মনে করুন, আপনি হুট করে নতুন কোনো খাবার আবিষ্কার করলেন। কী নাম দেবেন খাবারটির? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খাবারটির নাম উপাদানের নাম, উৎপাদনের স্থান ইত্যাদির উপরে নির্ভর করে দেওয়া হয়। তবে আপনি কি জানেন যে, খাবারের নাম তার উদ্ভাবক কিংবা কোনো মানুষের নামানুসারেও হয়ে থাকে? এই যেমন নাচোসের কথাই ধরুন না! নাচোস খাবারটি এই নাম পেয়েছে এর উদ্ভাবকের কাছ থেকে। ঠিক তেমনি আরো অনেক খাবার আছে পৃথিবীতে যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে খাবারটির উদ্ভাবক কিংবা কোনো মানুষের নামানুসারে। চলুন, জেনে নিই আমাদের অত্যন্ত পরিচিত এমন কিছু খাবারের কথা যাদের নামকরণ করা হয়েছে মানুষের নামে!
ফেতুচ্চিনি আলফ্রেডো
একসময় রোমের খুব জনপ্রিয় একটি রেস্টুরেন্টের নাম ছিল আলফ্রেডো। বিংশ শতকের প্রথমভাগের কথা। স্ত্রীকে কিছু উপহার দিতে কে না চায়? ঠিক একই কারণে আলফ্রেডো রেস্টুরেন্টের প্রধান শেফ আলফ্রেডো ডি লেলিও নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্য নতুন একটি খাবার তৈরি করেন। নতুন খাবারটি আদতে ছিল ফেতুচ্চিনি, আর সাথে প্রচুর পারমিসান পনির, মাখন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি একটি খাবার। হৃদয়ের সব ভালোবাসা নিংড়ে দিয়ে খাবারটি তৈরি করেন তিনি। ফলে কেবল আলফ্রেডোর স্ত্রী নন, এখন সেই একই খাবারের স্বাদ নিতে পারছেন গোটা পৃথিবীর মানুষ। মজার ব্যাপার হলো, এখন সেই একই নামে যে খাবারটি বিক্রি করা হয় সেটি মোটেও আলফ্রেডোর প্রথম উদ্ভাবিত সেই খাবার নয়। অনেক পরিবর্তন এসেছে খাবার তৈরির প্রক্রিয়া এবং উপাদানে। তবে আলফ্রেডোর নাম খাবারটির সাথে এখনো মিশে আছে।
এগস বেনেডিক্ট
নাম দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, এই খাবারটির নামের সাথে জুড়ে থাকা বেনেডিক্ট অংশটি কোনো মানুষের নাম? আসলেও তাই। কিন্তু কে ছিলেন এই বেনেডিক্ট? মোট দুটো ঘটনা বলা হয় এই খাবারটির উদ্ভাবনের পেছনে। প্রথমটি হল ল্যামুয়েল বেনেডিক্টের। নিজের হ্যাংওভার দূর করতে এই খাবারটি তৈরি করেছিলেন বেনেডিক্ট এমনটাই ধারণা করা হয়। অন্যদিকে ডেলমোনিকোর প্রধান শেফ চার্লস বলেন, তিনি এই খাবারটি লেগ্রান্ড বেনেডিক্টের জন্য তৈরি করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, এই দুই ঘটনাতেই মানুষটির নাম বেনেডিক্ট এবং তারা দুজনেই ছিলেন স্টকব্রোকার। তবে শুরুটা যেভাবে হোক না কেন, বেনেডিক্ট নামটি জুড়ে গিয়েছে খাবারটির সাথে। আর হ্যাঁ, খাবারটি কিন্তু খেতেও কম মজার নয়।
নাচোস
নাচোস খাবারটি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় এবং দেখতে ছোটোখাটো হলেও, এই খাবারটির পেছনে আছে বেশ বড় ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের একটি অংশ হিসেবেই এর নামটিও জড়িয়ে রেখেছে তার উদ্ভাবকের নাম সবসময়ের জন্য। নাচোস জনপ্রিয় হয় ফ্র্যাঙ্কের হাত ধরে। স্টেডিয়ামের পাশে নাশতা হিসেবে খাবারটি বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু এর আগে এটি তৈরি করেছিলেন প্রথমে ডানকান দুর্গের পাশে ইগল পাসের কাছাকাছি স্থাপিত ভিক্টোরিয়া ক্লাব রেস্টুরেন্টের মালিক ইগনাসিও আনায়া। সেই সময় সৈনিকদের স্ত্রীরা তার কাছে খাবারের জন্য এলে তিনি ফিরিয়ে দেননি। বরং বেঁচে যাওয়া সব খাবার দিয়ে তৈরি করেছিলেন নতুন এক খাবার, যার নাম এখন হয়েছে নাচোস। পরবর্তীতে নাচোসের পেটেন্ট বাবার নামে করতে গেলেও ইগনাসিও জুনিয়রকে খালি হাতে ফিরতে হয়। সময় অনেক গড়িয়ে গিয়েছে। এখন কেবল নামটুকুই মিশে আছে তার বাবার খাবারটির সাথে, আর কিছুই নয়।
সিজার সালাদ
কী ভাবছেন? কোনোভাবে সালাদটির সাথে জুলিয়াস সিজারের যোগাযোগ আছে? একদম না। নামটা একটু মিলে গিয়েছে যদিও, এই খাবারটির পেছনে আছে হোটেল সিজারের শেফ সীজার কার্ডিনির নাম। তিনিই এই খাবারটি প্রথম তৈরি করেন। ১৯২৪ সালে মেক্সিকোর তিহুয়ানাতে এই খাবারটি তৈরি করা শুরু হয়। এই রেস্টুরেন্টটি ছিল ইতালিয়ান-আমেরিকান। আমেরিকান পর্যটকদের স্বাদের ভিন্নতা আনতে নানারকম নতুন খাবার তৈরি চেষ্টা করছিলেন কার্ডিনি। এর মধ্যে কিছু চেষ্টা সফল হয়, আর কিছু হয় ব্যর্থ। সীজার সালাদ পছন্দ করেছিল মানুষ। তাই শেষ পর্যন্ত টিকে গিয়েছিল খাবারটি। খাবারটির জন্ম হয়েছে ১৯ শতকে। এরপর অনেকদিন চলে গিয়েছে। তবে সিজার সালাদ কিংবা কার্ডিনির নাম- কোনোটাই খাবারটি থেকে বিদায় নেয়নি।
ব্যানানাস ফস্টার
কলা দিয়ে নানারকম খাবার তৈরি হয়। তবে সেই সব খাবারের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল, কে প্রথম তৈরি করেছিল খাবার সেটা অনেকেরই অজানা। তবে ব্যানানাস ফস্টার খাবারটির পেছনের ইতিহাস সবার জানা। না, ফস্টার এই খাবারটির উদ্ভাবকের নাম নয়। ব্যানানাস ফস্টার খাবারটি তৈরি করেন পল ব্ল্যাঞ্জ। ব্রেন্নান রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন তিনি শেফ হিসেবে। রেস্টুরেন্টের মালিক ওউয়েন ব্রেন্নানের কথায় কলা দিয়ে নতুন খাবার তৈরি করেন পল। ব্রেন্নান রেস্টুরেন্টের এই মালিক নিজের নামে নয়, তার উদ্ভাবিত খাবারটির নামকরণ করেছিলেন নিজের বন্ধু নিউ অরলিন্সের ক্রাইম কমিশন চেয়ারম্যান রিচার্ড ফস্টারের নামে। ব্যানানাস ফস্টার প্রথম উদ্ভাবিত হয় ১৯৫০ সালে। ক্যারামেল মাখা টুকরো টুকরো কলা, আর সাথে খানিকটা আইসক্রিম মিলে তৈরি হওয়া খাবারটি প্রথম শুরু হয় নিউ অরলিন্সে।
জার্মান চকোলেট কেক
কী ভাবছেন? কেকটি জার্মানিতে তৈরি হয়েছে, কিংবা জার্মানির নামানুসারেই এই কেকের নামকরণ করা হয়েছে? একদম নয়। অন্যসব খাবারের মতো জার্মান চকোলেট কেকের নামকরণও করা হয়েছে একজন মানুষের নামে। জার্মানির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই এই কেকের। এটি প্রথম তৈরি হয় আমেরিকায়, আমেরিকার তৈরি করা কেকের রেসিপি থেকেই। ১৯ শতকের কথা। বেকিং করতে খুব ভালোবাসতেন স্যাম জার্মান। তার নিজের নামে একটি বেকারিও ছিল, যার নাম ছিল ‘বেকার’স জার্মান’স সুইট চকোলেট’। ১৯৫৭ সালে ‘জার্মান’স সুইট চকোলেট’ নামে একটি রেসিপি খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। রেসিপিটি প্রকাশিত হয়েছিল ডালাসের একটি পত্রিকায়। একটা সময় এই জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং মিষ্টি খাবারটির নাম ছোট হয়ে হয় ‘জার্মান চকোলেট কেক’।
কব সালাদ
আপনার যদি নানা রকমের খাবার খাওয়ার, নতুন কোনো স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে থাকে, তাহলে কব সালাদ হতে পারে আপনার জন্য আদর্শ। আরো অনেক খাবারের মতো এই খাবারটির সাথেও জুড়ে আছে এর নির্মাতার নাম। অসাধারণ এই খাবারটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় বব কবের দ্বারা। ঠিক ধরেছেন! ১৯৩৭ সালে হলিউড ডার্বি রেস্টুরেন্টের মালিক বব কবের কথাই বলছি। তারকাদের পদচারণায় সবসময়েই মুখর ছিল রেস্টুরেন্টটি। প্রচুর ভিড় থাকার কারণে একদিন নিজের কিছুই খাওয়া হয়নি ববের। ফ্রিজ খুলে যে জিনিসগুলো পড়ে ছিল সেগুলো দিয়েই নিজে কিছু একটা করার চেষ্টা করেন তিনি। ফলাফল তো আপনি জানেনই!
মার্গারিটা পিজ্জা
মার্গারিটা পিজ্জা কখনো খেয়েছেন কি? জানেন এই খাবারটির নামের পেছনে কে আছেন? আর কেউ নয়, বরং স্বয়ং ইতালির রানী মার্গারিটার নামানুসারে নামকরণ করা হয় এই পিজ্জার। নেপোলিটান পাই ঘরানার এই খাবারটি রানীর উদ্দেশ্যে সেই সময় তৈরি করা হয় যখন তিনি ইতালির এই শহরে ভ্রমণ করতে আসেন। তারপর থেকে মার্গারিটা পিজ্জা হিসেবেই এটি পুরো পৃথিবীতে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
ফিচার ইমেজ: Taste