পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে যেমন উঁচু-নিচু, গর্ত ইত্যাদি দেখা যায়, তেমনি অন্যান্য গ্রহের গায়েও দেখা যায়। এগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে চলেছেন প্রতি মুহূর্তেই। নাসা সর্বদা তৎপর অন্য গ্রহের ভিন্ন তথ্যের সন্ধানে, পাঠানো হয়েছে স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত ছবিতে বিভিন্ন জ্বালামুখ বা গহ্বর দেখা গিয়েছে এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (IAU) সেগুলোর নামকরণ করে থাকে। IAU এর Working Group for Planetary System Nomenclature এর নিয়মানুসারে নতুন সকল জ্বালামুখের বা গহ্বরের নাম হবে এমন শিল্পীদের নামানুসারে, যারা পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পৃথিবীতে বিখ্যাত ছিলেন এবং নামকরণের তারিখের কমপক্ষে তিন বছর আগে মারা গিয়েছেন।
সৌরজগতে সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধের বেশিরভাগ জ্বালামুখের নাম বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী প্রমুখ প্রতিভাবান এবং বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিবর্গের নামানুসারে। ২০১৭ সালের তথ্যানুসারে, বুধের ৩৯৭টি জ্বালামুখের এরূপ নামকরণ করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশী একজনের নাম এবং ভারতীয় ১১ জনের নামও রয়েছে। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক বুধের বুকে স্মরণীয় করে রাখা সেসকল প্রতিভাবান এবং বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সম্পর্কে।
আবেদিন
বুধের পৃষ্ঠে ১১৬ কি.মি. ব্যাসের জটিল প্রকৃতির একটি গহ্বর আবিষ্কৃত হয়। ২০০৯ সালের ৯ই জুলাই এটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নামানুসারে। জয়নুল আবেদিনের জন্ম ১৯১৪ সালে এবং মৃত্যু ১৯৭৬ সালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রতিষ্ঠাতা।
আবু নুওয়াস
বিখ্যাত ক্লাসিক্যাল আরবীয় কবি আবু নুওয়াসের নামানুসারে ১৯৭৬ সালে ১১৭ কি.মি. ব্যাসের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করে IAU। আবু নুওয়াসের জন্ম ১৯১৬ সালে ইরানে।
আহমেদ বাবা
১৯৭৯ সালে বুধের পৃষ্ঠে ১২৬ কি.মি. ব্যাসের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয় মধ্যযুগের বিখ্যাত আফ্রিকান লেখক এবং বুদ্ধিজীবী আহমেদ বাবার নামানুসারে। আহমেদ বাবার পুরো নাম ছিল আবু আল-আব্বাস আহমেদ ইবনে আহমেদ আল- তাকরুরি আল-মাসসুফি আল-তিম্বুক্তি। জীবদ্দশায় তিনি ৪০টিরও বেশি বই লিখেছেন। তার জন্ম ১৫৫৬ সালে এবং মৃত্যু ১৬২৭ সালে।
আফ্রিকানুস হরতন
১৯৭৬ সালে ১৪০ কি.মি. ব্যাসবিশিষ্ট এই গহ্বরের নামকরণ করা হয় সিয়েরা লিওনের ক্রেওল আফ্রিকান লেখক এবং ব্রিটিশ আর্মি মেডিকেলের সার্জন আফ্রিকানুস হরতনের নামানুসারে। অনেকে তাকে ‘জেমস বেলে’ নামেও চেনে। তার জন্ম ১৮৩৫ সালে এবং মৃত্যু ১৮৮৩ সালে। তাকে ‘আধুনিক আফ্রিকার রাজনৈতিক চিন্তাধারার জনক বলা হয়ে থাকে। তার রচিত বিখ্যাত একটি বই ‘African Countries and Peoples’।
ডিকেন্স
ইংরেজ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্সের নামানুসারে ১৯৭৬ সালে ৭৮ কি.মি. ব্যাসবিশিষ্ট একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয় ‘ডিকেন্স’। ভিক্টোরিয়ান যুগের অন্যতম ঔপন্যাসিক এবং সমাজ সমালোচক চার্লস ডিকেন্সের জন্ম ১৮১২ সালে এবং মৃত্যু ১৮৭০ সালে। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি ১৫টি উপন্যাস, ৫টি উপন্যাসিকা, একশ’র বেশি ছোট গল্প এবং নন-ফিকশন প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
গ্যেটে বেসিন
জ্বালামুখের ব্যাস ২৫০ কি.মি. এর বেশি হলে তাকে ‘বেসিন’ বলা হয়ে থাকে। ৩২০ কি.মি. ব্যাসের এই বেসিনের নামকরণ করা হয় বিখ্যাত জার্মান লেখক জোহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটের নামানুসারে। কবিতা, গদ্য, পদ্য, উপন্যাস, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, সমালোচনামূলক প্রবন্ধ, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং অ্যানাটমি বিষয়ক গ্রন্থ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল তার উজ্জ্বল পদচারণা। তার জন্ম ১৭৪৯ সালে এবং মৃত্যু ১৮৩২ সালে।
আল-হামাদানি
১৯৭৯ সালে ১৮৬ কিমি. ব্যাসবিশিষ্ট এ গহ্বরের নাম দেয়া হয় মধ্যযুগের আরবীয় লেখক বা’দি আল-জামান আল-হামাদানির নামানুসারে। তার এই আরবি নামের বাংলা অর্থ করা হয় ‘যুগের বিস্ময়’।
বেলো
১৯৭৬ সালে ১৩৯ কি.মি. ব্যাসের এই গহ্বরের নাম দেয়া হয় ভেনিজুয়েলার বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, শিক্ষক অ্যান্ড্রেস বেলোর নামানুসারে। তার জন্ম ১৭৮১ সালে এবং মৃত্যু ১৮৬৫ সালে।
বারকেল
২১ কি.মি. ব্যাসের একটি গহ্বরের নাম দেয়া হয় তুর্কির আধুনিক চিত্রশিল্পী সাব্রি ফেতাহ বারকেলের নামানুসারে। ২০০৯ সালে এ নামকরণ করা হয়। বারকেলের জন্ম ১৯০৭ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯৩ সালে।
ওয়েগনার
বুধের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি ১৩৪ কি.মি. ব্যাসের একটি গহ্বর পাওয়া যায়। ১৯৭৬ সালে এর নামকরণ করা হয় জার্মান গীতিকার রিচার্ড ওয়েগনারের নামানুসারে। নাট্যনির্মাতা এবং নাট্যপরিচালক ছিলেন ওয়েগনার। তার জন্ম ১৮১৩ সালে এবং মৃত্যু ১৮৮৩ সালে।
আলভের
১৫১.৪৯ কি.মি. ব্যাসের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয় ২০১৩ সালে এস্তোনিয়ান লেখিকা বেটি আলভেরের নামানুসারে। তার প্রথম গ্রন্থ ‘Mistress n the Wind’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তিনি অনেক ছোট গল্প এবং কবিতাও লিখেছেন। আলভেরের জন্ম ১৯০৬ সালে এবং মৃত্যু ১৯৮৯ সালে।
ডোনেলাটিস
২০১৩ সালে আবিষ্কৃত ৮৫ কি.মি. ব্যাসের এক জ্বালামুখের নাম দেয়া হয় লুথারিয়ান ধর্মযাজক এবং কবি ক্রিস্টিজোনাস ডোনেলাইটিসের নামানুসারে। তার জন্ম ১৭১৪ সালে এবং মৃত্যু ১৭৮০ সালে। তার রচিত কবিতা ‘ The Seasons’ কে প্রথম ক্লাসিক্যাল লুথারিয়ান কবিতা বলা হয়ে থাকে।
ফ্লাইয়ানো
এন্নিয়ো ফ্লাইয়ানো নামক ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক এবং সমালোচকের নামানুসারে ২০১৩ সালে ৪৪৩ কি.মি. ব্যাসের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয়।
হার্লে
অস্ট্রেলিয়ান ফটোগ্রাফার এবং অভিযাত্রী জেমস ফান্সিস হার্লের নামানুসারে ২০১৩ সালে ৬৭ কি.মি. ব্যাসের একটি গহ্বরের নাম দেয়া হয়। হার্লেকে ‘পাগলা ফটোগ্রাফার’ও বলা হতো, কারণ তিনি ছবি তোলার জন্য অনেকবার অনেক বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। তার জন্ম ১৮৮৫ সালে এবং মৃত্যু ১৯৬২ সালে।
লাভক্র্যাফট
২০১৩ সালেই ৫১.৯৭ কি.মি. ব্যাসের একটি গহ্বরের নাম দেয়া হয় আমেরিকান লেখক হাওয়ার্ড ফিলিপ্স লাভক্র্যাফটের নামানুসারে। লাভক্র্যাফট ছিলেন বিংশ শতাব্দির সায়েন্স ফিকশন এবং হরর লেখক।
আন্দাল
১৯৭৬ সালে তামিল লেখক আন্দালের নামানুসারে ১০৮ কি.মি. ব্যাসের একটি জ্বালামুখের নাম দেয়া হয়। তিনি দশম শতকের ভারতের একজন কবি।
কালিদাস
বিখ্যাত ভারতীয় কবি এবং অভিনেতা কালিদাসের নামানুসারে ১৯৭৬ সালে বুধের একটি গহ্বরের নাম দেয়া হয়। সংস্কৃত ভাষায় কবিতা লিখতেন পঞ্চম শতকের বিখ্যাত এই কবি কালিদাস।
ঠাকুর
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে ১৯৭৬ সালে ১১১ কি.মি. ব্যাসের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয়। ১৯১৩ সালে নোবেল বিজয়ী এই কবি এবং লেখকের জন্ম ১৮৬১ সালে এবং মৃত্যু ১৯৪১ সালে।
মনসুর
ভারতীয় চিত্রশিল্পী ওস্তাদ মনসুরের নামানুসারে ১৯৭৯ সালে নাম দেয়া হয় ১০০ কি.মি. ব্যাসের একটি জ্বালামুখের। সপ্তদশ শতকের মুঘল এই চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম এখনো সকলের দৃষ্টি কাড়ে।
সুলিভান
লুইস হেনরি সুলিভান, আমেরিকান স্থপতি, যাকে সকলে আধুনিকত্বের জনক বলে থাকেন। তার নামানুসারে ১৯৭৬ সালে একটি ১৩৫ কি.মি. ব্যাসের জ্বালামুখের নামকরণ করা হয়। তার জন্ম ১৮৫৬ সালে এবং মৃত্যু ১৯২৪ সালে।
৩৯৪টি জ্বালামুখের প্রত্যেকটিকে একটি লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে হয়তো বুধেরই আরো অনেক জ্বালামুখের ছবি পাঠাবে স্যাটেলাইট। থাকবে আরো অনেক গুণীজনের নাম। আশা করা যায় বাংলাদেশের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো আরো জ্ঞানীগুণী মানুষের নাম মাহাকাশের বুকে।