‘ঢেঁড়স’ খুব পরিচিত একটি সবজির নাম। এক প্লেট ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর ছোট ছোট করে কেটে ভাজি করা মুচমুচে ঢেঁড়স, এই স্বাদের তুলনা হয় না অন্য কিছুর সাথেই। শুধু কি তা-ই, একটু বেশি পেকে যাওয়া কিছুটা শক্ত ঢেঁড়সের চচ্চড়ির স্বাদ যেন অমৃত। মূলত ভিন্নধর্মী স্বাদ এবং খুব দ্রুত রান্না করা যায় বলেই এই সবজি অনেকের কাছে বেশ প্রিয়।
এই ঢেঁড়সকে দেশভেদে লেডিস ফিঙ্গার, ভিন্ডি, বামিয়া, গাম্বো ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। শুধুই খেতেই সুস্বাদু নয়, প্রচুর পুষ্টি উপাদানে ভরপুর এই সবজি।
ঢেঁড়সের পুষ্টি উপাদান
দারুণ সুস্বাদু এই সবজিতে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ঢেঁড়সে ক্যালোরি, ফাইবার, প্রোটিন, কার্বোহাইট্রেড, ফ্যাট, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ভিটামিন বি৯, ভিটামিন বি৬, থায়ামিন, বিটা-ক্যারোটিন এবং শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান ভরপুর রয়েছে। আর এসব পুষ্টি উপাদানের কারণে ঢেঁড়স আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যালসিয়ামের উৎস
ঢেঁড়স আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে। সুস্থ হাড়ের পাশাপাশি হৃদযন্ত্র, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখতে ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। এছাড়া পেশী ও স্নায়ু সঞ্চালনেও ক্যালসিয়াম ভূমিকা রাখে।
যারা ল্যাকটোজের অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছেন (বিশেষ করে যারা নিরামিষভোজী), তাদের প্রতিদিনের ল্যাকটোজের ঘাটতি পূরণ করে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম তৈরি করতে ঢেঁড়স ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।
হৃদযন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে
ঢেঁড়সের দ্রবণীয় ফাইবার কোলেস্টেরলকে স্বাভাবিকভাবে কমিয়ে আনে এবং আমাদের শরীরে হৃদরোগের সম্ভাবনা হ্রাস করে। এছাড়া ঢেঁড়সের অন্যতম পুষ্টি উপাদান পেক্টিন (Pectin) রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল কমিয়ে হার্টের সুস্থতা নিশ্চিত করে।
দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে
দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে ঢেঁড়সের জুড়ি নেই। ঢেঁড়স ভিটামিন এ এবং বিটা-কেরাটিনে ভরপুর, যা চোখের চমৎকার দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখার পাশাপাশি এটি আমাদের চোখের আর সব রোগ-বালাই হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে।
হজমে সাহায্য করে
খাদ্য তালিকায় ঢেঁড়স অন্তর্ভুক্ত করার অন্যতম উপকারিতা হচ্ছে, এটি হজম প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে। এর হাই ফাইবার খাদ্য হজমে দারুণ সাহায্য করে। ঢেঁড়স পেটের অতিরিক্ত গ্যাস, হজমজনিত কারণে পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যা প্রতিরোধ করে। এছাড়া ঢেঁড়সের জলীয় অংশ ডায়রিয়া প্রতিরোধ করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ঢেঁড়সের বিভিন্ন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান এবং উচ্চ ভিটামিন সি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। ভিটামিন সি রক্তে হোয়াইট ব্লাড সেল তৈরি করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে বাইরের রোগ জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে বাধা সৃষ্টি করে শরীরকে সুস্থ রাখে।
রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়
ঢেঁড়স ইনসুলিনের মতো উপাদান বহন করে, যা শরীরের শর্করার মাত্রা কমায়। ঢেঁড়সে আরও রয়েছে লো গ্লাইসিমিক ইনডেক্স (low glycemic index), যা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় পাওয়া যায়, ঢেঁড়স শরীরের অতিরিক্ত গ্লুকোজের শোষণ হ্রাস করতে সাহায্য করে, যার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়।
লিউকোরিয়া প্রতিরোধ করে
গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে, তরতাজা কচি ঢেঁড়স লিউকোরিয়া রোগের প্রতিরোধক হতে পারে। লিউকোরিয়ার প্রতিকারক হিসেবে ঢেঁড়সের তুলনা হয় না। ১০০ গ্রাম ঢেঁড়স ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে ছোট ছোট টুকরা করে কাটুন। হাফ লিটার পানিতে এই ঢেঁড়স জ্বালাতে থাকুন যতক্ষণ এটি ফুটে অর্ধেকটা না হয়। এরপর পানিটুকু ছেঁকে নিয়ে তিনভাগে ভাগ করে নিন এবং দিনে তিনবার এতে একটু মধু মিশিয়ে পান করুন। যতদিন না আপনার সমস্যার উন্নতি না হচ্ছে, এভাবে এটি খেতে থাকুন।
সুস্থ গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করে
ঢেঁড়স বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের গ্রহণ জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। ঢেঁড়সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান ভিটামিন বি গর্ভের শিশুর সুস্থ বৃদ্ধি নিশ্চিত করে এবং শিশুর জন্মগত সমস্যা, যেমন- স্পাইনাল বিফিডা (spinal bifida) হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করে। এছাড়া ফলিক অ্যাসিডে সমৃদ্ধ এই সবজি নতুন কোষ উৎপাদন ও তার সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা কিনা সুস্থ গর্ভধারণের জন্য অপরিহার্য। ঢেঁড়সের ফলেট গর্ভপাত প্রতিরোধ করে এবং ভিটামিন সি ভ্রুণের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গর্ভাবস্থায় খাদ্য তালিকায় ঢেঁড়স অন্তর্ভুক্ত করুন (বিশেষ করে গর্ভধারণের ৪ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে)। এই সময় ভ্রুণের স্নায়ুর বিকাশ সাধন হয়।
লিভার সুস্থ রাখে
ঢেঁড়স লিভার পরিষ্কার রাখে এবং লিভারের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এতে এমন উপাদান রয়েছে, যা লিভারে অ্যাসিড ও কোলেস্টেরল ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে ও লিভারে ফ্যাটের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। তাই লিভারের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে খাবারের তালিকায় ঢেঁড়স রাখুন।
অতিরিক্ত ক্ষুধাভাব নিয়ন্ত্রণ করে
ঢেঁড়স দ্রবণীয় ফাইবারে (Soluble fiber) ভরপুর একটি খাদ্য। দ্রবণীয় ফাইবার খুব দ্রুত ক্ষুধাভাব কমাতে ও দীর্ঘ সময়ের জন্য ভরপেট অনুভূতি দিতে সাহায্য করে। যারা ওজন কমানোর জন্য চেষ্টা করছেন, তাদের জন্য ঢেঁড়স খুব উপকারী সবজি। শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে ফেলতে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভরপেট খাওয়ার তৃপ্তি প্রদানকারী এই সবজিকে আপনার ডায়েট লিস্টে নিশ্চিন্তে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
হাড়কে শক্তিশালী রাখে ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ রোধ করে
ঢেঁড়সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান ভিটামিন কে। এই ভিটামিন কে হাড়কে মজবুত করে এবং ব্লাড ক্লটিং উন্নত করে। এটি অস্টিওপরোসিস, ফ্র্যাকচার এবং আঘাতের কারণে অত্যধিক রক্তপাত প্রতিরোধে সাহায্য করে।
স্তন ক্যান্সারের প্রতিরোধক
প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জন নারীর তাদের জীবনকালের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খাদ্য তালিকায় ঢেঁড়স অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে এই হার অনেকটাই হ্রাস করা সম্ভব। এক গবেষণায় জানা যায়, ঢেঁড়সে উপস্থিত ল্যাকটিন স্তন ক্যান্সারের কোষ বিনষ্ট করতে সক্ষম।
কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
ঢেঁড়স খাবারের তালিকায় রাখার ফলে তা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে তো কাজ করেই, সাথে অন্যান্য রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যায় কয়েকগুণ।
অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণ করে
খাবারে তালিকায় ঢেঁড়স যোগ করার মাধ্যমে অ্যাজমা প্রতিরোধ করা সম্ভব। অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঢেঁড়স খাবার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। ঢেঁড়সের ভিটামিন সি-তে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটোরি এজেন্ট রয়েছে, যা অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীদের অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ত্বক ভালো রাখে
ঢেঁড়সের ভিটামিন এ-এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান ত্বকের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। এটি ত্বকের দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ত্বকের ক্ষত ও ব্রণ প্রতিরোধ করে এবং বলিরেখা দূরে রেখে ত্বককে প্রাণবন্ত রাখে। ঢেঁড়সের ভিটামিন সি শরীরের টিস্যু সুরক্ষিত রেখে ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
চুলের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে
চুলের হারানো উজ্জ্বলতা ফিরে পেতে এবং নিষ্প্রাণ চুল প্রাণবন্ত করতে ঢেঁড়সের জুড়ি নেই। তবে এক্ষেত্রে ঢেঁড়স খাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঢেঁড়স টুকরো টুকরো করে কেটে পানি সহ সিদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। আপনার চুলের হারানো উজ্জ্বলতা ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে চুল আরও বাউন্সি এবং স্বাস্থ্যবান হবে এতে। শুধু তা-ই নয়, ঢেঁড়স-পানির এই মিশ্রণ খুশকি সমস্যার সমাধান করতেও ওস্তাদ। এটি মাথার ত্বককে প্রাকৃতিকভাবে মশ্চারাইজ করে চুল খুশকি মুক্ত রাখে।