ভর করছে। অনেকসময় দেখা যায় যে, বাক্য গঠনের ভিন্নতার কারণে স্ক্রিনে চরিত্রটি বলার আগেই ডাবিং-এ পাঞ্চলাইনটি চলে আসে, ফলে মজাটা একটু নষ্টই হয়ে যায়। একারণে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সিচুয়েশনাল কমেডি বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সুতরাং এখানে আসলে ডাবড ভার্শন নিয়ে একপাক্ষিক মন্তব্যের সুযোগ নেই।
দর্শকদের মতামত কী তা জেনে আসা যাক। নেটফ্লিক্সের করা এক জরিপে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৭২ শতাংশ দর্শক লা কাসা ডি পাপেল দেখেছেন নিজেদের মাতৃভাষার ডাবিং দিয়ে। সায়েন্স ফিকশন সিরিজ ডার্কের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরো বেশি, ৮৫ শতাংশ। সেকারণেই তারা ইংরেজি বাদে ভিন্নভাষার অন্যান্য সিরিজ যেমন ব্রাজিলিয়ান ডিস্টোপিয়ান থ্রিলার ‘থ্রি পারসেন্ট’ কিংবা মেক্সিকান ক্রাইম ড্রামা ‘নার্কোস’ দেখার সময়ে দর্শকদের সামনে আগে ডাবড ভার্শনটিই উপস্থাপন করে। অন্যান্য বড় বড় স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলোও একাজটি করে আসছে। উপভোগ করার ব্যাপারে অবশ্য দর্শকদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানা গেছে।
সাব এবং ডাব আবার কিছু ক্ষেত্রে একই সূত্রে গাঁথা। এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরের সময়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভাষাগত অলঙ্কার হারিয়ে যায় কখনও কখনও। কেতাবি ভাষায় একে বলে ‘লস্ট ইন ট্রান্সলেশন’। কোনো হাস্যরসাত্মক সংলাপের মূল রসটা যেমন তুলে আনা কঠিন, তেমনি গভীর ভাববোধক কোনো সংলাপের গুরুত্বটাও ফুটিয়ে তোলা কঠিন। অনুবাদ আর মূল সংলাপের মাঝে সবসময়েই একটা ব্যবধান থাকবেই। এক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট ধরে ধরে আক্ষরিক অনুবাদ না করে সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোটাই সবচেয়ে জরুরি। তবে ভালো মানের ডাবিং করতে গেলে ভালো মানের সাবটাইটেল বানানোর চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়। দক্ষ অনুবাদক ও অভিজ্ঞ কণ্ঠাভিনেতা নেবার পাশাপাশি ভালো মানের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনিশিয়ান না থাকলে ঘরে বসে ধারণকৃত সংলাপ কখনোই অনস্ক্রিনের সংলাপের সাথে খাপ খাবে না। সেইসাথে সাউন্ডট্র্যাকও অবিকল রাখাটা তো সবচেয়ে জরুরি।
সত্যি বলতে কী, সাব কিংবা ডাব বেছে নেওয়াটা একজন দর্শকের ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভর করে। অনেকে মূল অর্থ বোঝা এবং সিনেমাটিক এক্সপেরিয়েন্স উপভোগ করার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেন, তাদের জন্য ডাবিং করা ভার্শন মানানসই। আবার অনেকে মূল চলচ্চিত্রের শতভাগ অনুভূতি আস্বাদন করতে চান। অভিনেতাদের কণ্ঠ ছাড়া তাদের মন ভরে না। তাদের মতে, যত্ন করে বানানো শিল্পটাকে শতভাগ মনোযোগ দিয়েই দেখা উচিত। কিন্তু বিনোদনের ক্ষেত্রেও নিজের ওপর চাপ নিয়ে নিলে আর সেটা বিনোদনের পর্যায়ে থাকে না, অনেক মানুষের কাছেই ডাবিংয়ের গ্রহণযোগ্যতা বেশি তাই।
এসব কারণেই ডাব এবং সাব দুটোরই নিজস্ব শক্ত অবস্থান আছে। দর্শকের মনে দাগ ফেলার জন্য ঠিকমতো ডায়লগ ডেলিভারি দিতে পারা শিল্পীদের দিয়ে বানানো ডাবকে সাবের তুলনায় অবশ্য এগিয়েই রাখা যায় কিছুটা। ডাবিং করা কণ্ঠাভিনেতাদের সাথে আসল অভিনেতাদের তুলনা করা দুইপক্ষের জন্যই মানহানিকর, বিশেষ করে যদি পেশাদার শিল্পীদের দিয়ে ডাবিং করানো হয়। হুবহু অভিব্যক্তি তুলে আনা অসম্ভব হলেও যত্ন করে করা কাজ দিয়ে দর্শক উপকৃত হতেই পারে, এতে শিল্পের আস্বাদনটাও একটু ব্যতিক্রম হয় আর কী। তাতে কী, শিল্পের সমঝদারি যে মানুষভেদে ভিন্ন হবেই!