বিয়ের পোশাক পরিহিত অবস্থায় সেন্ট্রাল পার্কে হাজির হলো র্যাচেল গ্রিন। ২৪ বছর বয়সে বাবা-মায়ের পছন্দ করা সুযোগ্য পাত্রকে বিয়ে করে, স্বামীর সাথে ভালোবাসাহীন একটি আপাত সুখী পরিবার গড়ে তুলতে পারত সে। কিন্তু তার বদলে বড় শহরে বিকল্প জীবনের সন্ধানে পাড়ি জমানোকেই শ্রেয়তর মনে হয়েছে তার কাছে।
খানিক বাদে হাই-স্কুলের বন্ধু মনিকা গেলারের কিচেন টেবিলে দেখা গেল তাকে। সেখানে মনিকা ছাড়াও উপস্থিত রয়েছে ফিবি বুফে, জোয়ি ট্রিবিয়ানি, চ্যান্ডলার বিং এবং মনিকার ভাই রস গেলার। সকলের প্ররোচনা ও প্রণোদনায় বাবার বিল মেটানো ক্রেডিড কার্ডটি কেটে ফেলল সে। এখন থেকে মনিকার সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকবে সে, শুরু করবে এক বাঁধনছাড়া, স্বাধীন জীবন।
র্যাচেলকে উদ্দেশ্য করে মনিকা বলল, “স্বাগতম বাস্তব জীবনে! এটা জঘন্য। তুই এটাকে ভালোবাসতে চলেছিস।”
ঠিক এভাবেই, আজ থেকে ২৫ বছর আগে, ১৯৯৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এনবিসিতে প্রচার শুরু হয়েছিল ‘ফ্রেন্ডস’ নামক টিভি সিরিজটির। চলেছিল মোট দশ সিজন ধরে, ২০০৪ সালের ৬ মে পর্যন্ত। দ্য রেমব্র্যান্ডসের ‘আই উইল বি দেয়ার ফর ইউ’ গানটিকে থিম হিসেবে নির্বাচনের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল, ঠিক কী হতে চলেছে সিরিজটির বিষয়বস্তু: যখন আপনার পাশে আর কেউ থাকবে না, তখনো বন্ধুদেরকেই পাশে পাবেন আপনি।
২৫ বছর আগে শুরু হওয়া সিরিজটি শেষ হয়েছে, তা-ও ১৫ বছরের বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু র্যাচেল, মনিকা, ফিবি, জোয়ি, চ্যান্ডলার, রসরা কি এখনো হারিয়ে গেছে দর্শকের হৃদয় থেকে? একদমই না। বরং এই এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও, তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার এই সিরিজটি এখনো রয়েছে স্বমহিমায় জ্বাজল্যমান। ২০১৮ সালেও যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং শো ছিল এটিই। আর যুক্তরাষ্ট্রে দ্য অফিসের পর এটিই ছিল নেটফ্লিক্সে দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম শো।
২০১৯ সালে নিজেদের প্ল্যাটফর্মে ফ্রেন্ডসকে রাখতে ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে নেটফ্লিক্স। কিন্তু ৪২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ২০২০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এটির স্ট্রিমিং স্বত্ব নিজেদের করে নিয়েছে এইচবিও ম্যাক্স। তবে আশা করা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অন্তত আরো কয়েক বছরের জন্য নেটফ্লিক্সেই দেখা যাবে সিরিজটি। কিন্তু নেটফ্লিক্স যদি সেই সুযোগও হারায়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ প্রতি বছর হাজার হাজার অরিজিনাল কনটেন্ট নির্মাণের এই যুগেও, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর কাছে আজো ফ্রেন্ডসই যে সত্যিকারের স্বর্ণখনি।
নির্মাতারাই সাফল্যের স্বাদ বঞ্চিত
ফ্রেন্ডস সিরিজটি যারা দেখেছেন, হোক তা পুরো দশ সিজনই বা কয়েক সিজন কিংবা নিছকই অল্প কিছু এপিসোড, আপনাদের কাছে একটি প্রশ্ন: ফ্রেন্ডসের কথা শুনলেই আপনাদের মাথায় কোন জিনিসটি আসে? নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, কেউ বলবেন রস-র্যাচেলের অন-এগেইন-অফ-এগেইন সম্পর্কের কথা, কেউ চ্যান্ডলারের সারকাজমের কথা, কেউ বা আবার ফিবির অদ্ভুতুড়ে গানের কথা। পারফেকশনিস্ট মনিকার খুঁতখুঁতে স্বভাব, জোয়ির সফল অভিনেতা হবার সংগ্রাম, চ্যান্ডলার-জোয়ির ব্রোমান্সের কথাও অনেকে বলবেন। এমনকি আর সবকিছুকে ছাপিয়ে অনেকের কাছে মুখ্য চরিত্র হয়ে ধরা দিতে পারে নির্জীব হয়েও ভীষণ রকমের জীবন্ত সেন্ট্রাল পার্ক।
কিন্তু যাদের কথা আপনাদের প্রায় কারোই মনে আসবে না, তারা হলেন সেই মানুষগুলো, যারা ফ্রেন্ডসের মূল কারিগর। এই সিরিজের সকল চরিত্র ও ঘটনা যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত, এবং যারা না থাকলে ফ্রেন্ডস নামক এই সিরিজটির জন্মই হতো না। বলছি এই সিরিজটির নির্মাতাদের কথা। টিভি বা ওয়েব সিরিজের নির্মাতা বলতে অবশ্য পরিচালকদের বোঝানো হয় না, বোঝানো হয় সেই ব্যক্তিদেরকে, যারা সিরিজের চরিত্র, কাহিনী, ঘটনাক্রম সৃষ্টি করেন, এবং শুটিং ও শুটিং পরবর্তীকালে গোটা বিষয়টির তত্ত্বাবধায়ন করেন। পর্দায় এই নির্মাতাদের ক্রেডিট দেয়া হয় ‘ক্রিয়েটর’ হিসেবে।
তো, ফ্রেন্ডসের ক্রিয়েটর বা নির্মাতা কারা? এই মুহূর্তে হয়তো তাদের নাম আপনাদের মনে পড়বে না, তবে পর্দায় অবশ্যই তাদের নাম আপনারা অসংখ্যবার দেখেছেন। তারা হলেন ডেভিড ক্রেইন ও মার্তা কাফম্যান। বাস্তবজীবনের এই দুই বন্ধু সিটকমটির নির্বাহী প্রযোজক ও লেখকের ভূমিকাও পালন করেছেন। পাশাপাশি কাফম্যান ছিলেন অন্যতম কাস্টিং ডিরেক্টর এবং এক্সট্রাও।
কিন্তু তারপরও যে আপনারা আপনাদের প্রিয় সিরিজটির নির্মাতাদের নাম জানেন না, সেটি কিন্তু খুব বিস্ময়কর কিছু নয়। কেননা সাহিত্য ও বিনোদন জগতের রূঢ় বাস্তবতাই এটি। যখন কোনো সৃষ্টি অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায়, সেটি তার সৃষ্টিকর্তাকেও ছাপিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ সৃষ্টিটি নিয়েই মাতামাতি করে, সৃষ্টির নেপথ্যের ব্যক্তিদের কথা বেমালুম ভুলে যায়। এক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ টানতে পারি স্যার আর্থার কোনান ডয়েলেরও। তার সৃষ্ট শার্লক হোমস চরিত্রটি এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, পাদপ্রদীপের আলো সবটাই নিয়ে নিচ্ছিল ওই কাল্পনিক চরিত্রটিই। অথচ রক্ত-মাংসের কোনান ডয়েল পড়ে থাকছিলেন পেছনে। এক পর্যায়ে ত্যক্ত-বিরক্ত ও খানিকটা ঈর্ষান্বিত কোনান ডয়েল তো শার্লককে মেরেও ফেলেছিলেন, যদিও পরবর্তীতে আবারো তিনি বাধ্য হন শার্লককে ফিরিয়ে আনতে।
সৃষ্টিশীল ব্যক্তি হিসেবে কাফম্যান ও ক্রেইনও বিষয়টি খুব ভালোভাবেই জানতেন। বাস্তবতাটিকে তারা মেনেও নিয়েছিলেন। ফ্রেন্ডস যখন টিভিতে প্রচার হচ্ছে, তখন সেখানে অভিনয় করা প্রধান শিল্পীদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। জেনিফার অ্যানিস্টন, কোর্টনি কক্স, লিসা কুড্রো, ম্যাট লেব্ল্যাঙ্ক, ম্যাথু পেরি ও ডেভিড স্কুইমাররা যেখানেই যান, লোকজন ঘিরে ধরে তাদের। এয়ারপোর্টে তাদের এক নজর দেখার জন্য শত শত মানুষের ভিড়। অথচ যে মানুষ দুইটির কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে পর্দার অভিনেতারা এতটা খ্যাতি লাভ করেছেন, তাদেরকে কেউ এমনকি চিনতও না।
তবে এ নিয়ে দুঃখবিলাস বা হতাশায় ভোগার অবকাশটুকুও ছিল না নির্মাতাদের। কারণ তাদের কাছে সাধারণ মানুষের স্বীকৃতি পাওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল নিজেদের কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, পরবর্তী এপিসোডের জন্য কাহিনী ও উপাদান সংগ্রহ করে। এ প্রসঙ্গে কাফম্যান অকপটে বলেন,
“সত্যি কথা হলো, লেখক হিসেবে আমরা কখনোই আসলে ফ্রেন্ডসের সাফল্যের অভিজ্ঞতাটুকু লাভের সুযোগ পাইনি। বিষয়টি এমন ছিল না যে আমরা এয়ারপোর্টে গিয়েছি আর মানুষজন আমাদের চিনে ফেলেছে। আমাদের জন্য শুধু কাজ করে যাওয়াটাই মুখ্য ছিল। সাফল্য ও ভক্তদের নিয়ে ভাবার সুযোগ আমরা পাইনি, কারণ আমাদের মাথায় সবসময় চিন্তা থাকত কীভাবে পরের এপিসোডটিকে আগেরটির চেয়েও ভালোভাবে নির্মাণ করা যায়। প্রতিটা মুহূর্তই আমাদের এ নিয়ে চাপের মধ্যে থাকতে হতো।”
যেভাবে জন্মলাভ করে ফ্রেন্ডসের ধারণা
১৯৯৩ সালের কথা। সাইনফেল্ডের সাফল্যের পর এনবিসি তখন সন্ধানে রয়েছে নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী এক দল বন্ধু নিয়ে আরো একটি শোয়ের। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব সিটকম জনপ্রিয় ছিল, যেমন রোজঅ্যান, ফুল হাউজ, দ্য ফ্রেশ প্রিন্স অভ বেল এয়ার এবং ম্যাড অ্যাবাউট ইউ – সবই ছিল পরিবার অথবা বিবাহিত জীবনকেন্দ্রিক। সাইনফেল্ডের মাধ্যমে সিটকমের দুনিয়ায় এক তাজা বাতাস এসে হাজির হয়েছিল, এবং এনবিসি চাচ্ছিল সেই বাতাসের তোড়ে আরো কিছু নিশ্চিত সাফল্য অর্জন করে নিতে।
ঠিক তার কিছুকাল আগেই নিউ ইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে এসেছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাফম্যান ও ক্রেইন। নিউ ইয়র্কে তারা ফেলে এসেছেন এমন কয়েকজন বন্ধু, যাদের সাথেও তাদের খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। এছাড়া একদিন লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় কাফম্যান একদিন দেখতে পেলেন একটি কফিশপ, যেখানে সোফা, চেয়ার, টেবিলসহ সব আসবাবপত্র অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে, আর সেখানেই জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী।
এই দুইটি বিষয়কে এক করার মাধ্যমে কাফম্যানের মাথায় খেলা করে গেল নতুন একটি চিন্তা: যখন আপনি পরিবার ছেড়ে শহরে এসে বাস করছেন এবং আপনার জীবনে স্থায়ী কোনো সঙ্গী নেই, তখন বন্ধুরাই তো আপনার সব। বন্ধুরাই তো আপনার পরিবার।
এই চিন্তা কাফম্যান ভাগ করে নিলেন ক্রেইনের সাথে। এরপর ধীরে ধীরে তাদের মাথায় আরো বিস্তৃতভাবে দানা বাঁধতে লাগল ফ্রেন্ডসের ধারণা। নিউ ইয়র্কে তারা একসাথে ছিলেন ছয় বন্ধু, তাই নিজেদের শোয়ের মূল চরিত্রের সংখ্যাও তারা ছয় রাখারই সিদ্ধান্ত নিলেন। সবকিছু মোটামুটি গুছিয়ে এনে তারা তাদের ধারণাটি পেশ করলেন এনবিসির কাছে।
১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে কাফম্যান ও ক্রেইন যখন এনবিসির কাছে সিরিজটি সম্পর্কে সাত পাতার একটি খসড়া জমা দিয়েছিলেন, তখন সিরিজটির প্রাথমিক নামকরণ হয়েছিল ‘ইনসমনিয়া ক্যাফে’। বেশ কয়েকবার চিত্রনাট্য সম্পাদন ও পুনঃসম্পাদনার পর শিরোনাম বদলে হয় ‘সিক্স অভ ওয়ান’, এবং তারপর ‘ফ্রেন্ডস লাইক আস’। তবে শেষমেষ শুধু ফ্রেন্ডস হিসেবে সিরিজটির পাইলট এপিসোডের নির্মাণ শুরু হয়, এবং ফ্রেন্ডস নামটিই সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয় মূল নাম হিসেবে।
নারী হিসেবে টিভিতে কাজের অভিজ্ঞতা
সহকর্মী হিসেবে ক্রেইন ছিলেন বটে, কিন্তু ফ্রেন্ডস সিরিজটি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল কাফম্যানেরই। এবং তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই, তিনিই বিবেচিত হতেন জাহাজের প্রধান নাবিক হিসেবে। কিন্তু তার এই ভূমিকা মনঃপুত ছিল না এনবিসির পক্ষ থেকে কাজ করা অনেক ব্যক্তিরই। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের টিভি ইন্ডাস্ট্রি তখনো পুরুষশাসিত, নারীরা বিবেচিত হয় সেকেন্ড-ক্লাস সিটিজেন হিসেবে। অথচ তেমনই একটি ইন্ডাস্ট্রিতে তুমুল জনপ্রিয় একটি সিরিজের প্রধান নির্মাতা এক নারী, তার হুকুম মেনে চলতে হবে বাকি সবাইকে, এটি মানা স্বস্তিদায়ক ছিল না অনেকের পক্ষেই।
নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে কাফম্যান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হার মানতে বাধ্য করেছেন সেইসব পুরুষ সহকর্মীদের, যাদের সাথে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তার সাপে-নেউলে সম্পর্ক সৃষ্টির। কিন্তু একটি বিশেষ ঘটনার কথা কাফম্যান আজো ভুলতে পারেননি।
সেদিন তার পিরিয়ড চলছে। পিরিয়ড ক্র্যাম্পের দরুণ পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে তার। অথচ সেই ব্যথা নিয়ে শুটিং সেটে উপস্থিত হয়েছেন তিনি, কারণ তাকে ছাড়া যে শুটিং সম্ভবই নয়। সবকিছু তদারকি করছেন, পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে নোট নিচ্ছেন। তবু তার অস্বস্তির বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল, যা দেখে শোয়ের এক নির্বাহী প্রযোজক এসে তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি ঠিক আছো তো?” তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি ভালো আছি।” ফের প্রশ্ন আসে, “না, আসলেই, কী সমস্যা?” তিনি তখন বলেন, “আমার ক্র্যাম্প হচ্ছে।” সেটি শুনে ওই নির্বাহী প্রযোজক বলেন, “এ কারণেই আমি নারীদের সাথে কাজ করতে ঘৃণা করি!”
এ কথা শুনে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে কাফম্যান যা বলেন, তা থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায় তার দৃঢ় মানসিকতার বিষয়টি। “আমি আমার কাজটি ঠিকমতোই করে চলেছি। আমার মনে হয় না কোনো পুরুষের যদি পিরিয়ড হতো, সে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তার কাজটি করে যেতে পারত।”
সংগ্রাম সন্তানের মা হিসেবেও
কাফম্যানের লড়াই শুধু শুটিং সেট ও প্রোডাকশন টেবিলে পুরুষ সহকর্মীদের সাথে পাল্লা দেয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সন্তানের মা হিসেবেও তাকে সবদিক সামলাতে হিমশিম খেতে হতো। ফ্রেন্ডস চলাকালীনই সন্তান জন্ম দেন তিনি, ফলে তার কাঁধে চাপে সন্তানদের দেখভাল করার বাড়তি দায়িত্বও। কিন্তু এদিকে ফ্রেন্ডসও তো তার নিজের সন্তানের মতোই। মাঝপথে এটিকে ছেড়ে দিতে পারেন না তিনি। তাই দুদিকেই ভারসাম্য রক্ষা করা তার জন্য হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
পর্দায় কাফম্যান হয়তো জোয়ি বা চ্যান্ডলারের মুখ থেকে দম ফাটানো হাসির সংলাপ বের করে আনছেন, কিন্তু বাস্তবজীবনে তিনি ভুগছেন প্রবল অপরাধবোধে। তার মনে হচ্ছে, এই কাজটি যদি তিনি ছেড়ে দেন, তাহলে সদ্যজাত সন্তানদেরকে আরো বেশি সময় দিতে পারবেন, সন্তানের বেড়ে ওঠার সময়টিতে তাদেরকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিতে পারবেন।
যেসব দিন শুটিং থাকত, দিনে ১২ ঘণ্টা শুধু শুটিংয়েই ব্যয় করতে হতো কাফম্যানকে। সকাল সাতটায় কল-টাইম থাকলে প্যাক-আপ সন্ধ্যা সাতটায়। কিন্তু শুধু তো এ-ই নয়। নির্মাতা হিসেবে প্রোডাকশন টেবিলেও উপস্থিত থাকতে হবে তাকে। সব মিলিয়ে সপ্তাহের প্রতিটি দিনই সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে যেতে হতো তাকে। তবে এতকিছুর পরও তার ভরসার জায়গা ছিল এটি যে, এমন একজন ছিলেন তার জীবনসঙ্গী যিনি দরকারের সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। অবশ্য ২০১৫ সালে সেই স্বামী মাইকেল স্ক্লফের থেকে আলাদা হয়েছেন তিনি, যার সাথে সংসার করেছিলেন দীর্ঘ ৩১ বছর।
ফ্রেন্ডস নিয়ে যে আক্ষেপের জায়গা রয়েছে
দশ সিজনে মোট ২৩৬টি এপিসোড হয়েছে ফ্রেন্ডসের, এবং নির্মাতা হিসেবে প্রতিটির সাথেই সরাসরি জড়িত ছিলেন কাফম্যান। তাই মনে প্রশ্ন জাগা খুব স্বাভাবিক, এ সিরিজের কোনো বিষয় নিয়ে তার মনে আক্ষেপ রয়েছে কি না। এবং হ্যা, আসলেই আক্ষেপ রয়েছে তার।
মোটা দাগে দুইটি এপিসোড নিয়ে তার মনে আফসোস রয়ে গেছে তার, এবং দুটিতেই মুখ্য চরিত্র ছিল লিসা কুড্রো অভিনীত ফিবি। একটি হলো ‘দ্য ওয়ান উইথ দ্য জ্যাম’, যেখানে ফিবি তার বোন আরসুলার স্টকার ম্যালকমের সাথে ডেট করে। অন্যটি ‘দ্য ওয়ান উইথ দ্য চিকেন পক্স’ যেখানে দুইটি সপ্তাহ ফিবি ও রায়ানের রোমান্টিকভাবে কাটানোর কথা থাকলেও, দুজনেই আক্রান্ত হয় চিকেন পক্সে। ২৫ বছর বাদে কাফম্যানের উপলব্ধি, এই দুইটি এপিসোডের কাহিনী ভিন্নভাবে সাজাতে পারতেন তিনি।
বেশিরভাগ সৃষ্টিশীল ব্যক্তিই যেমন তাদের পুরনো সৃষ্টিকর্ম দেখে অস্বস্তিতে ভোগেন, যেমন লেখকরা তাদের পুরনো লেখা পড়ে নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে ভাবেন, “এটি আমি কেন লিখেছি,” সেই একই অনুভূতি হয় কাফম্যানেরও। তাই তো এখন ফ্রেন্ডসের পুরনো এপিসোডগুলো দেখাটা তার জন্য একদমই উপভোগ্য হয় না। বরং কিছুক্ষণ পরপরই তিনি আপনমনে ভাবতে থাকেন, “হায় ঈশ্বর, আমরা এটা হতে দিয়েছিলাম! আমরা এটা করেছিলাম!”
আবার কি ফিরবে ফ্রেন্ডস?
অনেকেই আশা করেন, আবারো যেন পর্দায় ফেরে ফ্রেন্ডস। কিন্তু ফ্রেন্ডসের তেমন কোনো রিবুটের সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন কাফম্যান। কারণ তিনি মনে করেন, ফ্রেন্ডস ছিল এমন একটি সময়ের গল্প, যেখানে বন্ধুরাই ছিল পরিবারের মতো। কিন্তু যখন প্রতিটি ব্যক্তিবিশেষ তার নিজ নিজ পরিবার শুরু করে, তখন পুরো চিত্রটাই খোলনলচে বদলে যায়। তাই ফ্রেন্ডসের চরিত্রদের নিয়ে কোনো রকমের রিবুট বা রিউনিয়ন করা সম্ভব নয় বলেই তার বিশ্বাস।
অবশ্য ফ্রেন্ডসের প্রধান দুই চরিত্র রস আর র্যাচেল কেমন আছে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শেষ পর্যন্ত রস আর র্যাচেলের মধ্যে একটি দারুণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, কিন্তু (তাদের মেয়ে) এমা বর্তমানে থেরাপিতে আছে।” কে জানে, এর পেছনে কারণ কি বাবা-মায়ের সাথে অশান্তি নাকি অন্য কিছু। এবং এ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, ফ্রেন্ডসের চরিত্ররা সরাসরি না ফিরলেও, এমা ও তার বন্ধুদের নিয়ে নতুন একটি সিরিজ হয়তো হতেও পারে, যেমনটি হয়েছিল জোয়িকে নিয়ে।
কাফম্যান নেটফ্লিক্সে এখন
সময়টা এখন নেটফ্লিক্সের। বিশ্বখ্যাত নির্মাতা ও পরিচালকরা সবাই ভিড়ছেন নেটফ্লিক্স শিবিরে। অবশ্য কাফম্যান-নেটফ্লিক্স যুগলবন্দি বেশ অনেকদিনের। ২০১৫ সালের মে মাস থেকে নেটফ্লিক্সে চলছে কমেডি সিরিজ ‘গ্রেস অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্কি’। হাওয়ার্ড মরিসের সাথে জুটি বেঁধে এই সিরিজটি নির্মাণ করছেন কাফম্যান। প্রথম সিজনে সমালোচকদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এলেও, দ্বিতীয় সিজন থেকে ইতিবাচক রিভিউই পেয়ে আসছে সিরিজটি। ইতিমধ্যেই পাঁচটি সিজন প্রকাশিত হয়ে গেছে, এবং ভবিষ্যতে আরো দুইটি সিরিজ আসছে। সব মিলিয়ে সাত সিজনে ৯৪টি এপিসোডের মাধ্যমে এটি পরিণত হবে নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলা অরিজিনাল সিরিজে।
৬৩ নট আউট
কাফম্যানের বয়স এখন ৬৩ বছর। ১৯৫৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফিলাডেলফিয়ার শহরতলীতে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা কাফম্যান বিনোদন জগতে কাটিয়ে দিয়েছেন ৩২ বছর। ১৯৮৭ সালে ‘এভরিথিং’স রিলেটিভ’ দিয়ে তার পথচলা শুরু, এবং এরপর একে একে নির্মাণ করেছেন ড্রিম অন, সানডে ডিনার, দ্য পাওয়ারস দ্যাট বি, ফ্যামিলি অ্যালবাম, কাপলসের মতো টিভি সিরিজ ও টিভি মুভি। ফ্রেন্ডস চলাকালীনই নির্মাণ করেছিলে ভেরোনিকা’স ক্লজেট। ফ্রেন্ডস শেষ হওয়ার পর টানা কয়েকটি টিভি শো, টিভি মুভি ও ডকুমেন্টারিতে কেবল নির্বাহী প্রযোজকের ভূমিকা পালন করার পর, ২০১১ সালে তিনি শো নির্মাণে ফেরেন ফাইভের মাধ্যমে। ২০১৩ সালে ফাইভেরই একটি টিভি মুভি সংস্করণও নির্মাণের পর, ২০১৫ সাল থেকে নির্মাণ করছেন গ্রেস অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্কি।
ফ্রেন্ডস শেষ হওয়ার পরের সময়টি খুব একটা সুখকর ছিল না কাফম্যানের জন্য। মধ্যবয়সে নারীদেহে যেসব পরিবর্তন আসতে শুরু করে, জীবনের সেই ধাপটির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকটাই বদলে গেছেন তিনি, যা কিছুটা প্রভাব ফেলেছে তার সৃষ্টিশীলতায়ও। সেজন্যই বোধহয় এখন দুই বৃদ্ধাকে নিয়ে সিরিজ বানাচ্ছেন তিনি, যাদের সাথে তার নিজের মানসিকতাও নানাভাবে খাপ খায়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, এখনো ফুরিয়ে যাননি তিনি, বরং এখনো দর্শকপ্রিয় সৃষ্টিকর্ম উপহার দেয়ার ক্ষমতা অটুট রয়েছে তার মধ্যে।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে প্রায়ই নিজের বুড়িয়ে যাওয়ার কথা বলেন কাফম্যান। হয়তো গ্রেস অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্কি সফলভাবে শেষ করার পর বিনোদন জগতকে বিদায়ও বলে দেবেন তিনি। কিংবা যদি থেকেও যান, কাজের পরিমাণ কমিয়ে দেবেন। কারণ ২৫ বছর বয়সে এসেও ফ্রেন্ডস হয়তো তার তারুণ্য ধরে রাখতে পেরেছে, কিন্তু ফ্রেন্ডসের নেপথ্যের প্রধান ব্যক্তিটি যে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ, আর তাই তাকে তো বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে।
কে জানে, এখন হয়তো কাফম্যান নিজেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বার্ধক্য জীবনের কথা স্মরণ করে নিজেকে বলছেন, “স্বাগতম বার্ধক্য জীবনে! এটা জঘন্য। তুই এটাকে ভালোবাসতে চলেছিস।”
সিনেমা সম্পর্কে জানতে আজই পড়ুন এই বইগুলো
১) Great Movies 100 years of Cinema
২) নতুন সিনেমা সময়ের প্রয়োজন
৩) সিনেমার ঋত্বিক ঋত্বিকের সিনেমা
বিনোদন জগতের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/