আপেল বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে লাল রঙয়ের মিষ্টি এক ফলের কথা। সবুজ আপেলকে তুলনামূলকভাবে একটু কমই ভালোবেসে এসেছি আমরা। কিন্তু আপনি কি জানেন যে, পরিবেশ দূষণের কারণে এই লাল আপেল বিলুপ্তির সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছে অনেক পরিমাণে?
শুধু লাল বা সবুজ নয়, হালকা হলুদ, ডোরাকাটা আপেলও দেখতে পাওয়া যায় দোকানে। এই যে এত শত আপেল, সেগুলোর শুরুটা হয়েছিল বর্তমান কাজাখস্থানের মাটিতে। এই স্থানের পাহাড়গুলো পশ্চিম চীনের সীমানা টেনে দিয়েছে। স্থানটিতে আপেল এখনো জন্ম নেয়। মানুষ, পশুদের খাবার হয়ে যায়। বাতাসকে সুরভিত করে তোলে। তবে আপেলের এই বন্য গাছগুলো গত ৫০ বছরে শতকরা ৯০ ভাগ কমে গিয়েছে। কেন? অবশ্যই, বরাবরের মতো এই পরিবর্তনের পেছনেও রয়েছে মানুষের উন্নয়ন। ফলে এই পুরো স্থান এবং বুনো আপেলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
আপেলের রঙ লাল হয় কেন?
আপেল নানা রঙয়ের হয়ে থাকে। কিন্তু কেন? আর এই যে আপেলের লাল রঙ, সেটাই বা কেন তৈরি হয়? বিজ্ঞানীদের মতে, আপেলের লাল রঙয়ের পেছনে মূলত এর উপরিভাগের কিছু জিন কাজ করে। নিউজিল্যান্ডের ‘প্ল্যান্ট এন্ড ফুড রিসার্চ’-এর জেনেটিসিস্ট ডেভিড সি. জানান, আপেলের রঙ লালে পরিবর্তিত করার পেছনে অনেকগুলো এনজাইম একসাথে কাজ করে। এর ফলে তৈরি হয় অ্যান্থোসায়ানিন। ঠিক ধরেছেন, শুধু আপেল নয়, মিষ্টি আলুর মিষ্টি লালচে রঙ, আঙ্গুর আর পাম ফলের রঙ- এই সবগুলোর পেছনেই এই একটি উপাদান কাজ করে।
এই এনজাইমের পরিমাণ কোন ফলে কতটুকু হবে সেটা নির্ধারণ করে দেয় একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন। যার নাম এমওয়াইবি১০। খুব সহজে ব্যাপারটি বোঝাতে গেলে বলতে হয়, কোথাও যদি এমওয়াইবি১০ বেশি পরিমাণে থাকে সেক্ষেত্রে আপেলসহ অন্যান্য ফলের ত্বকের রঙ বেশি লাল হয়ে যাবে। এমনকি, যে আপেলগুলোর ত্বকে আপনি কিছু অংশে লাল এবং কিছু অংশে সবুজ বা হলুদ দেখতে পান, সেটির বেলায়ও কিন্তু লালচে অংশেই এমওয়াইবি১০ প্রোটিনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।
অবশ্য এই সবকিছুর পাশাপাশি তাপমাত্রাও রঙ নির্ধারণের পেছনে কাজ করে থাকে। ডেভিডের মতে, আপেলের রঙ পুরোপুরি লাল হতে হলে এর চারপাশের পরিবেশকে হতে হবে শীতল। কারণ, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হয়ে গেলেই এমওয়াইবি১০ এবং অ্যান্থোসায়ানিনের পরিমাণ ধ্বংস হয়ে যায়। এর উদাহরণ টানতেই স্পেনের কথা বলেন এই বিশেষজ্ঞ। সেখানে লালচে আপেল সেবার এক উষ্ণ জুলাই মাসের পর ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলো। তাপমাত্রা উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে আপেলের রঙ লাল হওয়ার সম্ভাবনাও কমে আসে তাই।
তাপমাত্রা কেন লালচে আপেলের পরিমাণকে কমিয়ে দিতে বা একেবারে বিলুপ্ত করতে পারে, সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকি নেই আপনার! চলুন, আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া যাক বিষয়টিকে।
তাপমাত্রা এবং সাথে লালচে আপেল কমে যাওয়ার সম্পর্ক
উপরে যেমনটা বলা হয়েছে যে, তাপমাত্রার সাথে আপেলকে লাল করতে পারে এমন উপাদান কমে আসে। ফলে লালচে আপেল তইরি হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে স্পেনের কথাও বলা হলো। এবার স্পেন এবং আপেলের লাল রঙয়ের পাশাপাশি আর কিছু ব্যাপারের দিকে চোখ বুলানো যাক!
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আপেলের এই রঙকে এগিয়ে রাখার প্রবণতা এশিয়ান বাজারগুলোতেই সবচাইতে বেশি দেখা যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। হয়তো আপনার তা-ই মনে হচ্ছে যে, আর যা-ই হোক, লাল আপেল বিলুপ্ত হবে না। কিন্তু ব্যাপারটি কিন্তু এত সহজ নয়। এমন অনেক কিছুই আগে ছিল, যেটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কালের বিবর্তনে। এই আপেলের কথাই ধরা যাক। মাইনের এক আপেল চাষী জন বাংকারের কাছে গেলেই আপনি কুচকুচে কালো এক আপেলের দেখা পান। এটি মূলত লাল আপেল। কিন্তু সেই লাল এতটাই তীব্র যে, আপনি ভুল করে সেটালে কালো পাম ফলও মনে করতে পারেন। এই প্রজাতির আপেল চাষের ক্রমান্বয় ধরে রেখেছেন জন নিজের আগ্রহ থেকেই। অন্যাথায়, এমন আপেলসহ কয়েক প্রজাতির ফল ইতিমধ্যেই বিলুপ হয়ে গিয়েছে এবং মানুষ সেগুলোর কথা বেমালুম ভুলেও গিয়েছে।
হয়তো অনেক বেশি চেষ্টা আর ব্রিডিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে উচ্চ তাপমাত্রাতেও লাল আপেলের জন্ম জিইয়ে রাখা যাবে ভবিষ্যতে। তবে সবুজ, হলুদসহ অন্যান্য রঙয়ের আপেল থাকতে এত চেষ্টা করে লাল আপেলের জন্ম কেন দিতে যাবে মানুষ? একটা সময় তাই বিশ্বের এই প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়া তাপমাত্রার জেরে আপেলের লালিমাটুকু হারিয়ে যেতেই পারে।
জন বাংকারের মতে, একটা সময় আপেলের লাল রঙকে এটি পেকে গিয়েছে কি না সেটা নির্ধারণ করার একটি উপায় হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু সবসময় এই একটি নির্ধারকের উপস্থিতি যে প্রয়োজন হয় তা নয়। ১৯২১ সালে ‘রেড ডেলিশিয়াস’ নামক আপেলটি সবার নজর কাড়তে এবং তালিকার প্রথমে নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছিলো। ভিন্ন ভিন্ন আপেল জন্ম দেওয়ার জন্য কাজ করতো তখন চাষীরা। তুলনামূলকভাবে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে আপেলের এই চাহিদা থাকলেও বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোতে আপেলের মূল কাজটাই হয় প্রস্তুতের পর। কখনো অ্যাপল সাইডার, কখনো অ্যাপল পাইয়ে তার স্থান হয়। যার জন্য তাজা আপেলের আর আপেলের রকমারি স্বাদের খুব একটা প্রয়োজন পড়ছে না কারো। চাহিদার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে যোগানও।
অবশ্য আপেল নিয়ে শুধু জন বাংকার নন, আর অনেকেই বেশ বিলাসী। তাই নিত্যনতুন আপেলের রকম আসছে। সেখানে রয়েছে হানিক্রিস্পস এবং আর অনেক মিউটেশন প্রক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া ধরণ। কিন্তু সেই লাল আপেল? রঙ পণ্যের চাহিদা বাড়ায়। লাল আপেলও এর বাইরে নয়। লাল যেমন বিপদের রঙ, লাল আপেল তেমনি স্বাদেও অনন্য। মানুষকে আকৃষ্ট করে এই আপেলের জাতটি। তবে তারপরেও, প্রতিনিয়ত শিল্প কারখানার উন্নয়ন, মানুষের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যাওয়া, যানবাহনের পরিমাণ বৃদ্ধি, জীবাশ্ম এবং কয়লা ব্যবহার- এই সবকিছুই একটু একটু করে পরিবেশকে দূষিত করে দিচ্ছে। এনওএএ ২০১৯ সালে যে বিশ্ব জলবায়ু সংক্রান্ত পরিমাপ প্রদান করে, সেই অনুসারে, ১৮৮০ সালের পর প্রতি যুগে আবহাওয়ার তাপমাত্রার পরিমাণ ০.০৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হিসেবে বেড়েছে। এই পুরোটা অবশ্য স্থল এবং সমুদ্র দুটোকে জুড়েই।
বেড়ে যাওয়া এই তাপমাত্রা ও দূষণকে মানুষের মৃত্যুর পঞ্চম বড় কারণ হিসেবেও জানানো হয়েছে। তাই এই যখন সামগ্রিক অবস্থা এবং আপেলের ত্বলে লালচে ভাব আনতে নির্দিষ্ট কিছু উপাদান ও শীতল আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে এমনটা হিসাব করাটা খুব কঠিন নয় যে, খুব দেরি নেই যখন প্রয়োজন, স্বল্পতা এবং উৎপাদনের পন্থা সহজ করার জন্য মানুষ ধীরে ধীরে লাল আপেলের কথা ভুলে যাবে। লাল আপেল না থাকলেও সেটা আর খুব একটা মানে রাখবে না কারো কাছেই।