মিতা আর রাকিব, তারা দুজন জমজ ভাই বোন। ছোটবেলা থেকেই নিজেদের মধ্যে ভীষণ বন্ধুত্ব। একজন যেন আরেকজনের সর্বোত্তম বন্ধু। একটু বড় হতেই দুজনের মধ্যে কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে। দূরত্বটা মূলত তৈরি করে বোন মিতা-ই। রাকিবের কাছে সে অনেক কিছু গোপন করে আর রাকিব সেটা সহ্য করতে পারে না। তাই দুজনের মধ্যে হালকা খুনসুটি থেকেই তৈরি হয় বিশাল আকারের ঝগড়া। রাকিব মাকে জিজ্ঞেস করলে মা ও কিছু বলে না, কেবল বলে, ‘বড় হয়েছ এখন আর বোনের সাথে আগের মতো মিশতে পারবে না। ওকে ওর মতো থাকতে দাও, তুমি তোমার মত থাকো’।
রাকিব কোনভাবেই মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। কিন্তু অন্য সবার মতো তাকেও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিতে হয়। মিতার রুমে যখন তখন ঢুকতে না পারা, আগের মতো একসাথে ঘুমোতে না পারা, ছাদে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে না পারা এগুলো রাকিবের কাছে যত দিন যায় ততই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে। ফলস্বরূপ তৈরি হয় এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। ধীরে ধীরে রাকিবের কাছে সব পরিষ্কার হতে থাকে আর সেই হারে তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে দূরত্ব আর অস্বস্তি। দুজনের কথা হয় খুব কম তবুও বাসায় হাটতে চলতে হঠাৎ চোখে চোখ পড়লে চোখ ফিরিয়ে নেয় তারা। এমন এক অস্বস্তিকর পরিবেশে বড় হতে থাকে যেন কাছে থেকেও একজন আরেকজন থেকে বহু দুরে।
মিতা-রাকিবের এই কাল্পনিক অবস্থা আমাদের সমাজের প্রতিটি ঘরেই লক্ষণীয়। বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এর পরিসর ৯ থেকে ১৯ বছর আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১৯ বছর। তবে এই সময়টুকু সন্তানের জন্য যতটা গুরুত্ব বহন করে তার চেয়েও বেশী দায়িত্ববোধের বার্তা নিয়ে আসে বাবা-মায়ের জন্য। মিতা আর রাকিবের জীবনে যেমনটা ঘটছে তার সম্পূর্ণ অংশের জন্য দায়ী তাদের পরিবার। আমাদের সমাজে অনেকগুলো ট্যাবুর মাঝে বয়ঃসন্ধিকালও একটি ভয়ানক ট্যাবু। সন্তানেরা এই সময়টায় এতটাই অসস্তি আর একাকীত্বে ভোগে যা শিশু বয়সের কোমল মনে ভয়াবহ আঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তাই বাবা-মাকে সন্তানের এই বয়সটিতে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা মাফিক কাজ করা উচিত।
বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন শারিরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা কম বেশী সবাই জানি। কিন্তু ক’জন বাবা-মা এ বিষয়ে সন্তানের সাথে খোলামেলা কথা বলি? আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন পরিবর্তনের ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয় না এবং পাঠ্যপুস্তকেও প্রাধান্য পায় না যৌনশিক্ষার বিষয়টি। যার ফলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অধিকাংশ ছেলের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধও তৈরি হয় না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই যদি তাদের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর ব্যাপারে স্বাভাবিক ধারণা দেওয়া হয় তাহলে হয়ত তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ভুল ধারণা কিংবা বাইরের কেউ তাদের মনে অসুস্থ ধারণার জন্ম দিতে পারে না। আগে থেকেই যৌন সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো জানা থাকলে তারা তাদের সহপাঠী/সহপাঠিনীর সাথে সম্মানজনক সম্পর্ক তৈরি করতে শিখে, কোনো মেয়েকে ঋতুস্রাবের লজ্জায় স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরতে হয় না।
প্রথমেই শিশুকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার আগে ‘মানুষ’ হিসেবে আত্মপরিচয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া উচিত। ছোটবেলা থেকেই লিঙ্গকে গৌণ হিসেবে ধরে অন্যকে ‘মানুষ’ হিসেবে চিনতে না পারলে প্রাপ্তবয়সে এসে লিঙ্গ বৈষম্যে তার দ্বিধাবোধ হবে না। তাই সবার আগে নিজেকে এবং অন্যকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে জানতে হবে।
বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের স্বাভাবিকতা সম্পর্কে সন্তানদের ধারণা দিতে হবে। যৌনতার মত সংবেদনশীল ব্যাপারগুলো প্রাকৃতিক উদাহরণ, যেমন গাছপালা, পশুপাখির প্রজনন পদ্ধতি ইত্যাদির মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। এই সময়ে তারা প্রচণ্ড রকমের মানসিক চাপে ভোগে, মাত্রাতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ এবং আবেগী হয়, সবকিছু নিজের মধ্যে চেপে রাখতে চায়। অত্যন্ত কাছের কাউকে পেলে সে নিজের সকল গোপনীয়তা ভেঙ্গে যেকোনো ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী হয়।
এক্ষেত্রে সুযোগটা নিতে হবে পরিবারকে। পরিবারের সবাই শাসক হতে পারে, তবে যেকোনো একজনকে হতে হবে বন্ধুর মতো, যিনি সকল জড়তা ভেঙ্গে সব কিছু নিয়ে তার সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে সমর্থ্য হবেন যেন বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক, মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তনের ব্যাপারগুলো তিনি দ্বিধা ছাড়াই শিশুকে বোঝাতে পারেন। এক্ষেত্রে যেহেতু সন্তান নিজে তার সমস্যার কথা তুলে ধরবে না তাই পিতামাতাকেই আরো বন্ধুসুলভ হয়ে কৌশলতার সঙ্গে তার সমস্যার কথা জানতে হবে।
পরিবারের যেকোন কাজে লিঙ্গ নির্বিশেষে সন্তানের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করুন। ‘ছেলের জন্যে নির্দিষ্ট কাজ’ আর ‘মেয়ের জন্যে নির্দিষ্ট কাজ’ এই ব্যাপারগুলো তাদের মনে বৈষম্যের প্রাথমিক ধারণা তৈরি করে। মেয়ে সন্তানের জন্য হাড়ি-পাতিল আর ছেলে সন্তানের জন্য পিস্তল-রাইফেল কিনে দিয়ে তাদের বৈষম্য শিখাবেন না। খেলনা নির্বাচনে সন্তানকে স্বাধীনতা দিন, হোক সে পুত্র বা কন্যা।
কীভাবে বুঝবেন সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন?
এ সময়ে সন্তান সবসময় একা থাকতে পছন্দ করে, নিজেদেরকে কল্পনার জগতে ছেঁড়ে দেয়। এ ব্যপারগুলো তার নিত্যদিনের আচার আচরণেই প্রকাশ পাবে। খিটমিটে মেজাজ প্রদর্শন করা, অস্বাভাবিক রেগে যাওয়া, খানিকটা উদাসীন ভাব চলে আসা ইত্যাদি। কিংবা তার উল্টোটাও হতে পারে, যেমন মেয়েদের ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই খুব গোছালো হয়ে উঠা, পরিবারের সবার সাথে নিজ থেকে দূরত্ব তৈরি করা, নিজের ঘরে প্রবেশাধিকারে কড়াকড়ি আরোপ, বন্ধুমহলে আমূল পরিবর্তন ইত্যাদি হলো বয়ঃসন্ধিকালীন আচরণগত পরিবর্তন।
এসব পরিবর্তন চোখে পড়লে সাবধানতার সঙ্গে তাকে ঠাণ্ডা মেজাজে বোঝানোর চেষ্টা করুন। সন্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক না থাকলে সন্তান কখনোই আপনার কথা শুনবে না, তাই প্রথমেই ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি করা জরুরী। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কখনোই আক্রমণাত্মক হয়ে সন্তানকে এসব ব্যাপারে শাসন করা উচিত নয়। এতে হীতে বিপরীত হতে পারে। সন্তানের পরিবর্তন সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করতে হবে এবং সহজভাবে বুঝিয়ে এর সমাধান করতে হবে।
সন্তানের করণীয়
বয়ঃসন্ধিকালে প্রতিটি মানুষই নানারকম তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। কখনো এটি অস্বস্তিকর, কখনো বেদনাদায়ক, আবার কখনো বিব্রতকর। তবে মনে রাখতে হবে, এর সবকিছুই প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক ব্যাপার। নিজের মনকে এ সময় নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন কাজ তবে যতটুকু সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেকোনো সমস্যায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করা জরুরী। সবার সাথে না হলেও সবচেয়ে ঘনিষ্ট যে তার সাথে এই ব্যাপারে গোপনে আলোচনা করা যেতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালীন হরমোনজনিত পরিবর্তন এবং শারীরিক বিষয়গুলো, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিজের শরীর, অ্যানাটমি এসব ব্যাপারে সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য নানারকম জার্নাল বা ব্লগ পড়া যেতে পারে। পর্নোগ্রাফি কখনোই সেক্স এডুকেশনের উপাদান নয়। নিজের সমবয়সীদের সাথে খোলামেলা মতবিনিময় করতে হবে। তবে যেকোনো তথ্য সন্দেহের উদ্রেক ঘটালে তা পুনরায় ইন্টারনেটে বা পরিবারের সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে যাচাই করে নিতে হবে।
নিজের একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা যেতে পারে যেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার থাকবে না। নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। সাহিত্যচর্চা, খেলাধুলা ও যেকোনো ধরনের সামাজিক কার্যক্রমে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে মন-মেজাজ শান্ত থাকে, তবে অবশ্যই সবসময় নিজের নিরাপত্তাকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। বই পড়ার মাধ্যমে অবসর সময় কাটানোর অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালে নিজের সাস্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে। নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া করতে হবে এবং যথাসম্ভব বাইরের খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। নিজের বাসস্থান এবং পোশাক আশাক সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
নিজেকে নিজের সন্তানের কাছে দুর্বোধ্য নয়, বরং সহজ সাবলীল করে গড়ে তুলুন। শাসনের পাশাপাশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখুন, যেন যেকোনো ধরনের গোপনীয়তা আপনার কাছে ধরা পড়ে। সন্তান যত বেশী ভয় পাবে তত বেশী দূরত্ব তৈরি হবে, অন্যদিকে শাসন না থাকলে সন্তান বিপথে পা দিতে ভয় পাবে না। তাই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সন্তানের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালকে কখনোই নিজের বয়ঃসন্ধিকালের সঙ্গে তুলনা করে নৈমিত্তিকভাবে দেখতে যাবেন না। তাহলে নিজের সাথে ঘটা তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোও হয়ত সন্তানের সাথে ঘটবে। বয়ঃসন্ধিকালকে গুরুত্বের সাথে নতুন করে দেখুন এবং যতটুকু সম্ভব সন্তানকে মানসিক প্রশান্তিতে রাখার চেষ্টা করুন।
ফিচার ইমেজ: enkiverywell.com