সাহারা! নামটি শুনলেই আমাদের দৃষ্টিপটে ভেসে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত বালুরাশির কথা। মাইলের পর মাইল জনবিরল, উদ্ভিদ ও পানিশূন্য প্রান্তরে উটের পিঠে চড়ে বেড়ানো বেদুইনের কথা। একদিকে মরুরভূমিতে পথ হারানোর ভয়ে মন আচ্ছন্ন হয় শঙ্কায়, অন্যদিকে মরুর বুকে হঠাৎ জেগে ওঠা মরূদ্যান কিংবা মরুভূমিতে তারকাশোভিত রাতের কথা ভাবলেই শিহরণ জাগে হৃদয়ে। শিহরণ জাগানিয়া এই সাহারা মরুভূমির বিচিত্র তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের ফিচারটি।
অবস্থান, আয়তন ও জনসংখ্যা
অনেকেরই একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, সাহারা পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি। কিন্তু সংজ্ঞাগত কারণে এই তথ্যটি ভুল। কেননা পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি হল এন্টার্কটিকা এবং তারপরেই রয়েছে আর্কটিক অঞ্চল। তাই সাহারার রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। তবে ট্রপিক্যাল ডেজার্ট বা উষ্ণ মরুভূমি হিসাব করলে সাহারাই পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি। প্রায় ৩৬ লক্ষ বর্গমাইল বা ৯২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এই বিশাল মরুভূমি আয়তনে মোটামুটি চীন কিংবা আমেরিকার সমান। এ থেকে খুব সহজে অনুমান করা যায় কতটা বিশাল এই সাহারা।
সাহারা একটি আরবী শব্দ। আরবী ভাষায় মরুভূমির বহুবচন হল সাহারা। তাই অনেকেই এটা ভেবে ভুল করেন সাহারার অবস্থান বোধ হয় জাজিরাতুল আরবে। সাহারার অবস্থান উত্তর আফ্রিয়ায়। মিশর, সুদান, সাদ, লিবিয়া, নাইজার, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, পশ্চিম সাহারা মোট এগারোটি দেশ সাহারা মরুভূমির অংশ। তবে পশ্চিম সাহারা নামে দেশটি সার্বভৌম নয়, বর্তমানে সেটি মরক্কোর অংশ।
সাহারা মরুভূমি পৃথিবীর জনবিরলতম ভূমিগুলোর একটি। জনসংখ্যা মাত্র পঁয়ত্রিশ লক্ষ। বলতে গেলে প্রতি বর্গমাইলে মাত্র একজন মানুষ বসবাস করে এখানে এবং বাসিন্দাদের প্রায় সবাই বেদুইন অর্থাৎ এদের স্থায়ী কোনো নিবাস নেই। উট ও মেষের পাল নিয়ে মরুরবুকে তারা ছুটে চলে চারণ ভূমির সন্ধানে। এখানে প্রধান ভাষা হলো আরবী। বলতে গেলে সাহারা অঞ্চলে প্রায় সবাই লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসাবে আরবী বলতে এবং বুঝতে পারে। এই অঞ্চলের প্রধান ধর্ম হলো ইসলাম। এছাড়া অন্যান্য ধর্মেরও কিছু অনুসারী রয়েছে।
সাহারা মরুভূমির বয়স মাত্র ৪ হাজার বছর!
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সাহারা মরুভূমি একসময় ছিল উর্বর ভূমি এবং সেটি খুব বেশি দিন আগের কথা নয়! আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে হঠাৎ জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুণ পুরো সাহারা অঞ্চল স্যাভানায় পরিণত হয়েছিল যা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ৫,০০০ বছর। তারপর বর্তমান মরুভূমি রূপের আবির্ভাব ঘটা শুরু হয় সাহারায়। আমরা জানি পৃথিবী তার ঘূর্ণন সাথে সাথে ২৩.৪৪ ডিগ্রী কোণে হেলে আছে। তবে মজার ব্যাপার হলো এই কোণের মান সবসময় একই থাকে না। ৪১,০০০ বছর পর্যায়কালে ২২.১ থেকে ২৪.৫ ডিগ্রীর মধ্যে ওঠা নামা করে।
মূলত পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ সরে যাওয়ার ফলেই সাহারা অঞ্চলে মরুকরণের সূচনা হয়েছিল। ফলে আজ থেকে ৪,০০০ বছর আগে স্যাভানা থেকে মরুভূমিতে পরিণত হয় সাহারা। পরিবেশবিদরা তাই ধারণা করছেন অদূর ভবিষ্যতে বদলে যাবে সাহারার বর্তমান চিত্র। হয়ত আরও প্রসারিত পারে সাহারা কিংবা আবারও সবুজ জেগে উঠতে পারে এই মরুভূমিতে। তবে সন্দেহ নেই বর্তমানে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সাহারার তাপমাত্রা। ১৯৯২ সালে লিবিয়ার সাহারা অঞ্চলে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৫৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস যা মানুষের জানা মতে আজ অবধি এই অঞ্চলে সর্বোচ্চ।
ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু
সাহারা মরুভূমি অত্যন্ত উষ্ণ। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর শুষ্কতম স্থান হলো সাহারা। এর প্রায় অর্ধেক অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২ সেন্টিমিটারের নিচে। এমনকি কিছু এলাকায় কোনো কোনো বছর কেটে যেতে পারে একেবারে বৃষ্টিবিহীনভাবে। বাকি অঞ্চলগুলোতে অবশ্য গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০ সেন্টিমিটারের উপরে। সাহারায় বালিঝড় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, তবে বজ্রপাতের ঘটনাও কিন্তু বিরল নয়। মরুভূমিতে বৃষ্টিপাতের সময় আকাশ বাদামী কালো মেঘে ঢেকে যায়। নামে ক্ষণিকের মধ্যেই নামে বজ্রপাতসহ প্রচন্ড বৃষ্টি।
দিনের বেলা তাপমাত্রা গড়ে ৪৬ থেকে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে, কিন্তু রাতের বেলা কখনও কখনও তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৬ ডিগ্রী অবধি নেমে যায়। মজার ব্যাপার হলো সাহারায় কিছু কিছু স্থানে, বিশেষ করে পাহাড়ের চূড়াগুলোতে, শীতকালে তুষারপাতও দেখা যায়!
মরুভূমি বলতে আমরা যেমনটা বুঝি শুধু ধূ ধূ বালি বাস্তবে কিন্তু আসলে তেমনটা নয়। সাহারা মরুভূমিতে মাত্র ৩০% বালি আর বাকি ৭০% হল গ্র্যাভেল। এমনকি ভূগর্ভস্থ পানির এক বিশাল ভান্ডারও রয়েছে সাহারার নিচে। আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো সাহারায় প্রায় ৮০ হাজার বর্গমাইল এলাকা হলো মরূদ্যান যা এর আয়তনের প্রায় ২ শতাংশ। ভূগর্ভস্থ পানি হলো মরূদ্যান জেগে ওঠার মূল কারণ। পৃথিবীর মোট মরূদ্যানের প্রায় ৯০ শতাংশই রয়েছে সাহারার বুকে। এছাড়া কিছু কিছু নদীরও দেখা মেলে সাহারায়। তবে নদীগুলো ঋতুনির্ভর ও বিচ্ছিন্ন। কমপক্ষে ২০টির মতো হ্রদ রয়েছে গোটা সাহারায়। এগুলোর মধ্যে একমাত্র সাদ লেকই সাদুপানির লেক, বাকিগুলো লোনাপানির।
উট: মরুভূমির বুকে এক বিস্ময়
শুধু সাহারায় নয়, পৃথিবীর প্রায় সকল উষ্ণ মরুভূমিতে মানুষের জীবন অনেকটা উট নির্ভর। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে সাহারায় উটের আগমন হয়েছিল আরবদের মাধ্যমে। সেই থেকে উট এখানে মানুষের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আর হবেই বা না কেন? উট বিস্ময়করভাবে ১৭ দিন অবধি একটানা পানি পান না করে বেঁচে থাকতে পারে। তারপর একসাথে পান করে নেয় প্রায় ১০০ লিটারের মতো জল। উটের একটি চমৎকার বিশেষত্ব হলো এর কুজ। উট সঞ্চিত চর্বি অক্সিডাইজ করে পানি তৈরি করতে পারে। তাই দীর্ঘ সময় পানি পান না করলেও ওদের সমস্যা হয় না। এছাড়া উটের নিশ্বাসের সাথে জলীয়বাষ্প নিঃসরণের পরিমাণ খুব অল্প। তাই পানির অপচয়ও হয় খুবই সামান্য।
উপরন্তু উটের দুধ ভীষণ পুষ্টিকর এবং মাংসও উপাদেয়। তাই মরুভূমি জীবন ও অর্থনীতি যেন অনেকটা উটের উপর নির্ভরশীল। সাহারা অঞ্চলে বেদুইনদের দ্বিতীয় প্রধান গবাদি পশু হলো ছাগল। সাহারায় খেজুর গাছের আমদানীও আরবদের অবদান। আরবদের হাত ধরে সাহারায় প্রবেশ করেছে অত্যন্ত কার্যকর ও উপাদেয় এই ফলটি।
প্রাণী বৈচিত্র্য
সাহারায় জীববৈচিত্র্য তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও বিচিত্র রকমের প্রাণীর দেখা মেলে এই মরুভূমিতে। এরা সবাই সাহারার কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত হয়েছে। এখানকার অ্যাডাক্স নামের হরিণ জাতীয় একটি প্রাণী তো প্রায় বছরখানেক পানি পান না করে বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়াও রয়েছে শিংওয়ালা ভাইপার কুমির ও বিভিন্ন রকমের মরুভূমির সরীসৃপ, শিয়াল ও হরিণ। এমনকি চিতা বাঘেরও দেখা মেলে সাহারায়।
পরিশেষে বলতে হয় সাহারা মরুভূমি এক জীবন্ত নিঃসঙ্গতার নাম। আবহাওয়া এখানে চরমভাবাপন্ন- দিনে প্রচন্ড গরম আর রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা। জীবন এখানে অমসৃণ এবং কল্পনাতীত সংগ্রামময়। সাদ, নাইজার কিংবা সুদানের অনেক জায়গায় আজও উটকে পানি পান করানোর লাইন ভাঙ্গার জের ধরে গোত্রে গোত্রে বাঁধে ভয়ানক বিবাদ। এখানে একবার পথ হারিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। হাজার হাজার কিংবা কখনও হয়ত লাখো বর্গকিলোমিটারের মধ্যেও একজন মানুষ থাকবে না পথহারা পথিকের আর্তচিৎকার শোনার জন্য। জীবন এখানে পার করে গেছে সহ্যের সকল মাত্রা।
তারাভরা রাতের আকাশের সৌন্দর্য এখানকার মানুষকে মোহিত করে প্রতিনিয়ত। কিন্তু বিপুলা ধরণী তার মরুসন্তানদের প্রতি সত্যিই অনেক কৃপণা, আসলেই অনেক বেশি কঠোর। এখানে প্রতিটি জীবনের গল্প যেন এক একটি সংগ্রাম গাঁথা!