বায়ুমণ্ডলীয় নদী: যে নদী বয়ে চলেছে আকাশ জুড়ে

নীল নদকে আফ্রিকার ‘জীবনী শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১১টি আফ্রিকান দেশ জুড়ে বিস্তৃত এই নদী পুরো আফ্রিকাকে যেন নিজের শাখা-প্রশাখা দিয়ে আগলে রেখেছে মমতাময়ী মায়ের মতো। এই বিশাল নদী আবার দু’টো প্রধান শাখা নদীতে বিভক্ত- হোয়াইট নীল এবং ব্লু নীল। ভিক্টোরিয়া হ্রদের জলরাশি থেকে উৎপন্ন নীল নদ মধ্যযুগ থেকে আফ্রিকার বুকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিখ্যাত মিশর সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিলো এই নীল নদের তীর ঘেঁষে। যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী কোনটি? তাহলে অনায়াসে উত্তর মিলবে, সেটি আফ্রিকার নীল নদ। প্রায় ৪,২৫৮ মাইল দীর্ঘ নীল নদের চেয়ে বড় নদী পৃথিবীর কোথাও নেই। তবে কিছু কিছু জরিপে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

a
মিশরের নীল নদ; Image Source: RTI National

সুপ্রিয় পাঠক, আজকে আপনাদের এমন একটি নদীর সাথে পরিচয় করাবো, যেটি এই নীল নদ ও আমাজন থেকেও কয়েক গুণ বড়। শুনে আপনারা অবাক হতে পারেন। বলতে পারেন, “কই? কোথাও এদের চেয়ে বড় নদী আছে, এমন তথ্য কখনো শুনিনি।”  তাহলে বলবো, অবশ্যই আছে। তবে এই নদী আমাদের ভূপৃষ্ঠের কোথাও বয়ে চলছে না। এই নদী কোনো সাগরে পতিত হচ্ছে না। এই দীর্ঘ নদীর অবস্থান আমাদের মাথার উপরে, বায়ুমণ্ডলে। অবস্থান অনুযায়ী এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বায়ুমণ্ডলীয় নদী’ (Atmospheric River).

বায়ুমণ্ডলীয় নদী কী?  

‘বায়ুমণ্ডলীয় নদী’ প্রত্যয়টির উদ্ভাবক হিসেবে বিখ্যাত আবহাওয়াবিদ ইয়ুং ঝু এবং রেজিনাল্ড নুয়েলের নাম নেওয়া যায়। আমাদের বায়ুমণ্ডলে বয়ে চলা সুদীর্ঘ এবং বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্পের খরস্রোতা প্রবাহকে বায়ুমণ্ডলীয় নদী বলা হয়। ১৯৯০ সালে যখন সর্বপ্রথম এই শব্দের ব্যবহার হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে, এই প্রবাহকে নদী বলার কারণ কী? নদী হচ্ছে এমন একটি ভৌগোলিক উপাদান, যেখানে পানি জমা হয় এবং তা একই দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। নদী তার চলার পথে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হতে পারে। বায়ুমণ্ডলে থাকা এই জলীয় বাষ্পের প্রবাহও ডাঙার নদীর মতো একদিকে প্রবাহিত হয়। চলার পথে এখানেও শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি হয়। এছাড়া এখানে থাকা জলীয় বাষ্পের পরিমাণ নদীর মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। এজন্য আবহাওয়াবিদদের নিকট এটি একটি নদী। বায়ুমণ্ডলীয় নদী আয়তনে প্রায় তিনশত মাইল প্রশস্ত এবং প্রায় এক হাজার মাইল পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই নদীর জলীয় বাষ্প যদি একত্র করা হয়, তাহলে সেটি আমাজন এবং নীল নদ দু’টোর পানির পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে।

স্যাটেলাইট ফুটেজে বায়ুমণ্ডলীয় নদী; Image Source: SnowBrains

কোথায় আছে এই নদী?

আমাদের বায়ুমণ্ডলকে উচ্চতাভেদে ট্রোপোস্ফিয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার এবং থার্মোস্ফিয়ারে ভাগ করা হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে কম উচ্চতায় (৭-১৫ কিলোমিটার) থাকা স্তর হচ্ছে ট্রোপোস্ফিয়ার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুমণ্ডলীয় নদী এই ট্রোপোস্ফিয়ার অঞ্চলের উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী প্রধানত মহাসাগরের উপর দিয়ে বিস্তৃত।

বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর; Image Source: World Atlas

কিন্তু এই উচ্চতায় বয়ে চলা শক্তিশালীর বায়ুর প্রভাবে এই নদী ধীরে ধীরে ডাঙার দিকে ধাবিত হতে থাকে। বায়ুতে ভেসে বেড়ানো আর্দ্র বাতাস এই বায়ু প্রবাহের ফলে নদীর জলীয় বাষ্পে মিশে যেতে পারে। পৃথিবীতে যেমন নদীর সুন্দর সুন্দর নাম দেওয়া হয়, তেমনি এই বায়ুমণ্ডলীয় নদীকেও নামকরণ করা হয়। যেমন ধরা যাক, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের দিকে প্রবাহিত হওয়া বায়ুমণ্ডলীয় নদীর কথা। হাওয়াই থেকে যুক্তরাষ্ট্র উপকূল পর্যন্ত দীর্ঘ এই নদীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘পাইন-অ্যাপল এক্সপ্রেস’। তবে পৃথিবীর নদীর মতো এদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে না।

কীভাবে গঠিত হয় এই নদী?

আমাজনের গহীন বন; Image Source: Wired

পৃথিবীতে যেমন বৃষ্টিপাত কিংবা তুষারে জমে থাকা বরফগলা পানি থেকে নদীর সৃষ্টি হয়, তেমনি নিশ্চয় বায়ুমণ্ডলীয় নদীরও একটি পানির উৎস রয়েছে। এই পানির প্রধান উৎস ভূপৃষ্ঠ থেকে আকাশের দিকে ধাবিত হওয়া আর্দ্র বাষ্প। আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনের নাম আমাজন। এই বনাঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। প্রতিদিন আমাজনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এসব বৃক্ষের পাতা থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি জলীয় বাষ্পরূপে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় নির্গত হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এসব জলীয় বাষ্প ধীরে ধীরে উপরের দিকে প্রবাহিত হয় এবং বায়ুমণ্ডলীয় নদীর সাথে মিশে যায়। এছাড়া ভূপৃষ্ঠে সূর্যের তাপে গরম হয়ে যাওয়া উষ্ণ আর্দ্র বায়ু প্রবাহের সময় মালভূমি, পাহাড়, পর্বত ইত্যাদি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এবং দিক পরিবর্তন করে উপরের দিকে ধাবিত হয়। প্রায় ৬ থেকে ১২ মাইল উচ্চতায় উষ্ণ বায়ু কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতায় স্থির হয়ে একদিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এর ফলে একটি নদীর জন্ম হয়।

মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলেও নদীর জন্ম হয়; Image Source: NOAA

মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলেও নদীর জন্ম হয়। কোনো ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো যদি প্রতি সেকেন্ডে প্রতি মিটার অঞ্চলে ২৫০ কেজির বেশি পরিমাণ জলীয় বাষ্প প্রবাহিত করতে পারে, সেক্ষেত্রে সেটি বায়ুমণ্ডলীয় নদীতে রূপান্তরিত হতে পারে। কিন্তু, এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, এই প্রবাহের ব্যাপ্তি একদিনের বেশি হতে হবে।   

নদীর তাৎপর্য কী?

যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চলে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে ২০১০ সালের ১০ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত একনাগাড়ে ভারি বর্ষণ হয়। কিছু কিছু অঞ্চলে প্রায় ২৫ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছিল। কিন্তু বছরের এই সময়ে সেখানে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা নয়। তাই আবহাওয়াবিদরা এই অঞ্চলের জলীয় বাষ্প নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। শেষমেশ দেখা গেলো, এই বৃষ্টিপাতের পেছনে একটি নদীর হাত রয়েছে, যার নাম ‘পাইন-অ্যাপল এক্সপ্রেস’। এই বায়ুমণ্ডলীয় নদীর প্রভাবে সেবার এই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সময়-অসময়ে এই নদীর প্রভাবে হুট করে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যেতে পারে।

আবহাওয়ার উপর নদীর প্রভাব; Image Source: Accu Weather

বায়ুমণ্ডলীয় নদী বিভিন্ন আকারের হয়। যেসব নদীতে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি জলীয় বাষ্প থাকে, সেগুলো যদি শক্তিশালী বায়ুর প্রভাবে সমুদ্র অঞ্চল থেকে ডাঙার উপর চলে আসে, সেক্ষেত্রে ভারি বর্ষণ হতে পারে। এর ফলে জলাবদ্ধতা এবং বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এর মানে এই নয়, বায়ুমণ্ডলীয় নদী শুধু ভূপৃষ্ঠে দুর্যোগ বয়ে আনে। এই নদী বিশ্ব জলবায়ুতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নদীর বিস্তৃতি দুই গোলার্ধেই রয়েছে। ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে এই নদী অক্ষরেখার মাঝ পর্যন্ত ব্যাপ্তি। এর ফলে এটি কর্কটক্রান্তি এবং মকরক্রান্তির অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল এই নদীর অধীনে চলে আসে। এই বিশাল অঞ্চল জুড়ে জলবায়ুতে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটাতে পারে এই নদী। এর ফলে চিলি, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পশ্চিম ইউরোপ এমনকি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের জলবায়ুতেও পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্পের প্রায় ৯০% আর্দ্রতার পেছনে এই নদী প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বায়ুমণ্ডলীয় নদী প্রভাব ফেলতে পারে; Image Source: NBC Bay Area

পৃথিবীর সিংহভাগ জলীয় বাষ্প প্রবাহে ভূমিকা পালন করছে বায়ুমণ্ডল জুড়ে রাজত্ব করা এই নদীটি। বিভিন্ন অঞ্চলে ঋতুভেদে বর্ষণ ঘটার যে চল দেখা যায়, সেখানে বেশ বড় পরিবর্তন আনতে পারে এটি। যদিও বিশেষকরা এর মাঝে বিপদের কিছু দেখছেন না, তবে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটলে প্রাণীজগতে চোখে পড়ার মতো প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি অসময়ে ঝড়ের কবলে পড়তে পারে ক্রান্তীয় অঞ্চলের বহু দেশ।

This is a Bangla article about the atmospheric river which is formed of moist water vapor and is larger than any terrestrial river.

Reference: All the references are hyperlinked.

Featured image: UCLA

Related Articles

Exit mobile version