প্রতিটি মানুষই তার কাজের স্বীকৃতি পেতে পছন্দ করে। সেই স্বীকৃতির একটা মাধ্যম হচ্ছে পুরস্কার। এমন নয় যে পুরস্কার পাওয়ার জন্যই কাজ করতে হবে, তবে পুরস্কার যেকোনো একজন মানুষকে নতুনভাবে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। এসব পুরস্কারের মাঝে সবগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আবার সমান নয়। সব মানুষ চায় যে পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি সেটাই অর্জন করতে।
অভিনয় জগতের যারা জড়িত যারা আছেন তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অস্কার। ভারতের অস্কার হিসেবে গণ্য করা হয় ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডকে। এটি মর্যাদার দিক থেকে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পরেই অবস্থিত। ১৯৫৪ সাল থেকে শুরু হয় এই পুরস্কার। এ পুরষ্কারের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারটা সবচেয়ে বেশি ৫ বার করে জিতেছেন দুজন অভিনেত্রী। দুজনের মাঝে একজন হলেন কাজল। অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্মানো এই অভিনেত্রীর পদচারণা অভিনয় মাধ্যমের বাইরেও বিকশিত। তারই কিছু অংশ শোনা যাক।
১৯৭৪ সালের ৫ই আগস্ট ভারতের মুম্বাইতে জন্ম নেওয়া কাজলের বাবা সমু মুখার্জী এবং মা তনুজা মুখার্জী দুজনেই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত ছিলেন। বাবা ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক এবং মা ছিলেন অভিনেত্রী। ছোটবেলায় বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও সেটা তার জীবনে খুব বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারেনি। সেইন্ট জোসেফ কনভেন্ট বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করলেও মিডিয়ার প্রতি আগ্রহের কারণে একটা পর্যায়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
১৯৯২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে রোমান্টিক সিনেমা ‘বেখুদি’র মাধ্যমে সিনেমা জগতে তার অভিষেক হয়। বাণিজ্যিকভাবে সিনেমাটি ব্যর্থ হলেও অভিনয় দক্ষতার কারণে তিনি প্রযোজকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। ফলশ্রুতিতে তিনি পরের বছরেই ‘বাজিগর’ সিনেমাতে চুক্তিবদ্ধ হন। এই সিনেমার সাফল্যই বলিউডে তার অবস্থান পাকা করে দেয়। এরপর আরো কিছু হিট এবং মাঝারি হিট সিনেমা করলেও ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্যটা আসে ১৯৯৫ সালে। এই বছরের শেষের দিকেই মুক্তি পায় ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ সিনেমাটি। এ ছবির শেষ দৃশ্যে রেল স্টেশনে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার সময় কাজল আর শাহরুখের দৃশ্যটিকে বিবেচনা করা হয় বলিউডের সর্বকালের সেরা রোমান্টিক দৃশ্য হিসেবে।
রোমান্টিক ঘরণার এই সিনেমাটি বিপুল ব্যবসায়িক সফলতা পায় এবং ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে মোট ১০টি পুরস্কার জিতে নেয়, যা সে সময়ের একটি সিনেমার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পুরস্কার জয়ের রেকর্ড। এর মাধ্যমেই কাজল তার ক্যারিয়ারের প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেন।
১৯৯৭ সালে তিনি ক্যারিয়ারে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ নেন। ‘গুপ্ত’ সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করেন যেখানে তিনি একজন সাইকো খুনী এবং আবেগী প্রেমিকা হিসেবে কাজ করেন। সিনেমাটি ব্যবসায়িক সফলতা পাওয়ার সাথে সাথে সমালোচকদের দৃষ্টিও কেড়ে নেয়। এক সাক্ষাৎকারে কাজল বলেছিলেন,
“এটা ছিল আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং একটা চরিত্র। খারাপ চরিত্রে অভিনয় করা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল।”
এই সিনেমার মাধ্যমে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে প্রথমবারের মতো একজন নারী খল চরিত্রের জন্য মনোনয়ন পান এবং পুরস্কারও জিতে নেন।
১৯৯৮ সালটা ছিল অভিষেকের পর কাজলের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো বছর। এই বছরের প্রথম দিকে মুক্তি পায় সালমান খানের সাথে ‘পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া’। এটিও কিনা ব্যবসায়িক সফলতা পায়। এছাড়া সঞ্জয় দত্তের বিপরীতে ‘দুশমন’ এবং অজয় দেবগানের বিপরীতে ‘পেয়ার তো হোনা হি থা’ সিনেমা দুটিও ভালো ব্যবসা করে। তবে বছরের শেষ দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ প্রত্যাশ্যার চাইতেও বেশি ব্যবসা করে। এই সিনেমার গানগুলো অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। সিনেমাটির দুই ভাগে কাজলকে দুই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় এবং দুটো চরিত্রই দর্শকদের মুগ্ধ করে। এই সিনেমার মাধ্যমেই কাজল ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডটি পান।
১৯৯৯ সাল ছিল কাজলের জন্য একটা বিশেষ বছর। মিডিয়ার মানুষজন সাধারণত ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় বিয়ে করতে চায় না অথবা বিয়ে করলেও গোপন রাখে। তবে ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় কাজল মিডিয়ারই আরেক অভিনেতা অজয় দেবগানকে বিয়ের ঘোষণা দিয়ে সবাইকে চমকে দেন। বিয়ের পর ২০০১ সালে মুক্তি পায় মাল্টি স্টার নির্ভর সিনেমা ‘কাভি খুশি কাভি গাম’ । এই সিনেমার মাধ্যমে কাজল অর্জন করেন ক্যারিয়ারের তৃতীয় ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার।
প্রতিটি অভিনেত্রীর জীবনেই একটা সময় আসে যখন তাদের চাহিদা কিছুটা কমতে থাকে। ‘চোখের আড়াল মানে মনের আড়াল’– এই প্রবাদটা মিডিয়ার মানুষদের জন্য খুব বেশি প্রযোজ্য। এজন্য মিডিয়ায় টিকে থাকার জন্য অভিনেতা অভিনেত্রীরা সচরাচর স্পট লাইট থেকে নিজেদেরকে আড়াল করতে চান না। কিন্তু কাজল নিজেকে সরিয়ে নেন। উদ্দেশ্য পরিবারকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। মাঝে প্রায় ৫ বছর তার কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি। এই সময়ে তিনি মা হন এবং তার পুরো সময়টা পরিবারকে দেন।
পরে ২০০৬ সালে ‘ফানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে আবার তার প্রত্যাবর্তন ঘটে। অতীতে বেশিরভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রীই দীর্ঘ বিরতীর পর ফিরে এসে সফলতা পায়নি। গুরুত্বপূর্ণ প্লটের উপর নির্মিত ‘ফানা’ সিনেমাটি শুধু ব্যবসায়িক সফলতাই পায়নি একইসাথে সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও সক্ষম হয়। অন্ধ নারীর চরিত্রে অভিনয় করে এই সিনেমার মাধ্যমে কাজল জিতে নেন তার চতুর্থ ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড।
কাজল এর পরের অ্যাওয়ার্ডটি পান ২০১০ সালে শাহরুখ খানের বিপরীতে ‘মাই নেম ইজ খান’ সিনেমার জন্য। ২০১০ সালের পর কাজল আবার মাতৃত্বকালীন অবসরে যান এবং ২০১৫ সালে শাহরুখ খানের বিপরীতে ‘দিলওয়ালে’ সিনেমার মাধ্যমে আবার প্রত্যাবর্তন করেন। সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে বিপুল সফলতা লাভ করে এবং স্ক্রিনে কাজলের উপস্থিতি প্রশংসিত হয়।
পর্দার বাইরেও কিছু কাজে কাজল জড়িত ছিলেন। ২০০৮ সালে জিটিভির একটা রিয়েলিটি শো ‘Rock-N-Roll Family’ এর বিচারক হিসেবে কাজ করেন। নারী ও শিশু বিষয়ক বিভিন্ন মানবিক কর্মকাণ্ডের সাথেও কাজল জড়িত ছিলেন এবং আছেন। ২০০৮ সালে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের পুরস্কার হিসেবে পান ‘কর্মবীর পুরস্কার’। ‘শিক্ষা’ নামের একটা এনজিও সংস্থা যা কিনা শিশুদের জন্য কাজ করে তাদের সাথেও জড়িত আছেন কাজল।
২০১১ সালে ক্যান্সার আক্রান্তদের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য আয়োজিত একটি ফ্যাশন শো’তে অংশ গ্রহণ করেন কাজল। এছাড়া The Loomba Trust নামে একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড অ্যাম্বসেডর হিসেবে কাজ করছেন যারা কিনা বিধবা মহিলা এবং তাদের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে থাকে। ২০০৭ সালে রেডিফস-এর নির্বাচিত বলিউডের সেরা নায়িকাদের তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করেন। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারতীয় সরকার তাকে ২০১১ সালে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভুষিত করে।
নারীর গুরুত্বপূর্ণ সত্ত্বা হচ্ছে তার মাতৃত্ব। অভিনেত্রী কাজলের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে সাংসারিক জীবনে তিনি সফল। পর্দায় সাবলীল এবং তুমুল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি সবসময় প্রাধান্য দিয়েছেন তার পরিবারকে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেও মেয়ে নাঈসা আর ছেলে যুগের দিকে তাকিয়ে মিডিয়ার লোভনীয় জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন।
এ কারণেই বলিউড অ্যানিমেশন ছবি নির্মাতার ‘মাইটি রাজু লিও কিং’ ছবির পক্ষ থেকে পেয়েছেন মাইটি মম পুরষ্কার। সেই পুরস্কার নিতে গিয়ে কাজল বলেছেন,
পৃথিবীর সব মা-ই শক্তিময়ী মা। তারা সবাই নিজের সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে অশেষ কষ্ট করেন। জানি না আমি একজন শক্তিময়ী মা কি না। তবে হ্যাঁ, সব সময়ই নিজের সন্তানদেরই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছি।
অসাধারণ অভিনেত্রী বিশ্ব এর আগেও অনেক দেখেছে, অসাধারণ মা নিশ্চয়ই পৃথিবীতে কম নেই। তবে দুই দিক সুন্দরভাবে সামলে সফল হওয়া মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে অনেক কমই আছেন। কাজল দেবগান সেই অল্প সংখ্যক মানুষদের মাঝে একজন।
ফিচার ছবি- Medium