বর্তমান সময়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বদৌলতে আমরা নতুন সব ফ্যাশন আর স্টাইলের সাথে পরিচিত হচ্ছি। আর এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ফ্যাশন আইকনদের; যাদের হাত ধরে ফ্যাশন ব্যাপারটি মানুষের সচেতনতার অংশ হয়েছে। বর্তমান সময়ে সেলিব্রেটিরা চাইলেই মুহূর্তের মাঝে নিজের পরখ করা যেকোনো কিছু ভক্তদের সাথে শেয়ার করতে পারছেন এবং নিমিষেই তা পৌঁছে যাচ্ছে ভক্তদের মাঝে।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার আগের যুগে যারা ফ্যাশন আইকন ছিলেন, তাদের জন্য এই ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। তবে, বর্তমানে মানুষ সমালোচনাতেই বেশি পটু। একজন ফ্যাশন আইকনের লাল কার্পেটে হাঁটা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে পাপারাজ্জিরা মেতে থাকে। কিন্তু আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মের ফ্যাশন আইকনদের পোশাক আর স্টাইলগুলো সাধারণ মানুষ সহজেই পছন্দ করতো। এসব আইকনরা ব্যক্তিগত জীবনেও সফল ছিলেন, তাদের ‘ফ্যাশন সেন্স’ তাদেরকে আলাদাভাবে সবার মধ্যমণি করে রাখতো। তাই আজকে থাকছে এমন কয়েকজন ফ্যাশন আইকনের গল্প।
১. অড্রি হেপবার্ন
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে হেপবার্নের মতো করে কেউ হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি। ফ্যাশন সম্পর্কে তার সচেতনতা আর দীপ্তিময় দেহসৌষ্ঠব তাকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। হুবার্ট ডি গিভেঞ্চি, আইজ্যাক মিজরাহিরা তাই যুগ-যুগ পরেও নিজেদের পোশাকে কোনো না কোনোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন হেপবার্নের প্রতিচ্ছবিকে। ১৯৯৩ সালে মৃত্যুর পরও তার প্রভাব রয়ে গেছে, ভিক্টোরিয়া বেকহাম, জনি ডেপদের এবং অলসেন টুইনদের (মেরি কেইট অলসেন, এলিজাবেথ অলসেন) মতো তারকাদের মাঝে।
তার পরিচ্ছদের ভেতর সবচেয়ে জনপ্রিয় ছোটো কালো পোশাকটি যখন পরে তিনি বেরিয়েছিলেন, মুহূর্তের ভেতর ব্যাপারটি সবার নজর কেড়ে নেয়। কতটুকু কাপড় জড়িয়েছেন সেটা মুখ্য নয়, বরং তার পোশাক সচেতনতার ব্যাপারটি ছিল সহজাত। যেন এমনটাই হওয়ার কথা তার বেলায়।
ফ্যাশনের বিচিত্র্যতা আর পরিচ্ছদের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে সবার মাঝে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। তার সেই বিখ্যাত কালো পোশাকের ধারণাটি ছিল একেবারেই সাধারণ আর ছিমছাম। একটা ছোটো কালো পোশাক, ব্যাস! আর কিছুই তো নয়। তখন থেকে আধুনিক হয়েছে সবকিছু, পোশাকের ধারায় এসেছে পরিবর্তন। কিন্তু সেই কালো পোশাকটি হয়তো যুগের পর যুগ আধুনিকই রয়ে যাবে!
২. ডায়ানা রস
১৯৪৪ সালে জন্ম নেয়া এই আমেরিকান গায়িকা তার অ্যালবামের মাধ্যমে নিজের পোশাককে তুলে ধরেছিলেন একে-একে। সত্তর থেকে আশির দশকের দিনগুলোতে গানের মঞ্চে তার আবির্ভাব ঘটতো নতুন কোনো পোশাকের হাত ধরে। কস্টিউম আর দৈনন্দিন জীবনের পোশাকের মাঝে যে কোনো ভিন্নতা হতে পারে না, তার ধারণা দিয়েছিলেন ডায়ানা। বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বব মিকির করা ডিজাইনের অনেকগুলো পোশাকে ডায়ানার পরিচ্ছদ স্টাইলের ছাপ ছিল স্পষ্ট। পেশাগত জীবনে ডায়ানা ছিলেন ‘দ্য সুপ্রিমে’ এর ভোকালিস্ট, এছাড়াও তিনি ছিলেন অভিনেত্রী এবং একজন প্রযোজক।
বলা বাহুল্য, তার ফ্যাশন নিয়ে এমন চেতনা হঠাৎ করেই উদয় হয়নি, তিনি নিজেও একসময় ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু নিয়তি তাকে একজন গায়িকা বানালেও এক ঢিলে দুই পাখি মারতে তিনি ভুল করেননি। যার ফলশ্রুতিতে বব মেকির হাত ধরে আমরা পেয়েছি কালজয়ী কিছু পরিচ্ছদ যেগুলোয় ডায়ানার ছোঁয়া পেয়ে পৌঁছে অন্য উচ্চতায়।
৩. এলিজাবেথ টেইলর
এলিজাবেথ টেইলরকে অনেকগুলো কারণে স্মৃতিপটে নিয়ে আসা যেতে পারে। রুপালি পর্দার রানী, আবেদনময়ী, সৌন্দর্যের রানী কিংবা অনেক কিছুই বলা যেতে পারে। এলিজাবেথের জন্ম ১৯৩২ সালে লন্ডন শহরে, পেশায় অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। নিজের অভিনয় ক্যারিয়ারে সেইসময়ের সেরা কিছু সিনেমার উপহার দিয়েছিলেন এলিজাবেথ, পেয়েছিলেন সেরা অভিনেত্রীর তকমাও। নিজেকে একজন ফ্যাশন আইডল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন সবসময়। তার ফ্যাশন সচেতনতা আর গ্ল্যামার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। সিনেমার পর্দায় এলিজাবেথের আবির্ভাব ঘটতো নিত্যনতুন সব পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে। শুধু সিনেমাতেই নয়, তার ফ্যাশন সচেতনটা প্রকাশ পেত নিত্যদিনের পোশাকেও। হোক সেটা সাঁতার কিংবা একান্ত সময় পার করার ক্ষেত্রে । প্রতিটি পোশাকের মাঝেই তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনার ছাপ ফুটে উঠত।
মানুষ এসব পোশাক ধারণাকে একান্ত নিজেদের করে নিয়েছে, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় বহুবছর পর আজকের এই সময়ে এসেও। দৈনন্দিন জীবনে গ্ল্যামারকে নিজের সহজাত করে নেয়া এই ফ্যাশন আইকন সবসময়ই ডায়মন্ডের নেকলেস গলায় জড়িয়ে রাখতেন। এটা কি পোশাকের সাথে মানানসই কিনা সেটা দেখার বিষয় নয়, নেকলেস ছাড়া তাকে অপূর্ণাঙ্গ লাগতো এটাই ভাববার বিষয়!
৪. ম্যাডোনা
ম্যাটেরিয়াল গার্ল, পপের রানী- এই তকমাগুলো কেবল ম্যাডোনার বেলাতেই খাটে। সত্তর-আশির দশক পেরিয়ে তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি মঞ্চ মাতিয়েছেন। এটা তার ক্যারিয়ারের শুরু নয়, শুরুটা হয়েছিল একজন স্বপ্নবাজ তরুণীর নর্তকী হওয়ার মাধ্যমে। সত্তরের শুরুতে সর্বপ্রথম নিউইয়র্কে পা রাখেন এই তরুণী একজন বিশ্ববিদ্যালয় ড্রপআউট হিসেবে। ভাগ্যের সন্ধানে নেমে বেছে নেন নর্তকীর পেশা। কিন্তু এটাই তার লক্ষ্য ছিল না, তিনি এখানে এসেছিলেন আরও বড় কিছু হওয়ার জন্য। সেই তাড়নায় ম্যাডোনা সর্বপ্রথম ১৯৮৩ সালে তার একক পপ মিউজিকের এলবাম বের করেন। এটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ম্যাডোনা বুঝতে পারেন তিনি নিউইয়র্ক কাঁপাতে এসেছেন।
দর্শকদের সামনে তার ফ্যাশন লুক সবার নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। রাতারাতি তার আউটফিট বিখ্যাত বনে যায় এবং ট্রেন্ড হিসেবে দ্রুত সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। এমন ঘটনাই একজন নতুন ম্যাডোনাকে জন্ম দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। পপ মিউজিকের তালে-তালে নাচ আর নিত্যনতুন সব ফ্যাশনেবল আউটফিটের মাধ্যমে দর্শকদের মাতিয়ে রাখতেন ম্যাডোনা। একজন আর্টিস্টের পোশাক ব্যবহারে নতুন সংজ্ঞা নিয়ে আসেন তিনি। তার পোশাকগুলোর ভেতর গান এবং পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো উপাদান থাকতো, যার কারণে আর্টিস্টের পোশাক ব্যবহারে নতুন করে সবাইকে আরেকবার ভাবায়।
প্রতিনিয়তই নিজেকে বদলেছেন ম্যাডোনা, পোশাকের ক্রমবিকাশের সঙ্গী করে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অন্যরকম এক উচ্চতায়। তার কাজের সঙ্গী হয়েছিলেন জিন পল গলটিয়ের, ডোনাটেলা ভারসেক এবং জেরেমি স্কট এর মতো ফ্যাশন ডিজাইনাররা। গান নিয়ে বিশ্বভ্রমণ আর সাথে নিত্যনতুন সব চমকপ্রদ ফ্যাশন ডিজাইনের সাথে বিশ্বকে পরিচিত করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার যাত্রা পূর্ণতা পেয়েছিল।
৫. মেরিলিন মনরো
গ্ল্যামার, সৌন্দর্য আর ক্যামেরার সামনে আবেদনময়ী উপস্থাপনা; মেরিলিন মনরোর জন্য হলিউডে যাত্রাটা ছিল স্বপ্নের মতো। ১৯২৬ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে জন্মগ্রহণ করেন হলিউডের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আবেদনময়ী এই অভিনেত্রী। ক্যারিয়ারে তার যাত্রাটা হয়েছিল একজন মডেল হিসেবে। তারপর নজরে আসেন টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের বেন লিয়নের; তারপরের যাত্রাটা সিনেমার জন্য একটি ইতিহাস। সিনেমার পর্দায় মনরোর আবির্ভাব ঘটতো একজন অভিনেত্রী এবং ফ্যাশন আইকন হিসেবে।
প্রতিনিয়ত পোশাকে চমক তৈরি করতে থাকা মনরোর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। দর্শকরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতো কখন মনরো নতুন কোনো আউটফিট নিয়ে সবার সামনে হাজির হবে! তার সবচেয়ে বিখ্যাত পোশাকটি ছিল সাবওয়েতে দাঁড়ানো অবস্থায় যখন বাতাস তার পোশাকটি নিয়ে দুষ্টুমি করছিল, আর সে হাত দিয়ে সেটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছিল! বর্তমান সময়ে এসেও পোশাক আর আবেদনময়তার এমন মিশ্রণ কেউ তৈরি করতে পারেনি। হয়তো পারবেও না, এটা একান্ত মেরিলিন মনরোর সিক্রেট রেসিপি !