Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মোনাকো: আয়কর মুক্ত যে দেশটিতে ধনীদের আনাগোনা

ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে ভূমধ্যসাগর। এই ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থান করছে পৃথিবীর দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ মোনাকো। ক্ষুদ্রতম দেশের দৌড়ে প্রথম স্থানটি অবশ্য দখল করে আছে ভ্যাটিকান সিটি। দেশ ছোট হলেও মোনাকোর গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনত্ব বহুল দেশ এটি।

মানচিত্রে মোনাকো; Source: Turkey Travel Guide

আয়তনের দিক থেকে দেশটি মাত্র ২ বর্গ কিলোমিটারের কাছাকাছি হবে। মোনাকোর তিন পাশেই আছে ফ্রান্স, অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর। ফ্রান্সের নিকটবর্তী দেশ হওয়াতে ফ্রান্সের বেশ আধিপত্য রয়েছে দেশটির উপর। দেশটির সরকারি ভাষাও ফরাসি। তবে স্থানীয়দের মাঝে মনোগেস্ক, ইতালিয়ান এবং ইংরেজিও খুব ব্যবহৃত হয়।

মোনাকোর শাসনব্যবস্থা মূলত রাজতন্ত্র নির্ভর। আন্তর্জাতিক অনেক কর্মকাণ্ডের জন্য দেশটির ফ্রান্সের কাছে দ্বারস্থ হতে হয়। রাজতন্ত্রের এই দেশে রাজকুমার আলবার্টই সর্বেসর্বা। রাজকুমারের নিরাপত্তার জন্যে নিজস্ব ছোট একটি সৈন্যবাহিনী আছে। কিন্তু অন্যান্য সকল আইনানুগ কর্মকাণ্ডের ভার ফ্রান্সের হাতেই ন্যস্ত থাকে।

রাজকুমার দ্বিতীয় আলবার্ট; Source: fpa2.org

দেশটির সবচাইতে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, ধন সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও নিরাপত্তার দিক দিয়ে এটি বেশ শক্তিশালী। এই দেশে কোনোরকম অপরাধের কথা শোনা যায় না বললেই চলে। মোনাকো এতটা নিরাপদ হওয়ার মূল কারণটি হলো, দেশটির চারপাশ ঘিরে রয়েছে হাজার হাজার ক্যামেরা। মোনাকোর পুরো আনাচ-কানাচ ক্যামেরার আয়ত্তে রয়েছে। ক্যামেরাগুলোর সাহায্যে সবসময় কড়া পাহাড়ায় ন্যস্ত আছে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। তাই কেউ কোনো অপরাধ করলে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে আইনের আওতায় আসতে হতে হবে এখানে।

ক্যামেরা হতে মোনাকোর ছবি; Source: youtube.com

মোনাকোর সুরক্ষায় সরকার নির্ধারিত একটি ডেটাবেজ রাখা হয়। দেশে কোনো নতুন গাড়ি বা লোক এলে সাথে সাথে তার স্ক্যান করা ছবি ডেটাবেজের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়। ডেটাবেজে মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ জগতের অনেকের প্রোফাইল থাকে, যার সাথে এই সকল ছবি মিলিয়ে দেখা হয়। সেখানে সংরক্ষিত তালিকার সাথে যদি কোনো ছবি মিলে যায়, তবে সাথে সাথে তাকে আটক করা হয়।

সরকারিভাবে দেশটির কোনো রাজধানী নেই। তবে মন্টি কার্লোকে এ দেশের কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়, কারণ এখানে রয়েছে বিখ্যাত মন্টি কার্লো ক্যাসিনো। এই ক্যাসিনোকে ঘিরে পৃথিবীর ধনী মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই, কেননা এই ক্যাসিনোকে পৃথিবীর সবচাইতে নিরাপদ ক্যাসিনো হিসেবে ধরা হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, মোনাকোর স্থানীয় বাসিন্দাদের এই ক্যাসিনোতে ঢোকার অনুমতি নেই।

মন্টি কার্লো কেসিনোর বাইরের অংশ; Source: thousandwonders.net

এই ক্যাসিনোর বাইরে নিতান্ত অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখা যায় দামী দামী সব গাড়ি। থাকবেই না বা কেন? এই দেশে চুরির নামই যে শোনার সুযোগ নেই কোনো। পৃথিবীর সবচাইতে দামী জায়গাও ধরা হয় মোনাকোকে। পৃথিবীর অনেক ধনী মানুষ মোনাকোর বাসিন্দা। এই বাসিন্দাদের অধিকাংশই কোনো প্রতিভাশালী ব্যবসায়ী, নয়তো কোনো যশস্বী ব্যক্তি। এই সকল ধনী ব্যক্তি এখানে ছুটি কাটানোর জন্য আসে। এদের মধ্যে অনেকের নিজস্ব বাড়িও আছে মোনাকোয়।

মোনাকোর বাড়িঘর; Source: peterktravels.com

তবে মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, কেন মোনাকো ধনীদের কাছে এত পছন্দের জায়গা? এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এখানে বিশাল বিশাল অট্টালিকাগুলোর প্রায় সবগুলোই সাগরমুখী। ঘর থেকেই জানালার বাইরে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি চোখে পড়ে। পাশাপাশি এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সকলের নজর কাড়ে। আর এখানকার ক্যাসিনোতে খুব সতর্কতার সাথে বিদেশীদের দেখাশোনা করা হয়। ক্যাসিনোর সাথে আরও আছে হোটেল, মার্কেট, নাইট ক্লাব, স্পোর্টস ক্লাব ইত্যাদি। তবে এই দেশের মূল আকর্ষণ হলো এই দেশটির কর ব্যবস্থা। মোনাকো সম্পূর্ণ কর মুক্ত একটি দেশ। এই জন্যেই পৃথিবীর ধনীরা সব হন্যে হয়ে পড়ে এই দেশকে নিয়ে।

রাতের বেলা মোনাকো; Source: telegraph.co.uk

মোনাকোর আরেকটি আকর্ষণীয় বস্তু হলো ইয়ট। ভূমধ্যসাগরের বুকে দেখা যায় সারি সারি ইয়টের মেলা। ইয়ট দেখতে ছোট জাহাজের মতো, যেখানে আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এটি মূলত ধনী ব্যক্তিদের নিজস্ব প্রমোদতরী। মোনাকোর সমুদ্রের ইয়টগুলোর ভিন্নতা চোখে পড়ার মতো। এই ইয়টগুলোর মূল্যও  প্রচুর।

মোনাকোর সমুদ্রজুড়ে ইয়টের মেলা; Source: theculturetrip.com

পর্যটন শিল্পকে দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি বলে ধরা হয়। সাগরের উপকূলে হওয়াতে দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অত্যন্ত মনোরম। সাগরের পাড়ে পাহাড়ের শরীর বেয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা। এই সকল অট্টালিকায় অনেক মিলিয়নিয়ার ও বিলিয়নিয়ারদের বাস। তাই বলাই বাহুল্য, দেশটির জীবনযাত্রার মান বেশ উন্নত। এই দেশ সম্পর্কে এমনও প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে যে, মোনাকোর জলে-স্থলে ডলারের ছড়াছড়ি। মন্টি কার্লো ক্যাসিনোয় মিলিয়ন ডলার এক রাতেই উড়ে যায়। বিশ্বের অন্যতম সেরা মোটর রেস ভেন্যুও মোনাকো।

মোনাকোর মোটর রেস ভেন্যু; Source: thebillionairemagazine.com

সমুদ্রের পিঠস্থান থেকে একটু উপরের দিকে হেঁটে গেলেই দেখা যাবে মোনাকোর বিখ্যাত ‘এক্সোটিক গার্ডেন‘। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘জার্দিন এক্সোটিক দি মোনাকো’। মূলত ক্যাকটাসের জন্যে বাগানটি খুব বিখ্যাত। কয়েক হাজার রকমের ক্যাকটাস দেখতে পাওয়া যায় এই বাগানে।

এক্সোটিক গার্ডেনের ক্যাকটাস; Source: christianforums.net

এক্সোটিক গার্ডেনের অন্য প্রান্তে দেখা যাবে এক প্রাগৈতিহাসিক গুহা ‘দি অবজার্ভেটরি কেভ’। এই গুহার ভেতরে আদিম মানুষ বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। গুহাটি চুনা পাথরের তৈরি। ধারণা করা হয়, প্রায় আড়াই লক্ষ বছর পুরনো মানুষের বাসস্থান ছিল এটি।

অবজার্ভেটরি গুহা; Source: adamhaydock.blogspot.com

তবে এই গুহায় একা প্রবেশ করা যায় না, একজন দক্ষ গাইড সাথে করে নিয়ে যেতে হয়। প্রায় তিনশ সিঁড়ি ভাঙ্গা পথ দিয়ে নেমে যেতে হয় নিচে। স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধযুক্ত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহার চারপাশ। এখানে-সেখানে এ গুহার ছাদ থেকে নানান আকৃতির পাথর ঝুলে থাকতে দেখা যায়। তবে খুব বেশিক্ষণ গুহার ভেতরে থাকা যায় না, কারণ তাতে দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে। গুহা থেকে বের হয়ে মূল সড়কের উপর দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই দেখা মিলবে ‘মন্টি কার্লো স্কয়ার’। ইউরোপের সবচেয়ে দামী ও প্রাণবন্ত স্কয়ার ধরা হয় এটিকে। এই স্কয়ারের সামনেই রয়েছে মন্টি কার্লো ক্যাসিনোটি।

মন্টি কার্লো স্কয়ার; Source: enjoyourholiday.com

মোনাকোর বাস সার্ভিস খুব ভালো, কিন্তু বাসে চড়া লোকের সংখ্যা খুবই কম। বাসটিতে করে ঘুরে বেড়ানো যায় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। মোনাকোতে একটি ট্রেন স্টেশনও রয়েছে, কিন্তু সেটি ফ্রান্সের অধিগত। দেশটিতে দশটি সাধারণ স্কুল এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

মোনাকো বাস সার্ভিস; Source: monacolegrandtour.com

সমুদ্রের তীরে পাহাড়ের শরীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এই দেশ। মোনাকোর সারা বছরের আবহাওয়াও বেশ আরামদায়ক। ভোরের আলোতে মোনাকোর সুন্দর পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় রানীর সাজানো গোলাপের বাগানে।

রানীর গোলাপ ফুলের বাগান; Photo Credit: Grace Kelly

সব মিলিয়ে মোনাকো আয়তনে যতই ছোট হোক না কেন, পর্যটকদের কাছে এই দেশ দারুণ আকর্ষণীয়। মোনাকো পুরোটা ঘুরে আসতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। ফ্রান্সে যারা ঘুরতে যান বা যাদের ক্যাসিনোতে যাবার শখ আছে, তারা একটিবারের জন্যে এই দেশ ঘুরে আসতে ভুল করবেন না।

ফিচার ইমেজ- wall.alphacoders.com

Related Articles