দৈহিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ ও উপাদানে সমৃদ্ধ খাবার দুধকে বলা হয় একটি আদর্শ খাদ্য। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা প্রবীণ, সকলের জন্যই দুধ একটি উপাদেয় খাদ্য। গরু, মহিষ, ছাগলের মতো গৃহপালিত পশু থেকে সাধারণত পুষ্টিকর এ খাদ্যটি পাওয়া যায়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই দুধ মানব সভ্যতার জন্য একটি জরুরি খাদ্য। কিন্তু বছরজুড়ে এর পর্যাপ্ত যোগান সম্ভব না হওয়ায় দেখা দেয় সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, তবে তখন পৃথিবীতে ছিল না রেফ্রিজারেটরের মতো প্রযুক্তি। আর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই পৃথিবীতে আসে গুঁড়ো দুধের অভাবনীয় ধারণাটি।
১৮০২ সালে মঙ্গোলীয় তাতার বাহিনী যুদ্ধে যাবার সময় সাথে খাদ্য হিসেবে দুধ বহনের এক অভিনব উপায় আবিষ্কার করে। তারা দীর্ঘক্ষণ সূর্যের আলোয় রেখে দুধ শুকিয়ে একে এক প্রকার পেস্টে পরিণত করে। এতে করে তারা বিপুল পরিমাণ দুধ বহন করতে সক্ষম হয়, পাশাপাশি সেটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়। আর সেই ঘটনা থেকেই জন্ম হয় পাউডার দুধ তথা গুঁড়ো দুধের। মঙ্গোল বাহিনীর আবিষ্কৃত সেই প্রক্রিয়া নানানভাবে পরিবর্তিত হয়ে এখন আধুনিকরূপে পুরো বিশ্বজুড়েই অনুসরণ করা হয়। যেকোনো যুদ্ধে, দুর্যোগে কিংবা মহামারিতে ত্রাণ বিতরণে এখন গুঁড়ো দুধের ব্যবহার বিশ্বজনীন। কারণ এটি সহজে নষ্ট হয় না, পানিতে মেশালেই তরল দুধের সাথে বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না, আর পরিবহনও অত্যন্ত সহজ।
গুঁড়ো দুধ আর তরল দুধের পার্থক্য মূলত একটাই, আর্দ্রতা। তরল দুধ থেকে সবটুকু পানি শুকিয়ে এবং আর্দ্রতা সম্পূর্ণ শুষে নিলেই তা গুঁড়ো দুধ হিসেবে বাজারে সহজলভ্য পাউডারে পরিণত হয়। অন্যান্য পার্থক্যের মধ্যে পুষ্টি উপাদানে সামান্য তারতম্য হয়। বিশেষ করে গুঁড়ো দুধে ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণ তরল দুধের চেয়ে কম থাকে। তবে প্রধান পার্থক্য সেই আর্দ্রতাই। আর আর্দ্রতা থেকে আরও কিছু পার্থক্য তৈরি হয়, যেমন পরিমাণে ও ওজনে। ১ লিটার তরল দুধের স্থলে ১ কেজি গুঁড়ো দুধ পরিবহন করা মানে ৭ থেকে ৮ লিটার পরিমাণ তরল দুধ পরিবহন করা। পুষ্টিগুণ অটুট রেখে পরিবহনের এই সহজলভ্যতার জন্যই গুঁড়ো দুধ মূলত লাভ করেছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
গুঁড়ো দুধে পরিণত করার জন্য পাস্তরিত তরল দুধকে বাষ্পীভূত করা হয়। এই প্রক্রিয়া একাধিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হয়। দুধের পুষ্টিগুণ অটুট থাকা না থাকার ব্যাপারটিও নির্ভর করে মূলত এর বাষ্পীভবন পদ্ধতির উপরই। অ্যামাইনো এসিড, প্রোটিন, মিনারেল সহ অন্যান্য উপাদান মিলিয়ে ২১টি বা তার অধিক পুষ্টি উপাদান আদর্শ গুঁড়ো দুধে বিদ্যমান থাকে। বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে এই উপাদান কম বা বেশি হতে পারে। আবার দুধে উপস্থিত কিছু উদ্বায়ী এবং বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান বাষ্পীভবনের ফলে গুঁড়ো দুধে আর থাকে না। তবে সেগুলো খুবই গৌণ উপাদান হওয়া তরল দুধের সাথে এর খুব বেশি পার্থক্য হয় না।
চলুন এক নজরে তরল দুধ ও গুঁড়ো দুধের পুষ্টি উপাদানের পরিমাণগত পার্থক্য দেখে নেয়া যাক।
পুষ্টি উপাদানের এই ছকটি লক্ষ করলে দেখা যায়, তরল দুধ আর সমপরিমাণ তরল দুধ তৈরিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গুঁড়ো দুধে উপস্থিত অধিকাংশ পুষ্টি উপাদানই এক। তরল দুধের কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বাষ্পীভবনের কারণে গুঁড়ো দুধে অনুপস্থিত থাকে। এছাড়া উপাদানগুলোর পরিমাণগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে তরল দুধের চমৎকার বিকল্পই বলা চলে গুঁড়ো দুধকে।
গুঁড়ো দুধে তরল দুধের পুষ্টিগুণাগুণ অনুপস্থিত থাকে কিংবা এতে অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত করা হয়, এরকম একটি ভ্রান্ত ধারণা অনেকের মাঝেই প্রচলিত আছে। অন্তত বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করা গুঁড়ো দুধের ব্র্যান্ডগুলো কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুঁড়ো দুধকে তরল দুধের বিকল্পে পরিণত করছে। দুধের পুষ্টিগুণ, সারাবিশ্বে জনপ্রিয়তা এবং দুধ উৎপাদনে কঠোর মাননিয়ন্ত্রণ- এই সবকিছুর মিশেল আছে এমন ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধ বাজারে খুঁজতে গেলে, অবশ্যই উঠে আসবে ডানো’র নাম। সেই ১৮৮১ সালে ডেনমার্ক ও সুইডেনে সমবায় পদ্ধতিতে খামারিদের নিজস্ব ডেইরি ফার্ম থেকে উৎপাদিত দুধ নিয়েই বাজারে আসে আরলা। উত্তর ইউরোপে তাদের উৎপাদিত দুধ ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া সহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে বিশ্বস্ততার সাথে সরবরাহ করে আসছে তারা। আর ঠিক সেখান থেকেই বাংলাদেশের বাজারেও আসে স্বাদে আর পুষ্টিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই দুধ। খামার থেকে গ্লাস পর্যন্ত এই দুধের আগমনের প্রতিটি ধাপে মানা হয় কঠোর ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড। আর গরুর পরিচর্যা, খাবার, দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত করা থেকে শুরু করে বাজারে নিয়ে আসা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মাননিয়ন্ত্রণে এই কড়াকড়ির ফলাফলটাও হয়েছে দারুণ- তরল দুধের তুলনায় ভিটামিন, প্রোটিন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও খনিজ উপাদানে ডানো কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই।
সব মিলিয়ে তরল দুধ আর গুঁড়ো দুধের পার্থক্যগুলোকে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণিতে প্রকাশ করা যায়।
-
মূল্য- গুঁড়ো দুধের মূল্য তরল দুধ অপেক্ষা সস্তা।
-
পরিবহন ও সংরক্ষণ- গুঁড়ো দুধ সহজে পরিবন করা যায়, অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। তরল দুধ বেশি পরিমাণে পরিবহন করা কঠিন, হিমায়িত না করে সংরক্ষণ করা যায়।
-
পুষ্টি উপাদান- গুঁড়ো দুধে তরল দুধের কিছু গৌণ ও উদ্বায়ী উপাদান অনুপস্থিত থাকে।
-
কোলেস্টেরল- তরল দুধকে গুঁড়ো দুধে রুপান্তর প্রক্রিয়ায় দ্রবীভূত কোলেস্টেরল জারিত হয়ে যায়।
-
ল্যাকটোজ- অনেক মানুষই ল্যাকটোজ গ্রহণ করতে পারে না। গুঁড়ো দুধে তরল দুধ অপেক্ষা ল্যাকটোজ কম থাকায় এটি সবার জন্য উপযোগী।
তরল দুধ যেখানে ব্যাপক পরিমাণে সহজলভ্য, সেখানে গুঁড়ো দুধ তার বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু তরল দুধ সর্বত্র সারাবছর সহজলভ্য থাকে না, দাম বেশি হওয়ায় অনেকের নাগালের বাইরে হয়, রয়েছে পরিবহন ও সংরক্ষণের ঝামেলাও। এসব ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ দেয় গুঁড়ো দুধ। পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে গুঁড়ো দুধ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই বরং তরল দুধের কাছাকাছি মানের বিকল্প।