প্রায় ৩ মাস টানাপোড়েনের পর মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে চীন এবং মায়ানমার একমত হয়েছে বলে জানা গেছে। চীনা সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে ঘোষণা আসবে। কিন্তু বন্ধুপ্রতিম এই দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন কেন শুরু হয়েছিল সে ব্যাপারে জানতে গেলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আর সেজন্য শুরুতে জানা চাই, প্রকল্পের আওতায় চীন এই সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করে দেবে, সেই বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ আসলে কী।
বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ
বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা সংক্ষেপে BRI হলো চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর স্বপ্নপ্রসূত এক মেগা প্রকল্প। একে একবিংশ শতাব্দীর সিল্ক রোড বলেও আখ্যা দিচ্ছেন অনেকে। প্রাচীনকালে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে দক্ষিণ ইউরোপ আর পূর্ব আফ্রিকার সংযোগকারী স্থলপথ এবং সমুদ্রপথগুলোকে একত্রে বলা হতো সিল্ক রোড।
আধুনিককালের এই প্রকল্পও গঠিত হয়েছে স্থলভাগের অনেকগুলো করিডোরের একটি ‘বেল্ট’ এবং অনেকগুলো সামুদ্রিক শিপিং লেনের একটি ‘রোড’ নিয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এই পরিকল্পনার আওতায় পড়েছে ৭১টি দেশ, যাদের সর্বমোট জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক এবং যেখানে রয়েছে পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ জিডিপি। এই প্রকল্পের সম্ভাব্য বাজেট ধরা হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং ইতোমধ্যে চীন প্রায় ২১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বলে জানা যায়। এই প্রকল্পের অধীনে ইতোমধ্যে চীনের কনস্ট্রাকশন ফার্মগুলো প্রায় ৩১০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কাজ পেয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই প্রকল্পের অধীনে ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের গাদার বন্দর এবং শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর।
গাদার বন্দর
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাদার বন্দর এলাকাটি কয়েক বছর আগেও ছিল জেলেদের কিছু গ্রামের সমষ্টি। কিন্তু ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পের আওতায় চীনের সহায়তায় খুব দ্রুত এখানে নির্মিত হয় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরের মাধ্যমে আরব সাগর থেকে কারাকোরাম মহাসড়ক হয়ে আরব সাগরের সাথে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সংযোগ ঘটেছে। উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত এই প্রদেশের ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ এক ধাপ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চা
য়না ওভারসিজ পোর্ট হোল্ডিং কোম্পানি (CPHOC) এই বন্দরটি নির্মাণ করে এবং নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তান সরকার ২০১৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানকেই বন্দরটি ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়। হরমুজ প্রণালী এবং লোহিত সাগরের নিকটে গাদার বন্দরের অবস্থানের কারণে এই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ পাওয়াকে চীনের আধিপত্য বিস্তারের একটি ধাপ বলে দেখছেন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ঠিক একই কারণে গাদার বন্দর থেকে মাত্র ১৭২ কিলোমিটার পশ্চিমে ইরানের চাবাহার এলাকায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে ভারত। নিকটবর্তী দুটি গভীর সমুদ্রবন্দরে দুই পরাশক্তির অবস্থান তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ। গাদার বন্দরে চীনের সামরিক উপস্থিতির আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের আশঙ্কার পালে হাওয়া দিয়েছে শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর প্রকল্প এবং চীনের আচরণ।
হাম্বানটোটা বন্দর
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের হাম্বানটোটা বন্দর এবং বন্দর সংলগ্ন ১৫০০০ একর জমি চীনের সরকারী প্রতিষ্ঠান চায়না হারবারকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। এই লিজ দেবার পেছনে রয়েছে চীনের আগ্রাসী উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর শ্রীলঙ্কা সরকারের ভেতরের দুর্নীতির আখ্যান, যার ফল হিসেবে চীন পেয়ে গেছে ভারত মহাসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন নিয়ন্ত্রণ। এলটিটিই গেরিলাদের দমন করতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বদরবারে মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষের শ্রীলঙ্কা সরকার যখন একঘরে হয়ে পড়ে, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় চীন। রাজাপাক্ষের নিজের শহর হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পেও টাকা ঢালে চীন সরকার।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই এই বন্দর নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছিলেন, কেননা ইতোমধ্যে রাজধানী কলম্বোতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর রয়েছে এবং সে বন্দরটি সম্প্রসারণ করাও সম্ভব। সম্প্রসারণের উদ্যোগ না নিয়ে ২য় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ শ্রীলঙ্কার মতো একটি ছোট দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না, এই হুঁশিয়ারিতেও টলেনি রাজাপাক্ষের সরকার।
চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে ৩০৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ২০০৭ সালে শুরু হয় হাম্বানটোটা বন্দরের নির্মাণকাজ। ঋণের শর্ত হিসেবে বন্দর নির্মাণের কাজ পায় চীনের আরেকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, চায়না হারবার এবং স্বাভাবিকভাবেই চীনা নির্মাণশ্রমিক এবং প্রকৌশলীদের আধিক্য থাকে প্রকল্পজুড়ে। কিন্তু এই শর্তের বাইরেও হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণে সহায়তার পেছনে প্রথম থেকেই চীনের সামরিক স্বার্থও কাজ করেছে।
প্রকল্পের চুক্তিস্বাক্ষরের সাথে জড়িত শ্রীলঙ্কান কূটনৈতিকদের মতে, শুরু থেকেই চীনের অলিখিত শর্ত ছিল এই বন্দর ব্যবহারকারী সব জাহাজের এবং বন্দর পরিচালনার কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ করবে চীন। এই বন্দরের কাজ পাইয়ে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষেকে ২০১৫ এর নির্বাচনে বিজয়ী করার জন্য অকাতরে টাকা ঢালে চীন। রাজাপাক্ষের নির্বাচনী প্রচারণা তহবিলে চায়না হারবার কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ৭৬ লাখ ডলার জমা হয়েছে বলে জানা যায় শ্রীলঙ্কা সরকারের এক অপ্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। চীনের এই অর্থব্যয়ের মূল কারণ ছিল রাজাপাক্ষের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনী ম্যান্ডেট, যেখানে শ্রীলঙ্কাকে চীন সরকারের ঋণের জাল থেকে মুক্ত করা ছিল একটি বড় ইস্যু।
২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু হবার পর ২০১০ সালে এসে তড়িঘড়ি করেই উদ্বোধন করা হয় হাম্বানটোটা বন্দর। কিন্তু শুরু থেকেই বন্দরটি জাহাজ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। ২০১২ সালে এসে শ্রীলঙ্কা সরকার বন্দরটি সম্প্রসারণের জন্য আবার চীনের কাছে ঋণ চায়, এবার চীন ৭৫৭ মিলিয়ন ডলার দেয় উচ্চ সুদে। চীনের এই ঋণ রাজাপাক্ষের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। শেষপর্যন্ত ২০১৫ সালের নির্বাচনে রাজাপাক্ষে পরাজিত হন। কিন্তু নতুন সরকার এসেও পড়ে বিপাকে, চীনের এই বিশাল ঋণ শোধের দায় উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। আগের সরকারের রেখে যাওয়া ৪৪ বিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় দেনা শোধ করতে গিয়ে আবারও চীন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা সরকার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে শ্রীলঙ্কার কাছে চীনের পাওনা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৬ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রতিনিধিরা চীন সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করেন এই বিপুল দেন শোধ করার উপায় খুঁজতে, বিশেষ করে হাম্বানটোটা বন্দরের ব্যাপারে। কিন্তু এবার আলোচনায় বসে চীন সুর বদলায়, সরাসরি দাবি জানায় বন্দর নির্মাণের জন্য নেওয়া ঋণ মওকুফের বদলে চীনকে লিখে দিতে হবে বন্দরটির সিংহভাগ অংশ। দেনার দায়ে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা সরকারের এই দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তারা শুধু ঠিক করতে পেরেছিল চীনের কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান এই বন্দরটি পাবে- চায়না হারবার নাকি চায়না মার্চেন্ট পোর্ট।
চায়না মার্চেন্ট পোর্ট শেষপর্যন্ত বন্দর পরিচালনার কাজটি পায় এবং এবার তারা দাবি করে বন্দর সংলগ্ন আরও ১৫,০০০ একর জমি তাদের লিখে দিতে হবে, যেখানে নির্মিত হবে একটি শিল্পাঞ্চল। দাবির স্বপক্ষে তাদের যুক্তি ছিল যে, এই বন্দরের জন্য নেওয়া ১.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করার জন্য কেবল বন্দরের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট নয়। নিরুপায় শ্রীলঙ্কা সরকার দাবি মেনে নিয়ে ২০১৭ এর জুলাইতে চুক্তি স্বাক্ষর করে, চুক্তিটি কার্যকর হয় একই বছরের ডিসেম্বরে।
চীনের হাম্বানটোটা বন্দর নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ভারতের বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়, কেননা এই বন্দরের মাধ্যমে চীন ভারতের উপকূলের মাত্র কয়েকশ কিলোমিটার দূরেই নিজেদের রণতরী রাখার একটি জায়গা নিশ্চিত করলো। ভারতের ক্রমাগত আপত্তির মুখে শ্রীলঙ্কা সরকার চীনের সাথে চুক্তিতে একটি ধারা যুক্ত করে, যেখানে বলা আছে, শ্রীলঙ্কা সরকারের অনুমতি ব্যতীত বন্দরটি সামরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু এই চুক্তি আদতে চীনকে কতটা ঠেকাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়।
কলম্বো বন্দরে চায়না হারবার একটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করেছে, যার অংশ হিসেবে ৫০ একর জমিও পেয়েছে চৈনিক প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে শ্রীলঙ্কার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার এই অসহায়ত্ব পরিস্কার হয়ে ওঠে ২০১৪ সালে জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সফরের সময়। তিনি যেদিন শ্রীলঙ্কা আসেন ঠিক সেদিনই কলম্বো বন্দরে ভেড়ে চীনের দুটি যুদ্ধজাহাজ। চীনের এই সামরিক বার্তা আমলে নিয়ে তাই ভারত শুরু থেকেই হাম্বানটোটা বন্দর নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ভারতের আশঙ্কা, দক্ষিণে হাম্বানটোটা এবং পশ্চিমে গাদার বন্দরে চীন স্থায়ী নৌবহর রাখার পরিকল্পনা করছে।
রাখাইন প্রদেশে সমুদ্রবন্দর
মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের কিয়াকপিউ অঞ্চলে ৭.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীন এবং মায়ানমারের মধ্যে সমঝোতা হলেও শেষ মুহূর্তে প্রকল্প থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল মায়ানমার। নির্মাণব্যয়কে অতিরিক্ত উল্লেখ করে মায়ানমার সরকারসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চীনের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়তে হবে এই আশংকায় মায়ানমার শেষ মুহূর্তে অবস্থান পরিবর্তন করে। শেষপর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় ৬ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে আনা হয়েছে ১.৩ বিলিয়নে। এছাড়াও বন্দরটিতে চীনের অংশীদারিত্ব নামিয়ে আনা হয়েছে ৭০ শতাংশে। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পগুলোর হালচাল দেখে মায়ানমারের এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছে সরকারসংশ্লিষ্ট সূত্রটি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছিল চীন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই প্রকল্প আর এগোয়নি। হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার কোম্পানিকে সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ সাধার দায়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং সেখানে দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চীনের এই কৌশল শেষপর্যন্ত চীনের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধিতে কতটা কাজে দেবে তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরেক পরাশক্তি ভারতের সাথে যে চীনের টক্কর আরও অনেকদিন ধরে চলতে থাকবে, তা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়।