কার্স্টেন ব্রুন প্রথমবারের মতো ভেনেজুয়েলান আন্দিসে আরোহণ করেছিলেন ২০০৯ সালে। তিনি এবং তার স্ত্রী দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া-পিকো হাম্বোল্টে একটি ছোট তুষারনদী বা হিমবাহ পরিমাপ করার জন্য সেখানে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বরফে আবৃত পথ ধরে তাদের এই যাত্রার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এটা ছিল একটা শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান।
ম্যাসাচুসেটসের ওয়েস্টফিল্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর কার্স্টেন ব্রুন এরপরও কয়েকবার হাম্বোল্টের এই হিমবাহ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সর্বশেষ তিনি সেখানে গিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় ৮ বছর আগে। তার মতে, এই ছোট্ট হিমবাহের আয়তন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে।
“কল্পনা করুন তো, একটা ঢাল বেয়ে, একটি ছোট্ট প্যানকেক ঝুলে পড়েছে”- হ্যাঁ, ঠিক এমনটাই এখন এই হিমবাহের অবস্থা বলে জানাচ্ছিলেন কার্স্টেন ব্রুন। এই হিমবাহের উপরের বরফের স্তর দিনকে দিন আরো পাতলা হয়ে যাচ্ছে। কম-বেশি ৬৫ ফুট পুরু। আর এই পুরো হিমবাহটি ঘুরে আসতে হলে হাঁটতে হবে প্রায় এক মাইল এলাকা।
ভেনেজুয়েলার প্রধান পাঁচটি ক্রান্তীয় হিমবাহের মধ্যে অন্যতম এই হাম্বোল্ট হিমবাহ, দেশটির পশ্চিমাংশে সিয়েরা নেভাদা দি মেরিদায় অবস্থিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই ক্রান্তীয় হিমবাহটি তানজানিয়া, চীনের হিমবাহগুলোর সাথে একটি মন খারাপ করা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। কোন দেশের হিমবাহ সবার আগে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেটিই এখন দেখার বিষয়। এই প্রতিযোগিতার ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে গিয়ে ব্রুন বলেছেন,
আমরা যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে, হাম্বোল্ট হিমবাহ এই দৌড়ের একেবারে শেষ দিকেই আছে। যেকোনো সময়ে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে হারিয়ে যেতে পারে ভেনেজুয়েলান হাম্বোল্ট হিমবাহ।
কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক অভ্যুত্থান এবং তহবিল সংক্রান্ত সমস্যার কারণে, হারিয়ে যেতে থাকা এই হিমবাহের কথা সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, আগামী একটি বা দুটি দশকের মধ্যেই এটি পুরোপুরি গলে যাবে। অথচ ভেনেজুয়েলার শেষ এই হিমবাহ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যাপ্ত গবেষণাই করতে পারেনি। ব্রুন যখন ২০১৫-তে শেষ বার হাম্বোল্ট হিমবাহ অভিযানে গিয়েছিলেন, তখন একদল আর্মি তাকে বাস থেকে নামিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার ফলে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সাথে নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করতে অনেকেই উৎসাহ পাচ্ছে না।
নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির গবেষক এবং বিজ্ঞানী অ্যালেক্স গার্ডনার মনে করেন, গ্রিনল্যান্ড এবং এন্টার্কটিকার বিপরীতে, পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এমন নন-আইসি হিমবাহগুলো পৃথিবীর মোট হিমবাহের মাত্র এক শতাংশ। ফলে এসব হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা তেমন একটা বাড়বে না। কিন্তু এর ফলে এসব স্থানের তাপমাত্রা প্রায়ই হিমাংকের উপরে উঠে যেতে পারে, যা এই অঞ্চলের জীব বৈচিত্রের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। .
পৃথিবীর প্রায় ৯৫ ভাগ উষ্ণমণ্ডলীয় হিমবাহের উৎস হচ্ছে এই আন্দিস। পেরু, কলম্বিয়ার মতো কিছু কিছু দেশের বিশুদ্ধ পানি, কৃষিকাজের জন্য সেচের পানি এবং হাইড্রোপাওয়ারের মূল উৎস হচ্ছে এসব হিমবাহ। হিমবাহগুলো যদি এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে, তবে এসব দেশের মানুষের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। ১৯৭০ এর পর থেকে এসব অঞ্চলের হিমবাহগুলোকে সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভেনেজুয়েলার হিমবাহগুলোর উপর মাঠ পর্যায়ের একমাত্র গবেষণার কাজটি করেছিলেন দেশটির প্রয়াত ভূতাত্ত্বিক কার্লোস শ্যুবার্ট। ১৯৭১ এবং ১৯৯২ সালে তাঁর দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হবার মাঝের সময়ে ভেনেজুয়েলার চারটি হিমবাহ হারিয়ে গেছে।
শ্যুবার্টের ছাত্র ম্যাক্সিমিলানো বেজদা এবং কার্স্টেন ব্রুন যৌথভাবে হাম্বোল্ট হিমবাহের সাম্প্রতিক পরিমাপ সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছিলেন ২০১৩ সালে। ২০১১ সালের হিসাবের ভিত্তিতে, এই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, হাম্বোল্ট হিমবাহের পৃষ্ঠতল মাত্র ০.০৪ বর্গ মাইল, যা ২০০৯ সালে কার্স্টেন ব্রুনের প্রথম হাম্বোল্ট অভিযানের চাইতে .০২ বর্গ মাইল কম। এই সময়ের মধ্যে এই হিমবাহের গায়ে অসংখ্য ফাটল চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এর পাদদেশ দিয়ে গলিত পানির প্রবাহ দেখা গিয়েছে।
ভেনেজুয়েলার অল্প যে কয়জন বিজ্ঞানী হাম্বোল্ট হিমবাহের উপর গবেষণা চালিয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন পেদাগসিয়া ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন প্রফেসর ম্যাক্সিমিলিয়ানো বেজদা। তিনি বলেন,
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেও এই হিমবাহের বরফগুলো বেশ শক্তপোক্ত ছিল। এখন এগুলোকে দেখতে অনেকটাই ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হয়। এবং খুব শীঘ্রই এই হিমবাহটি হারিয়ে যাবে।
গার্ডনারের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধিই হিমবাহগুলো গলে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ। তার অভিক্ষেপণ অনুসারে, এই হিমবাহগুলোতে আবারও পানি জমে জমাট বাঁধতে শুরু করবে। কিন্তু কবে এবং কত দ্রুত এই প্রক্রিয়া শুরু হবে সেটিই এখন দেখার বিষয়। তবে হাম্বোল্টের মতো নিম্নাঞ্চলীয় হিমবাহগুলো সবচাইতে ছোট এবং সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং যেকোনো সময়েই এগুলো হারিয়ে যেতে পারে।
হাম্বোল্ট হিমবাহের নামকরণ
অবিরাম তুষারপাত এবং বরফে পুরো আন্দিস ঢাকা পড়ে যাওয়ার ঘটনা সর্বপ্রথম রেকর্ড করা হয়েছিল ১৫৬০ সালে। ১৯৪১ সালে আন্দিসে একটি অভিযানের সময়, পেট্রোলিয়াম ভূতাত্ত্বিক এবং পর্বতারোহী এ.ই গুন্থার, হাম্বোল্ট হিমবাহকে এই অক্ষাংশের সবচাইতে বড় হিমবাহ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাজা তুষারপাতের পর এই হিমবাহটিকে একটা চমৎকার স্কিইং স্লোপ মনে হয়ছিল তাঁর কাছে।
উনিশ শতকের প্রকৃতিবিদ আলেকজেন্ডার ভন হাম্বোল্টের নামানুসারে আন্দিসের যে পাহাড়ের কোলে এই হিমবাহটি অবস্থিত, তার নামকরণ নামকরণ করা হয়েছিল হাম্বোল্ট পর্বত। আর হাম্বোল্ট পর্বতের কোলে অবস্থিত বলে এই হিমবাহটি হাম্বোল্ট হিমবাহ নামে পরিচিত। আলেকজেন্ডার হাম্বোল্ট ১৭৯৯ সালে যখন সারিসারি সবুজ পাম গাছের বন এবং কলা বাগানের পাশ দিয়ে সমুদ্রযোগে ভেনেজুয়েলার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন তিনি সারি সারি মেঘের আবরণে আবৃত একগুচ্ছ পর্বতমালা দেখতে পান।
স্প্যানিশ উপনিবেশের কারণে তখন তিনি মারাত্মকভাবে ভেনেজুয়েলার বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়া লক্ষ্য করেছিলেন। ফলাফলস্বরূপ, তিনি প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে মানব সম্প্রদায়ের কার্যকলাপের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক বিশ্ববাসীর সামনে উত্থাপন করেছিলেন।
এই প্রকৃতিবিদ দেখিয়েছিলেন, কীভাবে বনভূমি এবং বাস্তুসংস্থানের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মাটি ক্ষয়রোধ এবং ভূগর্ভের পানি সংরক্ষিত হয়ে থাকে। তিনি আরো দেখিয়েছিলেন, বন উজাড় এবং বাস্তুসংস্থানের ব্যত্যয় ঘটলে তা জলবায়ুর উপর কীভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
২০১৫ সালে আন্দেরা উলফ তাঁর লেখা হাম্বোল্টের জীবনী দ্য ইনোভেশন অফ নেচার বইতে উল্লেখ করেছেন, “মানুষের হস্তক্ষেপে ইতোমধ্যে বেশ অনেকখানি প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে, হাম্বোল্ট বলতে চেয়েছিলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে পৃথিবী খুব দ্রুতই অস্থির হয়ে উঠবে এবং যার ফলাফল হবে খুবই মর্মান্তিক।“
অবহেলিত হাম্বোল্ট
এখন শুধুমাত্র পর্বতারোহীরা এইসব হিমবাহগুলো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীরা আলোচনার মধ্যেই হিমাবহকে সীমাবদ্ধ রাখেন। ভেনেজুয়েলাতে রিসার্চ ট্রিপ পরিচালনার জন্য, দেশটি কিছুটা বিপজ্জনক ভেবে সেখানে আর যেতে আগ্রহ পান না অনেক বিজ্ঞানী।
এমনটাই যখন বাস্তবতা, হাম্বোল্ট হিমবাহের প্রতি বিজ্ঞানীদের অনাগ্রহের পেছনে আরো কিছু কারণ যুক্ত আছে। এই হিমবাহটি পৃথিবীর এমন কোনো আকর্ষণীয় হিমবাহও নয় যে এর প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকবে। পাতাগোনিয়ার বিশাল বরফাচ্ছাদিত এলাকার তুলনায় এই হিমবাহটি তেমন একটা অভিযাত্রীসুলভও না। এর ফলে এই ছোট্ট একটা হিমবাহের উপরে গবেষণা চালানোর জন্য কেউ তহবিল গঠনেও আগ্রহ প্রকাশ করে না।
শ্যুবার্টের অভিযানের সময় তিনি নিজ উদ্যোগে যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, সেটি বলতে গেলে একপ্রকার পর্যবেক্ষণ প্রকল্প এবং ভেনেজুয়েলার হিমবাহগুলোকে নথিভুক্ত করার একটি প্রয়াস বলা চলে, যা এখন বেজদা এবং ব্রুন করে চলেছেন। কিন্তু এরকম কোনো প্রকল্পও ভেনেজুয়েলার সরকার বা আন্তর্জাতিকভাবে কেউ গ্রহণ করেনি।
যদিও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে হিমবাহের কিছু অংশ পর্যবেক্ষণ করা যায়, কিন্তু এই হিমবাহগুলো এখন এতটাই ছোট হয়ে গেছে যে, অনুচ্চ ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এগুলোর পর্যবেক্ষণের এবং সমীক্ষার জন্য যথেষ্ট পরিমান তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
হাম্বোল্টের প্রতীক-প্রতীকী হাম্বোল্ট
বেজদা এবং ব্রুন এই হাম্বোল্ট হিমবাহকে ‘একটি ব্যতিক্রমী হিমবাহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, এই হিমবাহটি যদি পাহাড়ের ছায়াঘেরা অংশে অবস্থিত না হয়ে আলোকিত অংশে অবস্থিত হতো, তাহলে এতদিনে এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। আর যেহেতু ইতোমধ্যে এই হিমবাহটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, তাই আগামীতে এর বিলুপ্তির কারণে স্থানীয় পানির উৎসে তেমন বড় কোনো খারাপ প্রভাব পড়বে না।
এখন হামোল্ট হিমবাহ যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে বলাই যায়, এটি এখন কেবলমাত্র হাম্বোল্টের প্রতীকী হিমবাহ হিসেবে বেঁচে আছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই এই ছোট্ট সুন্দর হিমবাহটি হারিয়ে যেতে বসেছে বলে মনে করেন গার্ডনার।
মেদিরাকে বলা হয় বৌল্ডার, ভেনেজুয়েলার কলোরাডো। অতএব এর আশেপাশে যারা বসবাস করে থাকেন, এই হিমবাহটি তাদেরই পরিচায়ক।
হিমবাহটি একবার হারিয়ে যাওয়া মানে, এখানকার মানুষের পরিচয়ের একটি অংশ তাদের জীবন থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া।