Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চায়ের ইতিহাস ও কালক্রমিক বিবর্তন

এককাপ চা চলবে? আর চায়ের সাথে ‘টা’? আজ তাহলে চায়ের সাথে না হয় চায়ের ইতিহাসটাই চলুক?

পাঁচ হাজার আগের একটি কাকতালীয় ঘটনাই আজকের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের পর্দার পেছনের কাহিনী, যাকে আমরা বলি ‘ইতিহাস’। সম্রাটদের খামখেয়ালীপনার শত গল্পই দেখা যায় এই ইতিহাসের পাতা ওল্টালে, কারো রাজ্য জয়-পরাজয়, কারো অদ্ভূত শখ, বা কারো গভীর প্রেম, সবকিছুই বর্তমানের কোনো না কোনোকিছুতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। তেমনি এক সম্রাট ছিলেন আমাদের আজকের এই ‘শেন নাং’, চায়ের কথা বললে যার নাম বলতেই হয়!

মজার ব্যপার হলো চীনা ভাষায় ‘শেন নাং’ নামটির অর্থ হলো ‘স্বর্গীয় কৃষক’। শেন নাংও যেনো স্বর্গ থেকে ছেনে এনেছিলেন চা নামের প্রিয় পানীয়টি! এর পাঁচ হাজার বছর আগের এই সম্রাট ছিলেন দারুণ স্বাস্থ্যসচেতন। একবার তিনি ডিক্রী চালু করলেন যে তার প্রজাদের সবাইকে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। তো একদিন বিকেলে রাজকার্যের ক্লান্তি দূর করার জন্য ক্যামেলিয়া গাছের নিচে বসে সম্রাট ফুটানো গরম পানি পান করছিলেন, কোত্থেকে যেন তার গরম পানির পাত্রে এসে পড়লো কয়েকটি অচেনা পাতা! পাতাগুলো পানি থেকে বের করার আগেই তার নির্যাস মিশে যেতে লাগলো পানির সাথে আর ভোজবাজির মত পাল্টাতে লাগলো পানির রং! কৌতূহলী সম্রাট শেন নাং ভাবলেন এ নির্যাসও একবার পান করে দেখে নেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ, নির্যাসমিশ্রিত এ পানি পান করার পর নিজেকে অন্যদিনের চাইতে অনেক বেশি চনমনে লাগলো তার! ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেলো, ক্লান্তি দূর হলো আর সম্রাটও নতুন স্বাদ পেয়ে খুশি! এরপর অনেক খুঁজেটুজে পাওয়া গেল পাতাটির উৎস- ‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিস’ গাছ।

inventor of tea, shen nang

চা আবিষ্কারের নায়ক চীনা সম্রাট ‘শেন নাং’

সেই শুরু থেকে চীনারা করে আসছেন চায়ের পৃষ্টপোষকতা, এক চীনা মনিষী লাওৎ সে চাকে বলেছেন ‘মহৌষধি’ বা ‘পরশমণি’। প্রাচীন চীনারা তো এও বলে গেছেন, “চায়ের মত এমন প্রাকৃতিক সুঘ্রাণ আর কিছুতে নেই”। আর এ কথার জের ধরেই হয়তো আজ চায়ের নির্যাসে তৈরী হয়েছে মোহময় বিভিন্ন সুগন্ধিও!

Green-Tea-Camellia-by-Elizabeth-Arden

চায়ের নির্যাস থেকে পেয়েছি সুগন্ধিও!

চীনে চা পানের প্রচলন শুরু হয় ঔষধসেবন হিসেবে। ইংল্যান্ডে নামকরা চায়ের ব্র্যান্ড হলো ‘টাইফু’, চীনা ভাষায় যার অর্থ ‘চিকিৎসক’। ‘চা’ নামক এই অতি পরিচিত পানীয়টিতে রয়েছে ৭% থিওফাইলিন ও থিওব্রোমিন যা শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির জন্য অনেক উপকারী। এতে রয়েছে ২৫% এরও বেশি পলিফেনলস, যা ক্যান্সার প্রতিরোধী। ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে চা পানের অভ্যাসও চালু হয় মূলত সুস্বাস্থ্যরক্ষার জন্যই।

চীনের সিচুয়ান প্রদেশের লোকেরা সর্বপ্রথম চা সেদ্ধ করে ঘন লিকার তৈরী করতে শেখে। ১৬১০ সালে ইউরোপে চায়ের প্রবেশ ঘটে পর্তুগীজদের হাত ধরে এবং ১৬৫০ সালে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। চা উৎপাদনে ও প্রচলনে ইর্ষান্বিত হয় ইংরেজরা। ১৭০০ সালের দিকে ব্রিটেনে চা জনপ্রিয়তা পায় এবং এদের মাধ্যমেই ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের প্রবেশ ঘটে। চা পানের অভ্যাস জন্ম দেয় দু’টি বাণিজ্যিক ত্রিভুজে। চিনির জন্য ‘ব্রিটেন-আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ এবং চা’পাতার জন্য ‘ব্রিটেন-চীন-ভারত’। প্রথম দিকটায় ঝোঁকের বশে ইংরেজরা সোনার বিনিময়ে চীনের কাছ থেকে চা আমদানি করে এবং এতে করে ইংল্যান্ডের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়। এই ক্ষতি রোধ করতে ব্রিটিশ সরকার তাদের কোম্পানির মাধ্যমে ভারতে আফিম চাষ করে এবং চীনকে বাধ্য করে এই আফিমের বিনিময়ে চা রপ্তানী করতে।

যে চা আজ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি গৃহে অতিথিকে করতে চাওয়া প্রথম আপ্যায়ন, সে চা’কে কিন্তু ভারতবর্ষে অতিথি হয়ে প্রবেশ করতে পোহাতে হয়েছে অনেক ভোগান্তি! সেসময়ের অন্যান্য সকল নতুন বিষয়ের মতই ১৮১৮ সালে চা’কেও ভারতবর্ষে পৌঁছে দেয় ব্রিটিশরাই। ছোট ছোট দোকান খোলার উদ্দেশ্যে নামমাত্র মূল্যে, বাকিতে এবং সর্বোপরি বিনামূল্যে পর্যন্ত চা সরবরাহ করেছে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো।

ব্রিটিশরা চেয়েছিলো এদেশের মানুষের মর্মে চা’কে প্রবেশ করাতে, তাদেরকে চা’তে অভ্যস্ত করে তুলতে…যাতে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় চা স্থান পায় এবং তাদের নিয়মিত চায়ের খদ্দের জোটে। কিন্তু চা’কে এদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বা জনপ্রিয় করে তোলাটা বোধ করি এত সহজও ছিলো না! বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন একে করেছে সহজতর ও পরিচিত। প্রথম চা কোম্পানী ‘অসম চা কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠার পরপরই ইংরেজরা এর আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞাপনে জোর দেয়। প্রথম কাজ ছিল বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চায়ের বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা বের করা, তারপর এর সাথে আকর্ষণীয় ভাষার মিশেলে বিজ্ঞাপন তৈরি!

সংবাদপত্রে পাওয়া খুব পরিচিত বিজ্ঞাপন ছিল এমনটি, –

“প্রাণশক্তি ও উৎসাহের উৎস ও ম্যালেরিয়ানাশক ভারতীয় চা। দরকার হলেই ভারতীয় চা ব্যবহার করে অচিরে শরীর মন সতেজ করে তোলা যায়, এ যে কত বড় সান্ত্বনা, তা বলা যায়না। সারাদিনের কঠিন শারীরিক পরিশ্রম বা মাথার কাজের পর এক পেয়লা ভালোভাবে তৈরী দেশি চা খেলেই শরীর সজীব ও মন প্রসন্ন হয়ে উঠবে। সত্যিই চা জাগ্রত জীবনীশক্তির আধার। সকালবেলা নিয়ম করে অন্তত দুই পেয়ালা ভালো দেশি চা রোজ পান করুন, জড়তা দূর হয়ে যাবে- সারাদিন শরীর মজবুত থাকবে, আবার দিনের শেষে দুই পেয়ালা চা পান করবেন- সারাদিনের খাটুনির পর মধুর বিশ্রামের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না”।

১৮৫৫ সালে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে শুরু হয় বাণিজ্যিক চা চাষ।

malnichoar

মালনীছড়া চা বাগান

পৃথিবীতে ২ ধরনের চা গাছ দেখতে পাওয়া গিয়েছে, চীনজাতীয় চা গাছ ও আসামজাতীয় চা গাছ। চীনজাতীয় চা গাছ আকারে ছোট হয় এবং আসামজাতীয় চা গাছগুলো অনেক বড় হয়ে থাকে, মাঝে মাঝে ছেঁটে দিলে ঠিকঠাক থাকে। চীনজাতীয় চা গাছের পাতা স্বাদ ও গন্ধের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু আসামজাতীয় চা গাছের পাতা বিখ্যাত গন্ধের জন্য। এই দু’ধরনের চা-পাতার উন্নত সংমিশ্রণের ওপরই এর গুণাগুণ নির্ভর করে। চা গাছ থেকে পাতা সংগ্রগ করবার সময় আপনাকে অবশ্যই দু’টি পাতা ও একটি কুঁড়ি একসাথে তুলতে হবে, তা না হলে যে চায়ের আমেজটাই নষ্ট হয়ে যাবে! এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই চায়ের লীলাভূমি সিলেটকে বলা হয় ‘দু’টি পাতা ও একটি কুঁড়ির দেশ’!

চীন-জাপানে বছরে গড়পড়তা তিনবার চা-পাতা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় খুব ঘন ঘন পাতা সংগ্রহ করা হয়। এদেশগুলোতে বছরে গড়ে ষোল বা বিশবার পর্যন্ত চা-পাতা সংগ্রহ করতে দেখা যায়। চা মূলত ‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিস’ নামক উদ্ভিদটির পাতা, পর্ব ও মুকুলের কৃষিজাত পণ্য। চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল, গ্রীকদেবী থিয়ার নামানুসারে নাম রাখা হয়েছিলো ‘টি’… ‘টি’ থেকে চীনে ‘চি’ এবং আমরা বলি ‘চা’। প্রস্তুতের প্রক্রিয়া অনুযায়ী চা ৫ ধরনের হয়ে থাকেঃ কালো চা, সবুজ চা, ইষ্টক চা, উলং চা ও প্যারাগুয়ে চা। চা প্রস্তুতিকে আর সহজ করে তুলতে ১৯০৯ সালে টমাস সুলিভ্যান টি-ব্যাগের প্রবর্তন করেন!

tea bag

টিব্যাগ করেছে চা পানকে সহজতর…

চা বানানোর এই প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের দেশে বেশ রহস্যও জমেছে! শ্রীমঙ্গলের নীলকন্ঠ চা কেবিনে দুই থেকে শুরু করে পাওয়া যায় সাতরঙ্গা চা’ও! এই চা দেশ-বিদেশে নাম কুড়িয়েছে এবং পর্যটকের ব্যাপক কৌতূহলের জায়গাও হয়ে ওথে প্রায়ই। এই স্তরীভূত রঙের চায়ের উদ্ভাবক রমেশ রাম গৌড়ও বিখ্যাত তার এই চা তৈরীর প্রক্রিয়াটির রহস্য আজ পর্যন্ত অনাবৃত রাখার জন্য।

sat ronga cha O

সাতরঙ্গা চা ও তার উদ্ভাবক…নীলকন্ঠ চা কেবিনে।

যে ধরনের চা’ই হোক, ভারতের পুরনো সেই বিজ্ঞাপনের সুরেই বলা যায়… আপনার দিন শুরু এককাপ আপনার নিজস্ব স্বাদের চা নিয়ে, চাইলে বলতে পারি সুমনের সেই গানের মতই, “এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই”! নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদও চায়ের স্তুতি করেছিলেন তার উষ্ণতার মাপকাঠিতে, “এককাপ উষ্ণ চা একজন ভালো বন্ধুর মত” বলে – স্বাদে হোক, গন্ধে হোক, উষ্ণতায়ই হোক, চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠুক, বয়ে যাক শত তর্কের ঝড় চায়ের স্টলে বন্ধুর হাতে!

Related Articles