১
গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকের কথা। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে ভাবনাটা সাহসীই ছিল বলা যায়। এই দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের জয় জয়কার শুরু হয়। শাফিন হামিনের মাইলস, আইয়ুব বাচ্চুর এলআরবি, জেমসের ফিলিংস, টিপুর অবসকিউর, চন্দনের উইনিং, ফজলের নোভা– এমন আরো কয়েকটি ব্যান্ড দল উঠে আসে শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায়। কিন্তু নারীরা স্টেজে উঠে গিটার বাজিয়ে গান করবে, তখন পর্যন্ত এমন কিছুর সাথে বাংলাদেশের মানুষ অভ্যস্ত ছিল না।
সে দশকের শেষের দিকে চার বান্ধবী মিলে একটা ব্যান্ড দল গড়ে তোলে। সময়ের বিপরীতে চলা তরুণীদের স্বপ্নটাও হয়তো ভিন্ন ছিল। একটা অ্যালবামও বের হয়ে যায় তাদের। কিন্তু পরবর্তীতে সবার ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে ব্যান্ডটা ভেঙ্গে যায়। নাফিজা, কণা, রোমানা ও তিশার সমন্বয়ে গঠিত সেই ব্যান্ডের নাম ছিল অ্যাঞ্জেল ফোর। সেই ব্যান্ডের একজন গুরুত্বপুর্ণ সদস্য তিশার গল্প নিয়েই এখানের আয়োজন।
২
নুসরাত ইমরোজ তিশা। জন্ম ১৯৮৩ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর এক সভ্রান্ত পরিবারে। তবে রাজশাহীতে জন্ম হলেও বেড়ে উঠা ঢাকাতেই। বাবা এনামুল হক এবং মা শাহীন মাহফুজা হকের উৎসাহে মিডিয়াতে কাজ শুরু করেন ছোটবেলাতেই। শুরুটা হয়েছিল গানের মাধ্যমে। ৫ বছর বয়স থেকে তিনি গান শেখা শুরু করেন ওস্তাদ কানন মোহন গোস্বামীর কাছে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠিত ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় পান দ্বিতীয় পুরস্কার। পরে ১৯৯৫ সালের একই প্রতিযোগিতার আসরে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়ে প্রতিটিতেই প্রথম হন এবং সে বছর স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৯৯৫ সালে মীনা কার্টুনের একটা গানেও কন্ঠ দেন তিনি। পাশাপাশি কিছু জিঙ্গেলেও কন্ঠ দেন। ১৯৯৮ সালে অনন্ত হীরার রচনায় এবং আহসান হাবীবের পরিচালনায় তিনি ‘সাত প্রহরের কাব্য’ নাটকে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন।
প্রথম নাটকেই সবার নজর কেড়ে নেন এবং সে বছরই ‘ফিরে দেখা’, ‘গৃহগল্প’ এবং ‘স্বপ্নযাত্রা’ নামের তিনটি নাটকে অভিনয় করেন। নাটকগুলোতে অভিনয় করে তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জেগে ওঠে। এরপর ২০০০ সালে জনপ্রিয় পরিচালক হুমায়ুন আহমেদের ঈদের নাটক ‘প্যাকেজ সংবাদ’-এ ফুলি নামের এক ছোট মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন।
সে সময় মেরিল লিপজেলের একটি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে প্রশংসিত হন। পরবর্তীতে কোকাকোলা, সিটিসেল, বোম্বে সুইটস এবং কেয়া কসমেটিকসের বিজ্ঞাপনেও নাম লেখান। ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারের সেরা মডেল ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন।
২০০৪ সালে তিনি একটানা ১৪টি নাটকে অভিনয় করেন। সেগুলো ব্যাপক দর্শকনন্দিত হয় এবং ব্যাপক সফলতা পায়। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে খ্যাতির শীর্ষে থাকা অবস্থায় তিনি অভিনয় থেকে সাময়িক বিরতি নেন।
৩
৫ বছর বিরতির পর‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি আবারো অভিনয়ে ফেরত আসেন। সিনেমাটিতে তিনি একজন অবিবাহিত নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি শহরে টিকে থাকার জন্য ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে। চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হয় এবং তিনি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন। একই বছর তিনি তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রে অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন।
এরপর থেকে বিরামহীন অভিনয় চালাতে থাকেন। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র দুই ক্ষেত্রেই তার উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০০৯ সালের ‘৪২০’ ধারাবাহিক নাটকটি তিশার ক্যারিয়ারের একটা উল্লেখযোগ্য নাটক। পুনরায় খ্যাতির শীর্ষে চলে আসেন তিনি। শীর্ষে থাকা অবস্থায় পরিচালক মোস্তফা সারয়ার ফারুকীকে তিনি বিয়ে করেন।
২০১০ সালে ‘গ্রাজুয়েট’, ২০১২ সালে ‘লংমার্চ’, ২০১৩ সালে ‘যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন ২’, ২০১৪ সালে ‘বিজলী’, ২০১৫ সালে ‘তিলোত্তমা, তোমার জন্য’, ২০১৭ সালে ‘একটি তালগাছের গল্প’ নাটকের জন্য তিনি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার লাভ করেন।
এরই মাঝে ২০১২ সালে তিনি মোস্তফা সারয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ থেকে অস্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। ২০১৬ সালে তিশা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে নাম লেখান। তবে শাকিব খানের বিপরীতে করা ‘মেন্টাল’ চলচ্চিত্রটি খুব বেশি সফলতা পায়নি। এই ব্যর্থতা তিশা পুষিয়ে নেন একই বছরে অনন্য মামুনের ‘অস্তিত্ব’ সিনেমার মাধ্যমে। এতে তিশা একজন প্রতিবন্ধী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন এবং এই চরিত্রে অভিনয় করে অভিনেতাদের কাঙ্ক্ষিত পুরষ্কার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেন।
২০১৭ সালে মুক্তি পায় ‘ডুব: নো বেড অফ রোজেস’ । মুক্তির আগে এটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। ধারণা করা হয় প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আহমেদের জীবন কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মিত। যদিও পরিচালক মোস্তফা সারয়ার ফারুকী সবসময় এটা অস্বীকার করে গিয়েছেন। এতে বলিউড সুপারস্টার ইরফান খানের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন তিশা। বাবা মেয়ের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেন তিশা।
১৫টি ফিল্ম ফেস্টিভালে এই সিনেমাটি প্রদর্শিত হয় এবং ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায়। এর জন্যও মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পান তিশা। একই বছর মুক্তি পায় তৌকির আহমেদ পরিচালিত ‘হালদা’। ভিন্ন ঘরনার এই চলচ্চিত্রটিও দর্শক এবং সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। হালদা নদী নিয়ে সচেতনতামূলক চলচ্চিত্রে তার অভিনীত হাসু চরিত্রওটিও প্রশংসিত হয়। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ফাগুন হাওয়া’ও সমালোচকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এখন মুক্তির অপেক্ষায় আছে মোস্তফা সারয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেলে’।
দেশের বাইরের চলচ্চিত্রেও তিশার অভিনয়ের কথা চলছে। সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমা ‘বোবা রহস্য’-তে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিশা।
৪
প্রতিটা প্রজন্মেই কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীর দিকে দর্শকদের আলাদা আগ্রহ থাকে। ৮০-র দশকটাতে যেমন টেলিভিশনে রাজত্ব করেছেন সূবর্ণা মোস্তফা, ৯০-এর দশকটা মাতিয়ে রেখেছিলেন শমী-বিপাশা-মিমি, তেমনই ২০১০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিশা নিঃসন্দেহে দর্শক ও পরিচালকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন।
ঈদ, পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস, বিজয় দিবস, পূজা, রবীন্দ্র জয়ন্তী– যেকোনো উৎসবের নাটকেই তিশার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক কালের ওয়েব প্লাটফর্মেও তিশার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বায়োস্কোপের জন্য ‘বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো’, ‘কলি ২.০’ কিংবা ‘রূপকথা’ নাটকগুলোতে তিশার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে।
তিশার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব প্রজন্মের অভিনেতার সাথেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা। সমসাময়িক অভিনেতা নিশো, অপূর্ব, তাহসান, নাঈম, সজল, মোশাররফ করিম কিংবা চঞ্চল চৌধুরী প্রত্যেকের সাথেই তিশার জুটি দর্শকরা গ্রহণ করেছে। এছাড়া আগের প্রজন্মের মাহফুজ কিংবা জাহিদ হাসানের সাথেও তিশার জুটি প্রশংসনীয়।
জাহিদ হাসানের সাথে জুটি বেঁধে করা ‘আরমান ভাই’ সিরিজের নাটকগুলো খুবই বিখ্যাত এবং দর্শকপ্রিয়। মজার বিষয় হচ্ছে সর্বসাম্প্রতিক প্রজন্মের তৌসিফ মাহবুব কিংবা সিয়াম আহমেদের সাথেও তিশার জুটি দর্শকরা গ্রহণ করেছে। এখানেই তিশার অনন্যতা।
প্রেমিকা, স্ত্রী, বোন, নির্যাতিতা মেয়ে, প্রতিবাদী নারী, মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি প্রতিটি চরিত্রেই সাবলীল অভিনয় তিশাকে আলাদা এক অবস্থানে নিয়ে গেছে। সামনের সময়গুলোতে তিনি আরো ভালো ভালো কাজ উপহার দেবেন এটাই প্রত্যাশা।