সমুদ্র থেকে জেগে উঠা আশ্চর্য এক শহর: ভিইয়া এপেনকুয়েন

নানা ভৌগলিক, এমনকি প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে কত জনপদ। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছে কতোই না প্রসিদ্ধ শহর। এক সময়কার প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা সেই শহরগুলোর শেষ ঠিকানা হয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে বিজ্ঞানীদের গবেষণার খাতার পাতায়। কিন্তু ইতিহাসের সব গল্পই তো এক ধাঁচে লেখা হয় না।

ভিইয়া এপেনকুয়েন তেমনি এক শহর। একসময়ের কর্মচঞ্চল ব্যস্ত শহর হঠাৎ হারিয়ে গেলো অতল সমুদ্রের গভীরে। অনেকেই ভেবেছিল শহরটির এভাবেই মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু ইতিহাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ২৫ বছর পর সমুদ্র থেকে জেগে উঠেছে সেই কল্পনার আশ্চর্য শহর ভিইয়া এপেনকুয়েন। এ ঘটনায় শোরগোল পড়ে গেলো সমগ্র ভূতাত্ত্বিক মহলে।

সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যাওয়া ভিইয়া এপেনকুয়েন

গেলো শতাব্দীর শুরুতেই দক্ষিণ আমেরিকার একটি গ্রাম থেকে ভিইয়া এপেনকুয়েন কিভাবে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল আর্জেন্টিনার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সেই ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ।

সমুদ্রের জল ঢুকে তৈরি হয়েছিল এক লেগুন যা নগরটিকে এক অনন্য রূপ দিয়েছিল

ভিইয়া এপেনকুয়েন ছিল আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত ছোট এক শহর। ধারণা করা হয়, ১৯২০ সালের দিকে শহরটির গোড়াপত্তন হয়। ৫৭০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এলাকাটি ছিল পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

মানচিত্রে ভিইয়া এপেনকুয়েন

পৃথিবীর মানুষকে হাতছানি দেওয়ার মতো নৈসর্গিক রূপ ও রসদ দুটোই ছিল তার ভান্ডারে অফুরন্ত। সমুদ্রের জল ঢুকে গিয়ে শহরটিতে তৈরি হয়েছিল এক প্রকান্ড লেগুন। প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি একটি পাথরের প্রাচীর লেগুনটিকে বিচ্ছিন্ন করেছিল সমুদ্র থেকে। লেগুনটির টানেই দেশ বিদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসতো আর্জেন্টিনার সেই অনামী শহরটিতে।

শুনতে অনেকটা রূপকথার মতোই মনে হতে পারে, তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মে যে, এই লেগুনের পানিতে গোসল করলে সব রকম রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অনেকেই মনেই করতেন যে, মানুষের নানা শারীরিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে ত্বকের মারাত্মক অসুখ পর্যন্ত সেরে যেতো এই লেগুনের পানিতে।

সেসময় একদল গবেষকদের পরীক্ষায় পাওয়া যায়, লেগুনের পানি অতিরিক্ত লবণাক্ত ও প্রচুর খনিজ উপাদানে ভরা। আর এই কারণেই বোধ হয় লেগুনের পানি অমন সঞ্জীবনী শক্তি লাভ করেছিল। লেগুনের খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে যেতে লাগলো সারা পৃথিবীব্যাপী। ফলে পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে উঠতে ভিইয়া এপেনকুয়েনের খুব একটা সময় লাগে নি।

লেগুনের পানিতে গোসল করলে সব রকম রোগ সারে, এ বিশ্বাসে দলে দলে লোক ভিড় করতে থাকে ভিইয়া এপেনকুয়েনে

পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে হোটেল, গেস্ট হাইস, জাদুঘর , বাস টার্মিনাল থেকে শুরু করে নানা আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা। প্রায় ২৫০ এর অধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এ সময় গড়ে উঠেছিল শহরটিতে। এক তথ্য হতে জানা যায়, ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ হাজারেরও অধিক পর্যটকের ভীড়ে উপচে পড়তো এই ছোট্ট শহরটি। ফলে তাল মিলিয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছিল পর্যটন বাণিজ্য।পর্যটকদের সুবিধার জন্য ১৯৭২ সালে আর্জেন্টিনা সরকার বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ভিইয়া এপেনকুয়েন পর্যন্ত রেল সেবা চালু করে।

এভাবেই হয়তোবা ভিইয়া এপেনকুয়েন হয়ে উঠতে পারতো দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো তা চাইছিল না। ১৯৮৫ সালের ১৪ নভেম্বর শহরটিতে এক বড় ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। প্রকৃতি হয়ে উঠলো চরম বিক্ষুব্ধ। সব ধরনের হিসেব গোলমাল হয়ে গেলো মুহূর্তের মাঝেই।

কিছুদিন ধরেই টানা প্রবল বৃষ্টির তোড়ে লেগুনের জল উপচে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে পানির উচ্চতা বাড়তে থাকে। ৩৩ ফুট পর্যন্ত পানির উচ্চতা বাড়তে থাকে, যাতে শহরটিকে সমুদ্রে থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা বাঁধ মুহূর্তেই পানির তোড়ে ভেসে গেলো। সেই দিনই পাথরের প্রাচীর ভেঙ্গে সমুদ্র ফুঁসে আসে এপেনকুয়েনের বুকের ভেতর। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই জলের নিচে ডুবে যায় গোটা শহর।

বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া শহর

১৫০০ অধিবাসীদের সেই শহর মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো যা ছিল সকলের কল্পনার বাইরে। দুই সপ্তাহ পর দেখা গেল পুরো শহরটি তিন মিটার পানির নিচে ডুবে আছে। মাটির কোনো অস্ত্বিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। কর্তৃপক্ষের ত্বরিত ব্যবস্থার কারণে শহরের অধিকাংশ লোককেই অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। ফলে বেঁচে যায়  অধিকাংশ অধিবাসীর প্রাণ। কিন্তু অধিবাসীদের প্রায় সকলে সহায় সম্বল হারিয়ে হয়ে পড়ে নিঃস্ব।

যে রাস্তা একসময় পর্যটকদের চলাফেরায় ব্যস্ত থাকতো তা পানিতে ডুবে আছে

সেদিনের এক অধিবাসী নর্মা বার্গের কথায় সেই সময়ের চিত্র পাওয়া যায়। তিনি জানান, ঝড়ের তীব্রতা দেখে তার পোষা কুকুর-বেড়ালগুলো বন্যার ক’দিন আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। যা-ই হোক, ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য মানুষকে তো আর পশু পাখিদের মতন ইন্দ্রিয়জাত ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা দেননি। তাই সেদিন কোনো শহরবাসীই তাদের সহায় সম্বল গুছিয়ে আনতে পারেনি। ঠিক যেন ম্যাজিকের মতোই চোখের নিমিষেই তলিয়ে গিয়েছিল প্রাণবন্ত শহরটি।

ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ভিইয়া এপেনকুয়েন

প্রায় ২৫ বছর পর ২০০৯ সালের ঘটনা। ১৯৮৫ সালের ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার পরের অংশটি যেন দেখতে শুরু করে বিশ্ববাসী। অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো অনেক যুগ পর ঘুম ভেঙ্গে এপেনকুয়েন আবারও মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে আকাশের তলায়। ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করে রূপোলি রঙের বিষণ্ণ তটরেখা।

সমুদ্রের অতল থেকে আবার জেগে ওঠে ভিইয়া এপেনকুয়েনের ভগ্নদশা

পঁচিশ বছর পর ভিইয়া এপেনকুয়েন আবারও পুরোপুরিভাবেই জেগে উঠেছে। বলা হয়, সাগর যা নেয়, তা আবার ফিরিয়ে দেয়। একদা সমুদ্র যাকে গ্রাস করেছিল, সেই শহর আবার জেগে উঠতেই পাওয়া যেতে লাগলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরোনো সভ্যতার সব স্মৃতিচিহ্ন।

সাগরের পানি সরে গিয়ে একটু একটু করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ভিইয়া এপেনকুয়েন

কিছু বাড়িঘর এখনো টিকে থাকলেও তাতে সেই উজ্জ্বলতা আজ আর নেই। মরচে পড়া ইঞ্জিনের টুকরো থেকে ভাঙাচোরা গির্জার মধ্যে নুনের প্রলেপ মাখানো যিশুর মূর্তিতে জল আর সময় যেন ইচ্ছে করেই দাগ রেখে গিয়েছে। তবে এই ধ্বংসের মধ্যেই এক সময়ের ‘চির বসন্তের দেশ’ এপেনকুয়েনের বুক চিরে আশ্চর্য স্পষ্ট থেকে গিয়েছে একটি রাস্তা।

একসময় জমজমাট হোটেল আজ শুধুই ইতিহাস

গল্পের মতোই অবিশ্বাস্য এই শহরের শেষ গল্পটিও বেশ রোমাঞ্চকর। অবশ্য গল্পটি শেষ কি না তা এখনও বলার সময় আসেনি। হয়তো সভ্যতা আবারও এখানে প্রাণ স্পন্দন খুঁজে নিতে পারে। ১৫০০ অধিবাসীর কেউই আর সেই শহরে ফিরে যেতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম আছেন একজন।

এপেনকুয়েনের বুক চিরে জেগে ওঠা পুরনো সেই রাস্তা

পাবলো নোভাক নামের ৮৫ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ, যার ঠিকানা ছিল একসময়কার ঐ ছোট্ট শহরটিতেই, তিনি ফিরে গিয়েছেন তার সেই স্মৃতির শহরে। যেখানে তিনি জন্মেছিলেন, যার আলো-বাতাসে তার শরীর জুড়িয়েছিল, যেখানে থেকে বুনতেন তার স্বপ্নের জাল। আজ এত বছর পরও তিনি সেই শহরটিকে ফিরে পেতে চান।

পুরনো স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা পাবলো নোভাক

তাই পাবলো ফিরে একাকি ফিরে গেছেন তার সেই চেনা জগতে, নির্জন শহরটিতে। পুরোনো ঝলমলে শহরটির স্মৃতি বুকে নিয়ে এখন একাই তিনি সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ান খাঁ খাঁ ধ্বংসস্তূপের আনাচে কানাচে।

পাবলো নোভাক একাই সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া শহরের আনাচে কানাচে

তথ্যসূত্র:

১) en.wikipedia.org/wiki/Villa_Epecuén

২) theatlantic.com/photo/2011/07/the-ruins-of-villa-epecuen/100110/

৩) dailymail.co.uk/news/article-2295111/Epecuen-Eerie-pictures-real-life-Atlantis-underwater-25-years.html

৪) all-that-is-interesting.com/villa-epecuen-ruins

৫) www.amusingplanet.com/2012/12/villa-epecuen-town-that-was-submerged.html

 

Related Articles

Exit mobile version