কাম্বালা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের অতি পরিচিত এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এই উৎসব পালন করে থাকেন দক্ষিণ কন্নড়, মাঙ্গালোর এবং উদুপি জেলার মানুষজন। কাম্বালা উৎসব মূলত মহিষদের দৌড় প্রতিযোগিতাকে উপলক্ষ করে আয়োজিত হয়। উৎসবের প্রথা অনুযায়ী, জোড়া দুটি মহিষকে শস্যখেতের মধ্য দিয়ে দৌড় করানো হয়। খেলায় অংশরত মহিষেরা যাতে তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারে তার জন্য কৃষকেরা হাতে চাবুক নিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এই খেলা দেখার জন্য উৎসবস্থানে প্রতি বছর বহু লোক সমাগম হয়।
কাম্বালার ইতিহাস
ধারণা করা হয়, হাজার বছর আগে থেকেই এই উৎসবের শুরু হয়েছিল। শুরুর দিকে উৎসবটি ‘কারগা উৎসব’ নামে পরিচিত ছিল। পরে এটি কাম্বালা উৎসব হিসেবে এটি সকলের মাঝে জনপ্রিয় হতে থাকে। এই উৎসবের গোড়াপত্তন কবে হয়েছিল, তা নিয়েও নানা মতভেদ আছে। এক পক্ষের অভিমত, কাম্বালা উৎসবটি কর্ণাটক রাজ্যের কৃষক সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাবনা থেকে উৎপত্তি। স্থানীয় কৃষকরা কাম্বালা উৎসবটি শিবের অবতারের এক রূপ ভগবান কাদরি মঞ্জুনাথানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে থাকেন। ভগবানকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে যাতে ভাল ফসল উৎপন্ন করা যায় সেই লক্ষ্যে এই উৎসবটি উদযাপন করা হতো। আর এই উৎসবকে ঘিরে যে খেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে, তা শুধুমাত্র কৃষক সম্প্রদায় নিজেদের নির্মল বিনোদনের জন্য আয়োজন করতো বলে মনে করা হয়।
কাম্বালার উৎপত্তি সম্পর্কে আরেক পক্ষের মতামত হল যে, মহিষের দৌড় প্রতিযোগিতা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং শুধুমাত্র তাদের বিনোদনের জন্যই চালু হয়েছিল। কিংবদন্তি চালু রয়েছে যে, হৈশালা রাজাদের উৎসাহে এই উৎসবটির প্রচলন শুরু হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই খেলার মধ্য দিয়ে দৌড়ে অংশ নেয়া মহিষদের মধ্যে থেকে সবল ও শক্তিমান মহিষ বেছে নেয়া আর পরবর্তীতে এসব মহিষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলা। প্রথমে হৈশালের রাজারা নিতান্তই খেলাচ্ছলে এই খেলার আয়োজন করলেও মহিষদের দৌড়ানোর গতি এবং একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেখে তারাও অবাক হয়ে যান।
এভাবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাটি ধীরে ধীরে আরো বিস্তৃত ও উন্নত হতে থাকে। পরে সেই ঐতিহ্য ওই অঞ্চলের সামন্ত শাসকদের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে খেলাটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে তা আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলোর সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং পরবর্তীতে সাধারণ মানুষেরাই খেলার নিয়মকানুন সব নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।
যেসব এলাকায় কাম্বালা উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে
কন্নড় জেলার মাঙ্গালোর নামক স্থানে সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরে কাম্বালা উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে। একসময় রাজারা এই উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক থাকলেও পরে স্থানীয় জমিদার এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এই উৎসবের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করেন। আর যেসব স্থানে এই উৎসবটি বেশ জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়ে থাকে, তার মধ্যে মানজেশ্বরা, বাজাগোলি, বরদি বেঁদু, বোলান্তুর, কলাত্তো মাজলু, পুত্তুর, উপপিনগাদি, কাকিপদ্মভূ প্রভৃতি স্থান উল্লেখযোগ্য। এই উৎসবে আয়োজিত দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রায় ১২০-১৫০ জোড়া মহিষ অংশগ্রহণ করে আর এই খেলা দেখতে প্রায় ১৫,০০০ এর উপর স্থানীয় জনগণ ভিড় করে। প্রথমদিকে মহিষের এই দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়ী মহিষের মালিককে নারকেল এবং এবং অন্য কিছু দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। পরে সেসব উপহার সামগ্রীর পরিবর্তে বিজয়ীকে স্বর্ণপদক এবং ট্রফি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
কাম্বালা উৎসবের ভিন্নতা
ঐতিহ্যগতভাবে, দুই ধরনের কাম্বাল উৎসবের কথা জানা যায়।
১. পুকারে কাম্বালা উৎসব
২. বালে কাম্বালা
বালে কাম্বালা উৎসবটি প্রায় ৯০০ বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই যে কাম্বালা উৎসবটি বর্তমানে চালু রয়েছে, তা হলো পুকারে কাম্বালা। কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চলে পুকারে কাম্বালায় নানাভাবে পালিত হয়ে থাকে।
এই খেলাকে আবার চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।
১. নেজিলু
এই শ্রেণিটি মহিষের দৌড় প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে পরিচিত। খেলায় প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণরত মহিষদের এই শ্রেণিতে রাখা হয়। এই বিভাগে জুনিয়র এবং সিনিয়র রাউন্ড আছে। অংশগ্রহণরত এক জোড়া মহিষকে লাঙ্গলের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। এই লাঙ্গল ফসলের মাঠ প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত লাঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে খেলায় ব্যবহৃত কাঠের তৈরি লাঙ্গলটি খেলার উপযোগী করে তৈরি করে নেয়া হয়। এই লাঙ্গল এবং মহিষ জোড়াকে নিয়ন্ত্রণের ভার থাকে সেই মহিষদের মালিক বা কৃষকের ওপর।
২. হাজ্জা
খেলার এই বিভাগে সাধারণত পূর্বে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন সব মহিষদের অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়। এই বিভাগেও জুনিয়র এবং সিনিয়র রাউন্ড আছে। নেজিলু বিভাগে অংশগ্রহণরত মহিষদের চেয়ে হাজ্জাতে অংশগ্রহণরত মহিষরা অনেক দ্রুত গতিসম্পন্ন হয়। খেলার নিয়মকানুন হচ্ছে, মহিষ দুটোকে দড়ির সাহায্যে সরাসরি বাঁধা হয় আর দড়ির অপর প্রান্ত অংশগ্রহণরত কৃষকের হাতে থাকে। এই দড়ির সাহায্যে তিনি মহিষ দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
৩. আদ্দা হালেজ
এই বিভাগে মূলত পূর্বে অংশগ্রহণ করেছে, এমন অভিজ্ঞ কৃষক ও মহিষদেরই অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এই বিভাগটি শুধুমাত্র সিনিয়রদের জন্য প্রযোজ্য। এখানে একটি কাঠের তৈরী কাঠামোর সাথে দুটো মহিষকে যুক্ত রাখা হয়। দৌড় শুরু হওয়ার পর সেই কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে কৃষক তার মহিষ দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
৪. কেইন হালেজ
এই বিভাগে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কৃষক এবং মহিষ অংশগ্রহণ করে। সাধারণত পানিযুক্ত কর্দমাক্ত মাঠ এখানে ব্যবহৃত হয়। এই বিভাগের নিয়মকানুন অন্য সব বিভাগের চেয়ে একদম আলাদা। এই বিভাগে একটি বৃত্তাকার কাঠ ব্যবহার করা হয়। কৃষক তার একটি পা এই কাঠের উপর রাখে। কাঠের নিচের দিকে দুটো গর্ত রয়েছে। মহিষ দুটো যখন দৌড়াতে শুরু করে, তখন এই দুটো গর্ত দিয়ে খেলার মাঠের পানি ছিটকে বেরিয়ে আসে।
কাঠের এই দুটো গর্ত দিয়ে যে পরিমাণ পানি ছিটকে বেরিয়ে যায়, তার উচ্চতা পরিমাপ করে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়। মহিষ জোড়া যত দ্রুত দৌড়াতে থাকে, ততই পানি কাঠের দুটো গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। আর সেজন্য কৃষক সবসময় চেষ্টা করে তার মহিষ দুটোকে দ্রুত দৌড়ানোর। সাধারণত, ট্র্যাকের মাঝখানে, সাদা কাপড়ের দুটি দড়ি জুড়ে দেয়া হয়। এই দড়ি দৌড়ানোর সময় পানির উচ্চতা পরিমাপে ব্যবহৃত হয়।
যে মহিষ জোড়া সাদা দড়ির কাছাকাছি পানি পৌঁছে দিতে পারে, তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এভাবে যদি একাধিক অংশগ্রহণকারী এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারে, তবে এই কৃতিত্ব অর্জনকারী সকলকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
কেইন হালেজ ও আদ্দা হালেজ বিভাগে খুব অভিজ্ঞ মহিষ এবং কৃষকদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। তাই এই বিভাগে খুব কম প্রতিযোগীই পাওয়া যায়।
এই খেলার জন্য ব্যবহৃত মোষের যত্নআত্তি
খেলার শুরু আগে মহিষের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মতো গতি আছে কি না, তার পরীক্ষা করা হয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য মহিষদেরকে উন্নতমানের খাবার দেয়া হয় এবং তাদের শরীরের দিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখা হয়। অনেকে আবার প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি হিসেবে তার নিজস্ব জায়গায় জলাভূমি তৈরি করে তার মাঝে মহিষদের দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত করতে থাকে।
কাম্বালা কতটুকু নিরাপদ?
এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সময় নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দ্রুত দৌড়ানোর জন্য অনেক চাষী মহিষদের ওপর নানারকম অত্যাচার করে, যা মাঝে মাঝে বীভৎস রূপ নেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দৌড়ানোর সময় মহিষেরা একে অপরের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। খেলায় চাষীরা যখন তাদের মোষের সাথে দৌড়াতে থাকে, তখন অনেক সময় চাষীরা পড়ে গিয়ে বড় ধরনের আঘাত পেয়ে থাকেন। আর এজন্য প্রতিযোগিতার শুরু থেকে আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়।
বিতর্ক শুরু হলো যেভাবে
প্রাচীন এই উৎসবে মোষ দৌড়ের খেলাটি নিয়ে পশু প্রেমিক এবং পশু রক্ষাকারী বিভিন্ন সংগঠন বহু বছর ধরে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করে আসছিল। এই খেলার মাধ্যমে পশুদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে বলে তাদের অভিমত। ২০১৪ সালের ৭ মে পশু প্রেমিকেরা ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে পেটা (পিপল ফর দ্য এথিকাল ট্রিটমেন্ট অব অ্যানিমেল) আইনে কাম্বালা উৎসব বন্ধের আর্জি জানায়।
সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে খেলাটি অনির্ষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। তবে ঐতিহ্যবাহী এ খেলা বন্ধ করায় সে সময় অনেকেই একমত হননি। ফলে খেলাটি পুনরায় চালুর ব্যাপারে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে কর্ণাটকের জনগণ। রিট পিটিশনও করা হয় আদালতে। তার পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিতাদেশ দেয় আদালত। পরবর্তীতে দুই পক্ষের শুনানির পর কাম্বালার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ২০১৭ সালে কর্ণাটক বিধানসভায় প্রাণীদের উপর নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধের একটি নতুন বিল পাশ করা হয়, আর তাতে ছাড় দেওয়া হয় কর্নাটকের এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে। ফলে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও এই উৎসব আবার পুনরায় নানা উৎসাহ-উদ্দীপনায় কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়।
ফিচার ইমেজ- gauricosmos.com