ধৈর্য, অধ্যবসায়, সাহস আর উদ্ভাবনী মেধার সমন্বিত রূপ যেন ফটোগ্রাফি। ফটোগ্রাফি একাধারে শখ, আবার নেশা, কখনো বা পেশা। এর টানে কেউ ছুটে যায় উত্তরের মেরুপ্রভাসকাশে, কেউ বা ডুব দেয় গভীর জলরাশির মাঝে। কারো ভোর হয় শুভ্র বরফের উপর, আবার কেউ সূর্যাস্তের বর্ণিল আলোয় তরঙ্গের সগর্জন আছড়ে পড়ার সাক্ষী হয়ে থাকে। কেউ তুলে আনে ঘরোয়া জীবন, আবার কারো লেন্সে ধরা দেয় বুনো ভুবন। আর এভাবেই নানা রূপে, বিভিন্ন ঢঙে প্রতিনিয়ত লিখে যাওয়া চলমান গল্পগুলোকে নিশ্চল ফ্রেমে বন্দী করে রাখছেন পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু ‘পাগলাটে’ ফটোগ্রাফার। ২০১৮ সালের মে মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের বাছাই করা এরকম নয়টি ছবি ও ক্যামেরার পিছনে থাকা সেসব কারিগরদের নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
উত্তরের মেরুপ্রভা আর পরিত্যক্ত ইতিহাস, রাশিয়া
প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে মেরুপ্রভাকে ভোরের দেবী মনে করা হত। গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল, মেরুপ্রভা সূর্যদেবতা হেলিওস ও চন্দ্রদেবতা সেলাইনের বোন; রাতের শেষার্ধে বাহারি রঙের দীপ্তি নিয়ে সে আসে তার ভাই সূর্যকে জাগাতে। শুধু যে গ্রিক আর রোমানরাই এই মেরুপ্রভাতে বুঁদ হয়ে ছিল তা কিন্তু নয়। প্রাচীনকাল থেকে এই মেরুপ্রভা ছিল কারো কাছে রোগ-শোক, দুর্ভিক্ষের (দক্ষিণ ইউরোপে) আলামত, আবার কারো কাছে স্রষ্টার সবিশেষ আশীর্বাদের বার্তা (চীনের উপকথা), কারো কাছে মৃত আত্মাদের গগন সমাবেশ (যুক্তরাষ্ট্রের কিছু আদিবাসীদের কাছে)। বর্তমানে মেরুপ্রভার প্রসিদ্ধি বিশাল আসমান জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার রাঙা আলোকচ্ছটায়। কোটি কোটি ডলারের পর্যটন ব্যবসা আবর্তিত হয় এই মেরুপ্রভাকে ঘিরে। ছবির এই জায়গাটিও এককালে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জাহাজ ও মৎস্যশিল্পের কেন্দ্র ছিল রাশিয়ার উত্তরের তেরিবার্কা গ্রামটি। কিন্তু কালে কালে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার করালগ্রাসে নিপতিত হতে থাকে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য। আর তাই মেরুপ্রভার সৌকর্যচ্ছটা নিয়ে পড়ে থাকা নৌকাগুলো আজ ফটোগ্রাফারদের আগ্রহের বিষয়বস্তু। ‘মেরুপ্রভা শিকারি’ রাশিয়ান ফটোগ্রাফার আনাস্তাসিয়া মালিহ এই ছবিটি নাইকন ডি৬১০ মডেলের ক্যামেরায় তুলে এনেছিলেন।
প্রত্যুষের নিঃশ্বাস, জাপান
জাপানে লাল শিয়ালের দুটি উপপ্রজাতি পাওয়া যায়। একটি হোক্কাইডো উপপ্রজাতির, আরেকটি জাপানিজ রেড ফক্স। ছবির দুটি শিয়াল জাপানের সর্বউত্তরের দ্বীপ হোক্কাইডোর লাল শিয়াল। জাপানে শিয়ালকে বলে কিটসুনে (kitsune; 狐)। জাপানি রূপকথার এক অবিচ্ছেদ্য সাহিত্য উপাদান এই কিটসুনে। শিয়ালকে জাপানিরা বুদ্ধিমত্তা ও অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উৎস বলে মনে করে। এমনকি ইডো সাম্রাজ্যের সময় যে সকল প্রাণীদের জাদুটোনা ও ডাকিনীবিদ্যার অনুষঙ্গ মনে করা হতো তাদের মধ্যে শিয়াল ছিল অন্যতম।১ তবে বদলে গেছে সময়। আর সে কারণেই তো হোক্কাইডোর শ্বেত শুভ্র বরফের উপর ধৈর্যসমেত অপেক্ষা করে এমন অসাধারণ একটি ছবি তুলে এনেছেন জাপানি ফটোগ্রাফার আয়া আইওয়াসাকি।
ডিসেম্বরের ঊষাকাল, কানাডা
উত্তর আমেরিকার পাথুরে পর্বতশ্রেণীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ (সারা বিশ্বে এটি Canadian Rockies নামে পরিচিত) চলে গেছে কানাডার পশ্চিমের ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও আলবার্টার ভিতর দিয়ে।২ ফটোগ্রাফার জিন গং যখন মধ্য ডিসেম্বরে আলবার্টার ক্লিয়ারওয়াটার কাউন্টিতে পৌঁছান, আব্রাহাম লেক তখনও পুরোপুরি বরফাচ্ছাদিত হয়ে উঠতে পারেনি। কুটেনায় সমতলভূমির আধো বরফ আর চিরায়ত ঊষার মনোলোভা সৌকর্যে তিনি একা হারিয়ে যাননি; সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্তের সেই স্থিরচিত্রের মোহনীয় মাধুর্যে পাগল করেছেন অসংখ্য নিসর্গপ্রেমীকেও।
গভীরে ডুব, মেক্সিকো
Freediving- জলরাজ্যের এক রোমাঞ্চকর ডুব সাঁতার। এখানে সাঁতারু কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার না নিয়েই ঝাঁপ দেয় পানির মধ্যে। এক নিঃশ্বাসে ডুব সাঁতার দেওয়ার এক কার্যকর প্রশিক্ষণ ফ্রিডাইভিং। মিশরের ফটোগ্রাফার গিয়াওমে বিহেতের আলোকচ্ছটার অধিবাস্তব আবহের এই ছবিটি পানির প্রায় ২৫ মিটার গভীরে একজোড়া কার্বন ফিনের সাহায্যে ছুটে চলা সাহসী সাঁতারুর; আর স্থান- মেক্সিকোর ইউকাতান। এই ধরনের ডুব সাঁতারে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য সাঁতারুকে পানির উপরে উঠে আসতে হয়। তারপর লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার ডুব।
রূপান্তর, বেলারুশ
কিরিল দুবকোভ নামটা হয়তো সাধারণ্যের কাছে অপরিচিত। কিন্তু বডিবিল্ডিং বা শরীরচর্চার বৈশ্বিক পরিমন্ডলে তিনি (সাবেক) সোভিয়েত আমলের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন; একইসাথে ছিলেন সেদেশের বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট। এককালে নিজের শরীরচর্চা নিয়ে সারাবেলা কাটানো কিরিলের এখনকার সময় কাটে কিভাবে জানেন? অতি দুর্লভ প্রজাতির কুকুর আলাস্কান মালামুটদের লালন-পালনে। কিরিলের মতে, জিমে গিয়ে নিজের শরীরকে পরিচর্যায় রাখার নিত্যকর্মের থেকে তার বর্তমানের এই কাজকে আলাদা কিছু মনে হয় না; বরং অধুনার এই শখ তার কাছে সুখ ও আনন্দের নির্মল উৎস। বেলারুশ ফটোগ্রাফার অ্যান্টোন ডটসেঙ্কোর তোলা এই ছবিটি যেন সারমেয়-মানবের সহস্র প্রাচীন বন্ধুত্বের এক প্রতীকী উপস্থাপন।
ফ্যামিলি টাইম, আফ্রিকা
বনের রাজা শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন। কিন্তু ছোট্ট সিংহ শাবক কি এটা বোঝে যে, এই সময় বাবাকে জ্বালাতন করা যাবে না! তাদের কাছে বাবার বিশাল বপু হলো গড়াগড়ি খেলার এক উপযুক্ত স্থান। সন্তানদের এমন দুষ্টুমিতে বাবা প্রথমবার গর্জন করেছিলেন অবশ্য; কিন্তু সেই গর্জন আমলে নেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেনি দুষ্টু শাবকদ্বয়। সেই মুহূর্তটাই তুলে এনেছিলেন ফটোগ্রাফার এরিক জনসন। ছবির পরের গল্পটি এরিক বর্ণনা করেছেন এভাবে,
"এদের বুঝিয়ে আসলে কোনো লাভ নেই- এমন একটা সান্ত্বনা নিয়ে আবার শুয়ে পড়ে বেচারা বাবা সিংহ; অন্যদিকে মহানন্দে তার গায়ের উপর দিয়ে হুটোপুটি আর লাফালাফিতে ব্যস্ত সময় কাটায় চঞ্চল শাবক দুটি।"
স্বাধীনতার বহুমাত্রিকতা, পর্তুগাল
অ্যাইডান উইলিয়ামসের তোলা এই ছবিটি যেন স্বাধীনতার এক বহুমাত্রিক উপস্থাপন। এই স্বাধীনতা প্রতিদিনকার সূর্যাস্তের নিয়মমাফিক স্বাধীনতা; এই স্বাধীনতা লুকিয়ে আছে পর্তুগালের নাজারে সমুদ্র সৈকতে প্রবল বেগে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাঝে; এই স্বাধীনতা প্রোথিত অভিযাত্রিক আন্দ্রে কারের দড়াবাজির সাহসিকতায়। নাজারের বেলাভূমি শক্তিশালী সুউচ্চ ঢেউয়ের জন্য বিখ্যাত।
করাকলের পাঞ্জেরি, ভিয়েতনাম
বিন থুয়ান ভিয়েতনামের এক উপকূলীয় অঞ্চল। এখানকার মৎস্যজীবীরা করাকল নামের এক বিশেষ ধরনের গোলাকার, হালকা নৌকা ব্যবহার করে। বিন থুয়ানের বড় বড় ঢেউয়ের বিপরীতে করাকলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এখানকার জেলেদের আছে অসাধারণ পারদর্শিতা। উপরের ছবিতে দুজন জেলেকে দেখা যাচ্ছে যারা প্রবল ঢেউয়ের প্রতিকূলে তাদের করাকলকে পানিতে ভাসানোর চেষ্টা করছেন।
আফ্রিকার নির্ভয় বুনোপথ, দক্ষিণ আফ্রিকা
আসলেই এক সুবিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত আফ্রিকার দক্ষিণে অবস্থিত কেগালাগাদি আন্তঃসীমান্ত অভয়ারণ্য। প্রায় ১৫ হাজার বর্গ মাইল ক্ষেত্রফলের এই অভয়ারণ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বোতসোয়ানার যৌথ অংশীদারিত্ব রয়েছে। ফটোগ্রাফার হামিশ মিচেলের এই ছবিটি দক্ষিণ আফ্রিকার এডেনভিলে তোলা। সাধারণত এখানকার প্রাণীদের কোনো খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় না। তারা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায় নীল আকাশের নিচে আফ্রিকার বুনোপথে এই জিরাফদের মতো সব সময়।
ফিচার ইমেজ: Edited by writer
ফুটনোট:
১। Casal, U. A. (1959). The goblin fox and badger and other witch animals of Japan. Folklore Studies, 18, 1-93.
২। Gadd, Ben (1995). Handbook of the Canadian Rockies. Jasper, Alberta, Canada: Corax Press, 2nd Edition, ISBN: 0-9692631-1-2.