সমুদ্র কাউকে আনন্দ দেয়, কাউকে দেয় মুক্তির প্রশান্তি, আবার কাউকে দেয় জীবিকার যোগান। এছাড়াও সমুদ্র এক সময় যাতায়াতের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম ছিল, তা তো আমরা সবাই-ই জানি। কিন্তু সমুদ্র যে কোটি কোটি জীবন ধারণ করে, তা কি আমরা কখনও ভাবি? সমুদ্রের তলদেশে যারা বাস করে, তারাও জীব। এদেরও পরিবার আছে, পরিজন আছে। এরাও একা থাকতে পারে না। শুধুমাত্র এরা কথা বলতে পারে না বলে কি এদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই?
মানুষের বোকামির জন্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এদের সংসার, এদের পরিবার। প্রতিনিয়ত আমরা বিপদ ডেকে আনছি তাদের জীবনে। কমিয়ে দিচ্ছি তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। আমরা যে তাদের ক্ষতি করছি, শুধু তা-ই নয়; সমুদ্র কলুষিত করে আমরা ক্ষতি ডেকে আনছি আমাদের জীবনেও। আসুন তাহলে জেনে নেই, কীভাবে কলুষিত হচ্ছে সমুদ্র।
জলবায়ুর পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তন বলতে মূলত কয়েক বছরের আবহাওয়ার পরিবর্তনকে বোঝায়। হতে পারে সেটা আর্দ্রতা বৃদ্ধি বা হ্রাস। জলবায়ুর পরিবর্তন পরিবেশের কারণেই ঘটে থাকে। যেমন- ইদানীংকালে বিশ্ব উষ্ণায়ন দেখা দিচ্ছে। বেশ কয়েক বছর থেকে একাধারে গাছ কাটার ফলে বাড়ছে গরম। কিন্তু এখন যদি কোন উষ্ণ এলাকায় শ’খানেক গাছ লাগানো হয়, তাহলে সেই এলাকার উষ্ণতা কমে যাবে এবং সেখানে ঘন ঘন বৃষ্টি হতে দেখা যাবে। ফলে সে এলাকার জলবায়ু পরিবর্তন ঘটবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, জলবায়ুর পরিবর্তন মূলত আমরা, মানুষরাই ঘটাতে পারি বা ঘটাচ্ছে। যেমন গাছ কেটে বায়ুর আর্দ্রতা কমিয়ে ফেলেছি আমরা; তেমনই গাছ লাগিয়ে বায়ুর আর্দ্রতা বাড়াতেও পারবো আমরা। আর প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণীরা হচ্ছে আমাদের কৃতকর্মের ভুক্তভোগি।
বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে বোঝায় পুরো পৃথিবীর উষ্ণতার গড় বেড়ে যাওয়া। পৃথিবীর সকল অংশের তাপমাত্রা এক নয়। কোনো জায়গায় তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি, আবার কোনো জায়গায় তুলনামূলক কম। পৃথিবীর যে অংশের তাপমাত্রা বেশি, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সেই অঞ্চলের জীবাশ্মগুলো কখনও কখনও একাই জ্বলে ওঠে; যার ফলস্বরূপ, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং হিমালয় বরফও গলতে শুরু করেছে দ্বিগুণ হারে এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়েই চলছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের আরেকটা কারণ হচ্ছে, পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি। এই গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের সকল জীব ভোগান্তির শিকার হলেও বেশি ভোগান্তির পোহাতে হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রাণীগুলোকে। যারা ঠাণ্ডা জলের প্রাণী, তারা হচ্ছে ঘরহারা; কোনো কোনো প্রজাতি তো ধীরে ধীরে বিলুপ্তই হয়ে যাচ্ছে।
কলকারখানা, মোটর গাড়ি ও জাহাজ থেকে নিঃসৃত গ্যাস ও ময়লা-আবর্জনা পরিবেশে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি করার সাথে সাথে পরিবেশ দূষিত করে। কলকারখানা ও জাহাজের এই সকল ময়লা আবর্জনা ও তেল সর্বদা আমরা সমুদ্রে না ফেললেও নদীতে ফেলি। সেই পানি এসে মিলিত হয় সাগরে; সুতরাং, আমরা তেল, লোহা, বর্জ্য সমুদ্রেই ফেলছি।
জলপৃষ্ঠে যেসকল উদ্ভিদ জন্ম নেয়, সকলের মতো তাদেরও কিছু নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। প্রতিনিয়ত পানিতে বর্জ্য ও তেল ফেলার কারণে জলপৃষ্ঠে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, তার সবটুকু জলজ উদ্ভিদের গ্রহণ করা সম্ভব হয় না ফলে জলপৃষ্ঠে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়; সেই সাথে অম্ল-ক্ষারের তারতম্যও তৈরি হয়।
পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে পানির অম্লত্ব বেড়ে যায়। অম্ল পানিতে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সমুদ্রের পানির স্বাভাবিক অম্লত্ব ৬.১৬, কিন্তু শিল্পায়নের পরে সমুদ্রের অম্লত্ব বেড়ে হয়েছে ৬.০৫; ফলে সমুদ্রের লবণাক্ততা কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত অম্ল সমুদ্রে খোলসযুক্ত প্রাণীর (যেমন- ঝিনুক, শামুক, প্রবাল ইত্যাদি) খোলস তৈরি হতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগছে এবং খোলসগুলো হয় ভঙ্গুর। ফলে তারা বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারছে না।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চলেছে, তাতে বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, সমুদ্র একসময় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের একটি বিশাল উৎস হয়ে উঠতে পারে; এমনটা হলে সমুদ্র তার ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। সে আর কোনোকিছুই নিজের মধ্যে নিমজ্জিত করে নিতে পারবে না, সমুদ্রে ডুববে না কিছু।
জাহাজ চলাচলের ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। কখনও আবার তারা জাহাজের গায়ে ধাক্কা খায়; এতে তাদের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ ক্ষতি হয়। কোনো প্রাণী এই আঘাত সামলাতে না পেরে মারা যায় তৎক্ষণাৎ। তিমিরা এই আঘাত একদম সহ্য করতে পারে না। একারণেই কানাডার সমুদ্রপথে জাহাজের গতির একটা নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যেন জাহাজ তিমিকে সজোরে আঘাত করতে না পারে। যদি কোনো নাবিক এই নির্দিষ্ট সীমার বাইরে জাহাজ চালায়, তাহলে তাকে ২৫,০০০ ইউএস ডলার ফাইন করা হয়। রাইট তিমিদের বাঁচানোর জন্য আরো একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমেরিকা ও কানাডার জাহাজ চলাচলের পথ পরিবর্তন করা হয়েছে। সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের ফলে আরও একটি সমস্যা হয়ে থাকে, আর তা হয় জাহাজের বিকট শব্দের কারণে। সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রাণীরা বিভিন্ন ধরনের শব্দ তৈরি করে থাকে তাদের সঙ্গীকে প্রণয়ে আকৃষ্ট করার জন্য। জাহাজের তীব্র ও বিকট শব্দে তাদের যোগাযোগ ও প্রণয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অতিরিক্ত মাছ ধরা
সামুদ্রিক মাছ খেতে পছন্দ করে না, এমন মানুষ পাওয়া দায়। এমন মানুষ আছে অবশ্যই, তবে সংখ্যায় খুবই কম। যতদিন যাচ্ছে, সামুদ্রিক মাছের প্রতি আমাদের আগ্রহ তত বাড়ছে। ক’দিন আগেও বাংলাদেশে ‘সি-ফুড’ বিষয়টি এখনকার মতো জনপ্রিয় হয়নি। আবার দিন দিন মানুষের শৌখিনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক বাসায় অ্যাক্যুরিয়াম শৌখিনতার একটা বড় নিদর্শন। ফলে মাছ, অ্যাক্যুরিয়াম ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মাছ ধরার প্রবণতা বেড়ে গেছে। যার কারণে কমে আসছে সমুদ্রে মাছের সংখ্যা; কোনো কোনো প্রজাতি তো বিলুপ্তই হয়ে যাচ্ছে।
পাশাপাশি, মাছ ধরার জন্য বিভিন্ন ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। এবং সমুদ্রে এসকল ইঞ্জিন চালিত নৌযানের চলাচলও বাড়ছে; সাথে বাড়ছে সমুদ্রে পানিতে দূষিত তেল ও বর্জ্যের পরিমাণ।
সিন্ধুঘোটক আবার ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, ফলে সিন্ধুঘোটকের চাষ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। এটি সমুদ্রের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এছাড়া, চোরাচালান বা অনৈতিক ব্যবসা তো আছেই। সামুদ্রিক প্রাণীর অনৈতিক ব্যবসার শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কচ্ছপ। কচ্ছপ পোষার জন্য বা এর ডিম চাষ করার জন্য বেআইনিভাবে ধরা হচ্ছে এই ধীরগতির প্রাণীটি। অবশ্য রক্ষা পাচ্ছে না দ্রুত এবং হিংস্র প্রাণীরাও। চোরা উপায়ে কাঁকড়া ও শার্ক ধরার প্রবণতাও এখন বেশ বেড়ে গেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বে বিক্রিত কাঁকড়ার ৪০ শতাংশই ছিলো রাশিয়ায় বাজার থেকে রপ্তানিকৃত বেআইনিভাবে ধরা কাঁকড়া।
চোরাচাষের চেয়েও একটা বড় দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটাচ্ছি আমরা, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজীবন তথা সামুদ্রিক জীবন। জাল ফেলে মাছ ধরা হচ্ছে এবং সেই জালে আটকা পড়ছে কিন্তু অবাঞ্ছিত প্রাণী; যারা জাল থেকে বের হতে না পেরে মারা পড়ছে জালের ভেতরেই। যেমন- কড মাছ ধরা পড়ে কাঁকড়ার জালে, উৎসুক সীল মাছ ও সমুদ্র সিংহ গিলে ফেলে অন্য মাছের জন্য বিছানো টোপটা, উত্তর আটলান্টিক সাগরের শুশুক ও তিমি ধরা পড়ে গিল নেটে আর প্যাসিফিক সাগরের ডলফিন ধরা পড়ে সেইন নেটে, যা কিনা টুনা মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করা হয়।
সামুদ্রিক মাছ ধরার জন্য জাল ফেলার আগে তাই আমাদের মনে রাখা উচিত, এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। এভাবে জাল বিছিয়ে এদের ধরা উচিত নয়।
শিল্পায়ন
শিল্পায়নের ফলে বিশাল সংখ্যায় কলকারখানা তো তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার; তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন নৌযান, নতুন আঙ্গিকে গড়ে উঠছে হোটেল-রেস্তোরাঁ সমুদ্রোপকূলে।
সমুদ্রবিলাসে গেলে দেখা যায়, সৈকতের গা ঘেঁষে অত্যাধুনিক ডিজাইনে গড়ে উঠছে আবাসিক হোটেল, সৈকতের সবটা জায়গা জুড়েই দর্শনার্থীদের বিচরণ, দোকান-পাট, কোনো এক পাশে আবার এত বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার রাখা আছে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে। আবার কেউ কেউ ময়লা-আবর্জনা ও খাবারের প্যাকেটও ফেলছেন সমুদ্রে, হোটেলগুলোর পয়ঃনিষ্কাশন লাইন যুক্ত করা রয়েছে সমুদ্রে সাথে। ফলে, জলজ প্রাণীগুলো মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারছে না। তাদের স্বাভাবিক ও সুস্থভাবে বেড়ে উঠার নিয়মে ব্যাঘাত ঘটছে, তাদের আয়ু কমে যাচ্ছে। এভাবে কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির দিকে চলে যাচ্ছে।
কচ্ছপ পানিতে বসবাস করলেও জন্ম নেয় সৈকতে এবং জন্মের ৩০ বছর পর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সেই সৈকতে ফিরে আসে। এসে যখন দেখে পরিবেশে এত পরিবর্তন, শিল্পায়নের ফলে তার অনুকূল পরিবেশটা হারিয়ে গেছে, তখন তার খাপ খাওয়াতে অসুবিধা হয়, প্রাণীটির বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক জীবগুলো এবং ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে সমুদ্রজগত।