অক্টোবর মাস জুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ইংক্টোবার হ্যাশট্যাগের ছড়াছড়ি। কিন্তু এই জিনিসটা আসলে কী? খুব ছোট করে বলতে গেলে, ইংক্টোবার হচ্ছে একজন শিল্পীর শিল্পসত্ত্বাকে ইতিবাচক অভ্যাস এবং সৃজনশীলতাকে অনুপ্রেরণা দেয়ার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা একটি মাসব্যাপী উৎসব। জেক পার্কার নামে একজন শিল্পী ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে এর প্রবর্তন করেন। তারপর থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসে প্রায় সারা বিশ্বেই ঘটা করে পালন করা হয় ইংক্টোবার উৎসব।
জেক পার্কার উতাহের একজন শিল্পী। তিনি একজন ইলাস্ট্রেটর, অ্যানিমেটর এবং কমিকসের জন্যও গল্প তৈরি করেন। বেশ ক’বছর কাজ করেছেন রিল এফেক্স এবং ব্লু স্কাইয়ের মতো স্টুডিওর সাথে। কাজ করেছেন রিও এবং এপিকের মতো কিছু প্রজেক্টে। কিন্তু তার আসল পরিচয় ‘ইংক্টোবার’ এর প্রবর্তক হিসেবে।
জেক পার্কারের ভীষণ ভালোলাগার জায়গা কালি ও কলম। কিন্তু তিনি মনে করতেন, তার এই কাজে কিছু উন্নতি সাধন প্রয়োজন। সে ভাবনা থেকেই, অনেকটা নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী শিল্পীদের মাঝে ছুঁড়ে দেন এক চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটিই হলো ইংক্টোবার চ্যালেঞ্জ। জেক পার্কারের দেয়া একটি সাক্ষাতকারে উঠে আসে সেসব কথা। সেই সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেন তার আলসে স্বভাবের কথা।
তিনি বুঝতেন, একজন শিল্পী হিসেবে তার কাজে উন্নতি সাধন প্রয়োজন। কিন্তু তার আলসে স্বভাবের কারণে প্রায়ই তিনি বিভিন্ন কাজ মাঝপথে ছেড়ে দেন। হঠাৎ তার মনে হয়, যদি তার একটা জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হয়, তাহলে হয়তো তিনি মাঝপথে কাছ ছেড়ে দেয়ার বাজে অভ্যাস থেকে মুক্তি পাবেন। তিনি ঠিক করেন, অক্টোবর মাসের ৩১ দিন তিনি রোজ একটি করে ছবি আঁকবেন। এভাবে ৩১ দিনে ৩১টি ছবির পর মাস শেষে নিজের বিবর্তন পরিমাপ করবেন নিজের কাজের মাধ্যমেই। আলসেমি যেন তার এই প্রকল্প বানচাল করে দিতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যেই তিনি অন্য শিল্পীদের আহবান জানান তার সাথে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে। বিশ্বব্যাপী শিল্পীরা এতে সাড়া জানান।
জেক পার্কারের প্রকল্প সবার অংশগ্রহণে হয়ে ওঠে উৎসব। তার উদ্দেশ্য সফল হয়। বিশ্বব্যাপী অংশগ্রহণ তার ভেতরে কর্তব্য এবং দায়বদ্ধতা এনে দেয়। আরো ভালো কাজ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। আজও তিনি নিজে প্রতি বছর এই উৎসবে ছবি আঁকার মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেন। এখন এই উৎসবে শুধু মাস শেষে একজন জেক পার্কারের কাজের বিবর্তনের মাপকাঠি না, বিশ্বব্যাপী শিল্পীরা অনেকেই নিজেকে ঝালিয়ে নেয়ার জন্য অক্টোবরে ইংক্টোবারের অপেক্ষায় থাকেন।
অনেকেই বলে থাকে, ইংক্টোবারের সাথে মিল আছে ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হওয়া এক ঐতিহ্য ন্যাশনাল নভেল রাইটিং মান্থের। এক্ষেত্রে লেখকেরা ৩০ দিনের মাঝে একটি উপন্যাস লিখে শেষ করার প্রকল্প হাতে নেন। আবার অনেকে এর সাথে ‘থার্টি সিক্স ডেইজ অফ টাইপ’ চ্যালেঞ্জের মিল খুঁজে পান, যেখানে ক্যালিগ্রাফি ডিজাইনাররা নিজেদের দিকে ৩৬ দিনের একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।
এখন ইন্টারনেট অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অক্টোবর মাস আসার আগে থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যায়। অনেক ব্লগ বা আর্টিকেল প্রকাশিত হয় ইংক্টোবার নিয়ে। কিন্তু শুরুর দিকে বিষয়টা এমন ছিলো না। ২০১৪ পর্যন্ত এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী দেশ ছিলো যুক্তরাজ্যসহ আর মাত্র বিশটি দেশ। তুলনামূলক ছোট পরিসরেই পালন করা হতো এই উৎসব। ২০১২ সালে প্রথম এই চ্যালেঞ্জ বড় পরিসরে আসে। হ্যাশট্যাগের ব্যবহার এ মুভমেন্টকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।
২০১৪ সালে এক মিলিয়নের কাছাকাছি সংখ্যক ছবি ইংক্টোবার চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ করে। এ বছর অক্টোবরের প্রথম তিনদিনে ছবির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭,৫০,০০০। এ বছর ইংক্টোবার প্রথমবারের মতো পার্টনার স্কচির সাথে কাজ শুরু করেছে। সম্মিলিত এই কাজের উদ্দেশ্য হলো পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে সবার জন্য অনলাইন কিছু টিপস বা শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এছাড়াও ইংক্টোবার কাজ করছে আর্টস্ন্যাকসের সাথে। লক্ষ্য? লক্ষ্য এই আয়োজনকে সবার কাছে আরো সহজভাবে পৌঁছে দেয়া।
ইংক্টোবারের মজা হলো এর কোনো সীমারেখা বা ভেদাভেদ নেই। সারা বিশ্ব থেকে আঁকতে ভালোবাসে, এমন যেকোনো মানুষই অংশগ্রহণ করতে পারে এই উৎসবে। এতে অংশগ্রহণ করতে হলে শুধুমাত্র পেশাদার শিল্পী হতে হবে, এমন কোনো নিয়মই নেই। নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা তো নয়ই। এমনকি এর আগে কখনো ছবি আঁকেননি, এমন মানুষও নির্দ্বিধায় বসে যেতে পারেন এক টুকরো সাদা কাগজ আর কালির পেন বা পেন্সিল নিয়ে। এই উৎসব এখন বিশেষভাবে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তরুণ সমাজের মাঝে। এতে অংশগ্রহণ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে কয়েকটা কাজ করতে হবে। সেগুলো হলো–
- পেন্সিল বা কালির পেন দিয়ে একটি ছবি আঁকতে হবে
- সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই ছবি পোস্ট করতে হবে
- #inktober হ্যাশট্যাগ দিতে হবে
- এভাবে পুরো মাস প্রতিদিন একটি করে ছবি দিতে হবে
মাসব্যাপী এই প্রতিযোগিতা চালানো ধৈর্যসাপেক্ষ তো বটেই, আবার অনেকের ক্ষেত্রে সময়সাপেক্ষও বটে। তাই এর নিয়মে আছে কিছু শিথিলতা। একজন অংশগ্রহণকারী নিজের সুবিধামতো ছবি পোস্ট করতে পারবে। একদিন পর পর, পাক্ষিকভাবে অথবা সপ্তাহে একটা করেও ছবি দিয়ে অংশগ্রহণ করার সুবিধা আছে।
এই প্রতিযোগিতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে একটি সংকট দেখা গেলো। সবাই ছবি তো আঁকবে, কিন্তু বিষয়বস্তু কী হবে? ৩১ দিন একটানা নতুন নতুন বিষয়বস্তু নিয়ে আসা বেশ কষ্টসাধ্য একটা কাজ। আবার যেহেতু কোনো সীমারেখা নেই, সেহেতু ন্যূনতম একটি গাইডলাইন ছাড়া বেশ ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো পুরো উৎসবটাই। তাই ২০১৬ সাল থেকে জেক পার্কারের উদ্যোগে শিল্পীদের আগে থেকে কিছু থিম দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর ৩১ দিনের জন্য ভিন্ন ৩১টি ভিন্ন থিম দেয়া হয়, যেটাকে বলা হয় ‘প্রম্পট লিস্ট’।
২০১৬ এর আগে ছবি আঁকার বিষয়বস্তু হিসেবে কার্টুন চরিত্র, হ্যালোউইনের প্রভাব বেশি দেখা যেত। বিষয়বস্তু নির্ধারিত হবার পর থেকে দেখা যায় এক নতুন চিত্র। একটি নির্দিষ্ট বিষয় থেকে স্থান, কাল, পারিপার্শ্বিক পরিবেশভেদে কত বৈচিত্র্যময় শিল্পের জন্ম হতে পারে, তা আবার নতুনভাবে সামনে আসে। শিল্প যে একটা সমাজের, একজন ব্যক্তিমানুষের প্রতিফলন তা পুরো বিশ্ব নতুনভাবে বুঝতে শেখে।
ইংক্টোবারের ২০১৬ এর থিমগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো নয়েজি, ওরিড, টায়ার্ড, ট্রান্সপোর্ট, ফ্লাইট ইত্যাদি থিম। ২০১৭ সালের উল্লেখযোগ্য থিমগুলো ছিলো ট্রেজার, হার্ট, ম্যাজিক, ক্রুকেড, মাস্ক, ব্লাইন্ড ইত্যাদি। এ বছর রয়েছে ট্রাংকুইল, পয়জোনার, সোয়ালোয়েন, রোস্টেড, ড্রুলিং, ক্লক ইত্যাদি থিম।
মিন্ডি লি ইংক্টোবারে রঙের ব্যবহারের মাধ্যমে এই কালি কলমের উৎসবে বৈচিত্র্য এনেছেন। ২০১৬ সালে লরি কোনলি নামে একজন শিল্পী তার ভূতের দোল খাবার ছবির মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। ২০১৭ সালের বিখ্যাত ইংক্টোবারিয়ান হলেন ক্যাথরিন স্যন্ডমেইল, যিনি হ্যালোইনের অতিপ্রাকৃত থিমের সাথে রঙের এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এছাড়াও ২০১৭ সালের এই তালিকায় আছেন কানযাকি ইউফি, যিনি একজন দ্বিমাত্রিক শিল্পী। এছাড়াও ছিলেন আমেরিকান শিল্পী বেকি ক্লুনান।
একজন ওয়েলশ আর্টিস্ট ক্যাট কার্ডি, তিনি কালি কলম ছাড়াও তার কাজে রঙের ছোঁয়া দিতে পছন্দ করেন। এই বিষয়ে জেক পার্কারের বক্তব্য, এই উৎসবের মূলমন্ত্র হচ্ছে নিজের উন্নতি। তাই ধরাবাঁধা নিয়মের হাতকড়া এতে নেই। যেভাবেই হোক নিজের কাজের পরিবর্তনটাই বড় করে দেখেন তিনি।
ড্যানি ডিয়েজ নামে একজন স্প্যানিশ শিল্পী দীর্ঘদিন প্রচেষ্টার পর ২০১৬ সালে প্রথমবার ৩১ দিনে ৩১টি ছবি আঁকতে সক্ষম হন। মাস শেষে তার বিবর্তনের গল্প তিনি সবার সাথে ভাগ করে নেন। ডিয়েজের মতে, ইংক্টোবার সারা বিশ্বের শিল্পীদের জন্য এক মিলনমেলা।
ঠিক এভাবেই প্রতি বছরই বিশ্বের কোনো না কোনো দেশের শিল্পী নতুনভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষী হচ্ছেন নিজের বিবর্তনের। গণযোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে অন্যের কাজের সাথে নিজের কাজের তুলনা করতে পারছেন তারা। ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি হচ্ছে। ইংক্টোবার তাই এখন প্রকল্প বা উৎসবের উর্ধ্বে গিয়ে কার্নিভালের রূপ নিতে চলেছে।