সুপার ফুড বলতে মূলত সেই খাবারগুলোকে বোঝানো হয়, যেগুলো পুষ্টিগুণে ভরপুর থাকে এবং নিয়ম করে সেই খাবারগুলো গ্রহণ করলে আমরা সুস্থ থাকতে পারি। শীতকালের সুপার ফুড বলতে ভিটামিন সি, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাটে পরিপূর্ণ খাবার, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সংক্রমণরোধক হিসেবে দারুণ ভূমিকা রাখে এই ধরনের খাবারগুলোকে বোঝায়। শীতকাল শুরু হওয়ার সাথে সাথেই নিজেকে সুস্থ, সবল ও শীতকালীন নানা ধরনের রোগ থেকে মুক্ত রাখা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায়। বিশেষ করে শীতকালে আমাদের ত্বক মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা প্রচুর পরিমাণে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করেও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু সামান্য একটু পরিকল্পনা করে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করার মাধ্যমে এই শীতকালীন নানা রোগ সহ আমাদের ত্বকের সম্পূর্ণ যত্ন নেওয়া সম্ভব।
আজকের লেখাটি শীতকালের এমন কিছু পুষ্টিকর খাবার নিয়েই, আসুন শীতকালের কিছু ‘সুপারফুড’ এর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক।
কমলা
কমলা শীতকালীন সুপারফুডগুলোর অন্যতম একটি। কমলায় উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে যা আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার সাথে ফ্যাগোসাইটিস এবং টি-সেল সঞ্চালনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন একটি করে কমলা খাওয়ার ফলে এই শীতে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি-এর চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শরীরের কিছু নির্দিষ্ট জীবাণুর প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।
এছাড়া কমলায় থাকা পটাশিয়াম সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি (UV) থেকে আমাদের ত্বককে রক্ষা করবে এবং কমলার অ্যামিনো অ্যাসিডও ত্বকের জন্য উপকারী। এই রসালো ফলটিতে ক্যালোরিও কম, তাই এই সুস্থ শরীর ও সুন্দর ত্বক ধরে রাখতে প্রতিদিন একটি করে কমলা খাবারের তালিকায় রাখতেই পারেন।
ডালিম
ডালিম বিশ্বের প্রাচীনতম ফলের মধ্যে অন্যতম একটি। এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসে ভরপুর, যা শীতকালে আপনাকে পলিফেনলস, ট্যানিনস, ফ্লেভোনিওয়েড এর মতো সমস্যাগুলো থেকে দূরে থেকে সুস্থ ও শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করে। ডালিমের অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান শরীরের বিভিন্ন সংযোগস্থলের ব্যথার জন্য দায়ী এনজাইমগুলো আটকে দেয়, বিশেষ করে বাতের ব্যথায় আক্রান্তদের জন্য শীতকালে ডালিম গুরুত্বপূর্ণ একটি সুপারফুড।
এছাড়া ডালিমের অ্যান্টি-অ্যাজিং উপাদান আপনার ত্বককে নরম কোমল রাখার পাশাপাশি এর ভিটামিন সি কন্টেন্ট ত্বক ঝুলে পড়া ও ত্বকের বলিরেখা রোধ করে। তাই এই শীতে শরীর সুস্থ রাখার সাথে ত্বকের কমনীয়তা ধরে রাখতে ডালিম খাদ্য তালিকায় রাখুন।
গাজর
এই শীতে যখন কম্বলের উষ্ণতায় আরাম করে বসবেন, তখন দারুণ সুস্বাদু আর পুষ্টিতে ঠাঁসা একটা গাজর নিয়ে চিবুতে পারেন অথবা এক বাটি গরম গাজরের স্যুপ নিয়ে বসুন। সত্যি বলতে গেলে, গাজর শীত মৌসুমের জন্য অবশ্যই গ্রহণীয় একটি সুপারফুড। মূল গোত্রীয় এই সবজিতে উচ্চ মাত্রায় বিটা-ক্যারোটিন রয়েছে, যা আমাদের শরীরে ভিটামিন এ-তে পরিবর্তিত হয়। ভিটামিন এ ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, দেহকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং ফুসফুস সুস্থ রাখার দ্বারা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ঝুঁকি ও দৈর্ঘ্য কমাতে সাহায্য করে। গাজর শীতের মৌসুমে ত্বককে সুস্থ, উজ্জ্বল ও স্পন্দনশীল রাখে। এমনকি গাজরের ভিটামিন এ এবং অন্যান্য অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো ত্বকের ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যু মেরামত করতে সাহায্য করে ও ত্বকের শুষ্কতা দূর করে ময়েশ্চার ধরে রাখে।
যারা গাজর চিবিয়ে খেতে পছন্দ করেন না, তারা গাজরের জুস, স্যুপ,সালাদ অথবা তরকারিতে দিয়ে রান্না করেও খেতে পারেন। তবে একটি কথা মনে রাখবেন, অতিরিক্ত সিদ্ধ করার ফলে সবজির ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়। তাই যখন রান্না করবেন, চেষ্টা করুন হালকা আঁচে রান্না করতে।
আদা
শীতকালে যখন গরম পানীয়র কথা আসে, আপনি আদা চায়ের কথা একদমই ভুলে যাবেন না। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ আদা আপনার ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে দুর্দান্ত। এছাড়া আদা শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, যা সর্বোত্তম স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যক। আর যদি শীতকালের ঠাণ্ডা বা ফ্লু-এর কথা বলি, আদা একটি কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। এমনকি শীতকালে অতিমাত্রায় মাংসপেশীতে প্রদাহ এবং বাতের উপসর্গগুলি হ্রাসের ক্ষেত্রে এটি কার্যকরী।
এছাড়াও আদা শরীরে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের সাথে হজমে সাহায্য সহ ও শীতকালে ত্বকের কমনীয়তা ধরে রাখতে অবদান রাখে।
হলুদ
হলুদ সর্বোচ্চ মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। এখন হয়তো ভাবতে পারেন, হলুদ আবার কি খাবেন? না, আপনাকে হলুদ চিবিয়ে বা স্যুপ সালাদ বানিয়ে খেতে হবে না। এক গ্লাস দুধে একটু হলুদ মিশিয়ে খেয়ে দেখুন কাশি, কনজেশন, ঠাণ্ডা ও ফ্লুর মতো শীতকালীন শারীরিক সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পাবেন। বিশেষ করে খুশখুশে কাশি ও শুষ্ক ঠাণ্ডার জন্য তো এটি মহৌষধ।
নিয়মিত হলুদ গ্রহণ করার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো বাড়বেই, সাথে শীতে অত্যধিক বেড়ে যাওয়া গাঁটের ব্যাথা উপশম করবে। উপরন্তু, শীতে ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখবে এবং ত্বকের ক্ষতি রোধ করবে।
বাঁধাকপি
শীতের খুব সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী সবজি বাঁধাকপি, যার প্রতি কাপে রয়েছে ৩৩ ক্যালোরি এবং ৩ গ্রাম ফাইবার। মাত্র এক কাপ বাঁধাকপিতে এই শীতে ঠাণ্ডার সাথে লড়াই করার জন্য প্রায় ৪০ শতাংশ ভিটামিন থাকে। লাল বাঁধাকপিতে উচ্চ মাত্রায় Anthocyanin থাকে, যা হৃদরোগীদের সুস্থতা দান করতে সক্ষম। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি আর্টিকেলে জানানো হয়, পুষ্টি উপকারিতা ও ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদানের দিক দিয়ে বাঁধাকপি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সবজি।
কমদামী আর হাতের নাগালেই পাওয়া যায় দেখে শীতকালে কিন্তু ভুলেও এই দারুণ উপকারী সবজিটি অবহেলা করবেন না।
ফুলকপি
অনেককেই দেখা যায় ফুলকপি পছন্দ করেন না, খাওয়া তো দূরের কথা, বাজারে গেলে ফুলকপি পাশ কাটিয়ে চলে যান। তবে যদি শীতকালীন নানা ধরনের রোগ সহ ত্বক ও চুলের সম্ভাব্য ক্ষতি এড়িয়ে চলতে চান, তাহলে ফুলকপিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নাই। এই সবজি ভিটামিন কে-এর বিশাল উৎস, তাছাড়া অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ লবণে ভরপুর এই সবজি শীতকালীন ঠাণ্ডা ও ফ্লু-এর মতো রোগগুলো প্রতিরোধ করতে ফুলকপির জুড়ি নেই।
অ্যাভোকাডো
শীতকালটাই যেন দারুণ সুস্বাদু ফল অ্যাভাকাডো খাওয়ার উপযুক্ত সময়। অ্যাভোকাডোতে ভিটামিন এ, সি এবং ই এর পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম।
অ্যাভোকাডো খেলে চেহারায় বয়সের ছাপ দূর করার সাথে ত্বক উন্নত করে। এটি কোলাজেন উৎপাদন উন্নত করে, যা আপনার ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা এবং দৃঢ়তা বজায় রাখে। এছাড়া শীতে আপনার ত্বকের ময়েশ্চারাইজার ধরে রাখতে অ্যাভাকাডোর তুলনা নেই।
শীত মানে কেবল রুক্ষতা নয়, এই ঋতুটি দারুণ সব স্বাস্থ্যকর আর তাজা খাবার দিয়ে নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে নেওয়ার উপযুক্ত সময়। শীতের এই মাসগুলোতে সুস্থ ও সুন্দর থাকতে এই সুপারফুডগুলো আপনার খাবার তালিকায় যুক্ত করতে ভুলবেন না।
ফিচার ইমেজ- health.com