যেকোনো বিষয়ে সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নমুনাটিই হয় আদর্শ। মানুষের বেলায়, ফুটবল মাঠে আদর্শ পেলে-ম্যারাডোনা, ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান, চিত্রকরদের কাছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভাস্কর হিসেবে মাইকেল এঞ্জেলো, আর বিজ্ঞানী বলতে নিউটন কিংবা আইনস্টাইন। তবে মানুষের কথা চিন্তা করতে গেলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একাধিক আদর্শ খুঁজে পাওয়া সম্ভব, থাকবে বিতর্কও। আমাদের আজকের আলোচনাটা যেহেতু খাবার নিয়ে, তাই বরং তেমন কিছুর উদাহরণে যাই। পৃথিবীর হাজার হাজার ধরনের বিষয়ে আদর্শ খুঁজে বের করা যাবে, তবে বিতর্কের ব্যাপারটা চলে আসবে প্রায় ক্ষেত্রেই। যেমন- আদর্শ ভ্রমণ গন্তব্য, আদর্শ পোশাক বা ধরুন আদর্শ। এভাবে আদর্শ ঠিক করতে করতে যখন খাবারের বেলায় যাবেন, তখন কিন্তু আদর্শ খাবারের নামটি একশব্দে মাথায় চলে আসবে, দুধ। এতে কোনো দ্বিমত নেই, কোনো বিতর্ক নেই, নেই কোনো প্রতিযোগিতা। আমাদের এই লেখাটা দুধের এমন পুষ্টিগুণের কথা নিয়েই।
প্রতিবেলার আহারকে একটি আদর্শ আহারে পরিণত করতে প্রয়োজন হয় ছয়টি পুষ্টি উপাদান- কার্বোহাইড্রেট (শর্করা), প্রোটিন (আমিষ), ফ্যাট (স্নেহ), মিনারেল (খনিজ উপাদান), ভিটামিন ও পানি। বিস্ময়করভাবে দুধে এই ছয়টি উপাদানই বিদ্যমান। মানুষের জন্য প্রকৃতির এই অতুলনীয় উপহার যেন একের ভেতরে সব। প্রতিবার আহারের সময় ছয়টি পুষ্টিগুণ ঠিক রেখে খাবারের তালিকা করা বা তেমন খাবারের ব্যবস্থা করা কখনোই সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে খাদ্য তালিকায় দুধ অন্তর্ভুক্ত হলেই সব ঝামেলা চুকে যাচ্ছে। আর এজন্যই গুণেমানে অতুলনীয় এই খাদ্যকে বলা হয় পৃথিবীর অমৃত। আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী চা থেকে শুরু করে পনির, মাখন, ঘি, দই, ক্ষীর, ফিরনি সহ শত শত মুখরোচক খাবার তৈরি হয় এই প্রাকৃতিক অমৃত থেকে।
দুধের পুষ্টিগুণ সম্বন্ধে প্রাচীনকালের মানুষও জ্ঞাত ছিল। বহু প্রাচীন পুঁথি আর শাস্ত্রেও পাওয়া যায় দুধের গুণাগুণের বর্ণনা। সেই বর্ণনা যত সময় গড়িয়েছে তত শক্ত ও প্রামাণ্য হয়েছে নানাবিধ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণায়। শিশুদের জন্য মায়ের বুকের দুধ আর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গরু, মহিষ কিংবা ছাগলের দুধ অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য যা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। প্রোটিন, ভেজিটেবল ফ্যাট, ভিটামিন আর নানাবিধ খনিজে সমৃদ্ধ এই তরল খাবারের জুড়ি মেলা ভার।
দুধের পুষ্টি উপাদানগুলো প্রতিটিই অত্যন্ত উন্নত মানের। উদাহরণস্বরূপ প্রোটিনের কথাই ধরা যাক। দৈহিক বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য প্রোটিনের পরিমাণ দুধের ৩.৪ শতাংশ। পরিমাণের জন্য নয়, বরং দুধের প্রোটিন এর স্বয়ংসম্পূর্ণতার কারণে মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। দেহের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নয়টি অ্যামাইনো এসিডের সবগুলোর উপস্থিতির কারণে একে বলা হয় ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রোটিন’।
দুধের প্রোটিনের ৭০-৮০ শতাংশই হলো ক্যাসেইন, যাতে বিদ্যমান অ্যামাইনো এসিডগুলো আর কোনো খাবারে পাওয়া যায় না। এতে আরও আছে হোয়ে প্রোটিন যেটি লিউসিন, আইসোলিউসিন, ভ্যালিনের মতো অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ। এছাড়াও আছে অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন, ল্যাকটোফেরিন, বোভিন ইত্যাদি প্রোটিনও। আর এই উপাদানগুলোর প্রতিটিই শরীরের গঠন ও বিকাশের জন্য দারুণ উপকারি।
দুধের শর্করার পরিমাণও প্রায় প্রোটিনের সমান। প্রচুর পরিমাণে দ্রবীভূত ফাইবার, সুক্রোজ আর ফ্যাট রয়েছে এতে। আর ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়াম, ফসফরাসের মতো খনিজ দ্রব্য এবং ভিটামিনগুলোর উপস্থিতি যথাক্রমে আরডিএ’র ২৮, ১৩ ও ২২ শতাংশ। উল্লেখ্য, আরডিএ বা ‘রিকমেন্ডেড ডায়েটারি অ্যালাউয়েন্স’ হলো মানুষের প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পরিমিত পরিমাণ। কয়েকটি ভিটামিন এবং খনিজের ক্ষেত্রে কেবল দুধই মোট আরডিএ’র সিংহভাগ পূরণে সক্ষম।
পুষ্টিগুণ বিবেচনায় গরুর বা ছাগলের দুধের চেয়ে এগিয়ে থাকে মহিষের দুধ। সহজলভ্যতায় গরুর দুধ এগিয়ে থাকায় মানুষ সাধারণত এটিই গ্রহণ করছে। তবে শহরাঞ্চলে এখন খাঁটি গরুর দুধ পাওয়াও মুশকিল হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে গো-দুগ্ধের বিকল্প হয়ে উঠছে গুঁড়ো দুধ। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে ডানো, গত ৬ দশক ধরে সারাবিশ্বে দুধ সরবরাহ করা এই ব্র্যান্ডের প্রতি ১ গ্লাস ফুল ক্রীম দুধে থাকে ৭% প্রোটিন, ২৬% ভিটামিন বি২, ২১% ভিটামিন এ, ২৫% ক্যালসিয়াম, ৪২% ভিটামিন বি১২ আর ৫৬% ভিটামিন ডি। অর্থ্যাৎ গুণে, মানে আর পরিমাণে, সব দিক থেকেই প্রাকৃতিক দুধের সমতুল্য প্রায় এই গুঁড়ো দুধ। এছাড়াও ডানোর আরও আছে ফ্যাট ফিলড্ গুঁড়ো দুধ, যাতে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভেজিটেবল ফ্যাট, যা একই সাথে স্বাস্থ্যকর এবং স্থূলতার ঝুঁকিমুক্ত। দ্রবীভূত ভিটামিন এ, ডি ও বি এর সমন্বয় একে করে আরও পরিপূর্ণ। আর যথেষ্ট পরিমাণ ল্যাকটোজ ও সুক্রোজের উপস্থিতি এর স্বাদকেও নিয়ে যায় একদম প্রাকৃতিক দুধের কাছাকাছি।
দুধ কেন আদর্শ খাবার, সেকথার ব্যাখ্যায় এর উপাদানগুলো নিয়ে তো জানা হলো। এবারে মানবদেহের জন্য দুধের কী কী উপকারিতা আছে সেসবই এক নজরে দেখে নিই চলুন।
হাড় ও দাঁতের সুরক্ষা
মানবদেহের ৯৯ শতাংশ ক্যালসিয়ামই হাড় ও দাঁতে সংরক্ষিত থাকে। হাড় ও দাঁতের সুরক্ষায় তাই দুধ হতে পারে একটি আদর্শ খাদ্য। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম আর ভিটামিন কে, ডি ও বি এর সমন্বয়ে হাড় ও দাঁতের জন্য দুধ হলো একটি প্রাকৃতিক শক্তিবর্ধক। তাছাড়া হাড়ের ৫০ শতাংশই প্রোটিন দ্বারা গঠিত; দাঁতের এনামেল ক্ষয়রোধেও প্রয়োজন নানা প্রকারের হোয়ে প্রোটিন। এখানেও দুধের বিকল্প নেই, যেটি কিনা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রোটিন। দুধে উপস্থিত ক্যাসেইন দাঁতের এনামেল রক্ষায় অপরিহার্য।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং নানাবিধ হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ ভেজিটেবল প্রোটিন, যা কিনা দুধে উপস্থিত। নিয়মিত দুধপান করলে দেহে প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ হয় এবং উচ্চমানসম্পন্ন প্রোটিন ও অ্যামাইনো এসিড সরবরাহ হয় যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ
গবেষণা বলছে, যারা চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের বদলে নিয়মিত দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণ করছে, তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক কম। নিয়মিত দুধ পান কিংবা দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণে একদিকে যেমন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে, অন্যদিকে দেহে ফ্যাটের অভাবও দেখা দেয় না। কারণ দুধে রয়েছে পরিমিত পরিমাণ ফ্যাট।
স্থূলতা রোধ
নিয়মিত দুধ পানে স্থূলতা রোধ হয় বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে অনেক গবেষণায়। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক ১৮ হাজার মধ্যবয়স্ক মানুষের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছেন যে, যারা নিয়মিত দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করে, তাদের স্থূলতার ঝুঁকি বা সম্ভাবনা দুটোই অত্যন্ত কম। দুধের পুষ্টি উপাদানগুলোই এক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। দুধে উপস্থিত উচ্চমানের প্রোটিন শরীরে প্রচুর শক্তি যোগায়। ফলে দীর্ঘ সময় আর ক্ষুধা অনুভব হয় না এবং প্রাকৃতিকভাবেই অতিরিক্ত আহার কমে যায়। তাছাড়া দুধে উপস্থিত লিনোলেয়িক এসিড ও দ্রবীভূত ক্যালসিয়ামও মেদ কমাতে সহায়তা করে।
তরল দুধ কিংবা দুধ দ্বারা তৈরি নানান পানীয় যেমন বাদাম দুধ, নারকেল দুধ, ওট মিল্ক, রাইস মিল্ক, সয়া মিল্ক, হেম্প মিল্ক, দুধের তৈরি মিষ্টান্ন আর পিঠাপুলি- সবকিছুই দুধের পুষ্টি গুণের কারণে দেহের বিকাশের জন্য আদর্শ। দেহকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও শক্তি যোগাতে প্রতিদিন দুধ পান করার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুধ কিংবা গুঁড়ো দুধ, দুটোই সমান কার্যকর। উপাদান এবং উপকারিতা দুই দিক থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ দুধকে কেন লেখার শুরুতে কোনো বিতর্ক ছাড়াই আদর্শ খাবার বলা হয়েছে, এখন নিশ্চয়ই পরিষ্কার?