নিয়মিত নিদ্রাহীনতার ফলে স্থূলতা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরির সাথে সাথে দেহে স্ট্রেস হরমোন হিসেবে পরিচিত কর্টিসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া খাওয়ার পরবর্তী মুহূর্তে ইনসুলিনের নিঃসরণ কম হওয়া এবং পাশাপাশি কর্টিসলের বৃদ্ধি আমাদের রক্তপ্রবাহে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে দুরারোগ্য টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এছাড়াও ঘুমের সময় আমাদের শরীরে নানা ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, যেগুলো ক্ষুধা, বিপাক এবং গ্লুকোজ প্রক্রিয়াজাতকরণে সাহায্য করে। চিকিৎসাবিদদের মতে, ঘুমের প্রতি অবহেলার মানে হচ্ছে, দেহের উপরোক্ত প্রয়োজনীয় হরমোনগুলোকে বিকল করে দেওয়া।
নিয়মিত করা ব্যায়াম, খাবারের প্রতি যত্নশীলতা কোনো কাজেই আসবে না, যদি আপনি ঘুমের ব্যাপারে অবহেলা করেন। ফেয়ারফ্যাক্সের ঘুম বিশেষজ্ঞ ট্যারি ক্যারেল এ ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট করে বলেন,
“আমাদের মাঝে অধিকাংশই স্বাস্থ্য সচেতন হয়েও পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারিনি। কিন্তু ডায়েট এবং ব্যায়ামের সাথে সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম শারীরিক সুস্থতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এমনকি এই তিনটি জিনিস পরস্পরের সাথে এতটাই সম্পর্কযুক্ত যে প্রত্যেকেই সমান অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।”
অপরদিকে, পুরো রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া, অফিসে শেষ করতে না পারা কাজগুলো সম্পূর্ণ করা, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সামলানো সহ প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় নানা কাজের বাহানায় হঠাৎ করে নির্ঘুম রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা অধিকাংশ মানুষেরই রয়েছে। এ ধরনের অনিয়মিত, কিন্তু একটানা দীর্ঘ সময়ের নিদ্রাহীনতাকে কোনো সমস্যা মনে না হলেও, এর ফলে যেকোনো সময় শরীরে প্রচণ্ড রকমের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি আপনাকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
তীব্র নিদ্রাহীনতার ফলে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক
প্রাথমিকভাবে, টানা আঠারো ঘণ্টা নির্ঘুম কাটানোর ফলে মস্তিষ্কে জড়তা তৈরি হয়, যা মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার সময় কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে স্মৃতি গঠনের সামর্থ্য কমিয়ে দেয়। অচিরেই মস্তিষ্ক পুরোপুরিভাবে নতুন স্মৃতি গঠনের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। আঠারো ঘণ্টার পরে, ধীরে ধীরে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাও হ্রাস পেতে শুরু করে। মস্তিষ্ক যৌক্তিক এবং গাণিতিক প্রতিক্রিয়াগুলোর ব্যাপারে অসচেতন হয়ে পরে।
চব্বিশ ঘণ্টার পরবর্তী সময়ে ঘুম মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। সে সময় আপনি ‘Micorsleep’ এর সম্মুখীন হতে পারেন। অর্থাৎ, যদিও আপনি স্বাভাবিকভাবে জাগ্রত মানুষের মতো ব্যবহার করছেন, হাঁটছেন, কথা বলছেন, অন্যান্য স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট সময় পরপর সর্বোচ্চ ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে যেতে পারে। এই ক্ষুদ্র সময়টাতে, আপনি সাময়িকভাবে অচেতন হওয়ার সাথে সাথে বাহ্যিক অনুভূতিগুলোর ব্যাপারে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরবেন। ঘুম বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসাবিদ স্টিভেন হেনরি ফেইনসিলভারের মতে, এই ক্ষুদ্র সময়টাতে আপনার মস্তিষ্ক দৃষ্টিলব্ধ তথ্যগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা হারায়। ফলাফল হিসেবে, গাড়ি দুর্ঘটনা সহ নানা ধরনের ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন হতে পারেন।
২০১৭ সালে প্রকাশিত হওয়া বার্কলে এবং হার্ভাডের একদল বিশেষজ্ঞের গবেষণা অনুযায়ী, টানা পঁয়ত্রিশ ঘণ্টা না ঘুমানোর ফলে, মানুষের ভাবোদ্দীপক মন অযৌক্তিক আচরণ শুরু করে। এই সময়টাতে মস্তিষ্কের সেরেব্রাল হেমিস্ফেয়ারে অবস্থিত আবেগ অনুভূতি সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত অ্যামিগডালা, নেতিবাচক অভিজ্ঞতা এবং উদ্দীপনাগুলোর ব্যাপারে প্রায় ষাট শতাংশ বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া শুরু করে। সাথে সাথে মস্তিষ্কের যে সমস্ত অংশগুলো আবেগ এবং প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতো, সেগুলোও মস্তিষ্কের মূল অংশের সাথে যোগাযোগের পরিমাণ সীমিত করে ফেলে। মোদ্দাকথা, ঐ সময়টাতে আপনি আপনার আশেপাশের মানুষ, ঘটনাগুলোর ব্যাপারে অস্বাভাবিকভাবে রকমের প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠবেন। সে সময় নিজের স্বাভাবিক বিবেচনা বোধ হারানোর সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
আটচল্লিশ ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে আপনার মস্তিষ্ক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। এ সময় আপনি হ্যালুসিনেশনের সম্মুখীন হতে পারেন। ডাক্তার ফেইনসিলভার তার মেডিকেলে পড়ার সময় এ ব্যাপারটি নিজে প্রত্যক্ষ করেন।
সময়টা ছিল অক্টোবর, হ্যালোউইনের ঠিক পূর্বে। সে সময় তিনি তীব্র ঘুমহীনতায় ভুগছিলেন। একদিন রাস্তায় বের হয়ে তিনি দেখলেন, একটি কুমড়ো তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে! তাৎক্ষণিক হ্যালুসিনেশনের ব্যাপারটি ধরতে না পারলেও, বুঝতে পারার পর তিনি দ্রুত বাড়ি চলে আসেন।
সঠিক তথ্য প্রমাণ না থাকলেও গবেষকরা বিশ্বাস করেন, কয়েকদিন ধরে টানা নিদ্রাহীনতা মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, নিদ্রাহীনতার ফলে মস্তিষ্কে এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়ার কারণ কী?
এ ব্যাপারে গবেষকরা নিশ্চিত করে কিছু না বলতে পারলেও, তারা এটিকে ‘সাবস্টেন্স এস’ হিসেবে খেতাব দেয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দ্রব্যটি বিপাকের সময় রক্তে তৈরি হওয়া অ্যাডিনোসিন নামক উপজাত, যা দিনের বেলায় মস্তিষ্কে জমা হয় এবং এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই মস্তিষ্ক রাতে ঘুম প্রত্যাশা করে। এ ব্যাপারে ফেইনসিলভার বলেন,
“মানুষের মস্তিষ্ক শরীরের সক্রিয় বিপাকীয় ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি। লম্বা সময় ধরে কাজ করার ফলে যেমন পেশিতে ল্যাকটেট তৈরি হয় এবং মাংস পেশিতে যন্ত্রণা দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্রাম নেওয়ার তাগিদ দেয়, তেমনি লম্বা সময় ধরে জেগে থাকার ফলে মস্তিষ্ক বিষাক্ত দ্রব্য উৎপাদন করে এবং এই বিষাক্ত দ্রব্য থেকে ত্রাণ পাওয়ার জন্যই ঘুমের নকশা করা হয়েছে।”
মস্তিষ্ক ছাড়াও দীর্ঘ নিদ্রাহীনতা মানুষের হৃদপিন্ডের ক্ষতি করে
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে নানারকম শারীরিক এবং মানুষিক চাপের ফলে শরীরের রক্তচাপ এবং হার্টরেট বৃদ্ধি পায়, যা রাতে পর্যাপ্ত ঘুমানোর ফলে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। অর্থাৎ, ঘুমকে অনেকাংশেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক চিকিৎসা হিসেবে ধরা হয়।
দীর্ঘ আঠারো ঘণ্টা একনাগাড়ে না ঘুমানোর ফলে আমাদের হৃদপিণ্ড পর্যাপ্ত অবকাশ যাপনের সুযোগ পায় না, যার ফলে প্রাণঘাতী ফলাফলের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহের শুরুতে দীর্ঘসময় ধরে অফিস করার পর যদি ঘুমের পরিমাণ কম হয়, তাহলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় পঁচিশ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়াও অনিয়মিত নিদ্রা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক সহ দীর্ঘ মেয়াদী হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
টানা আঠারো ঘণ্টা না ঘুমালে টেস্টোস্টেরনের হ্রাস ঘটে
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে দৈনিক পাঁচ ঘণ্টারও কম ঘুম, শরীরের টেস্টোস্টেরন হরমোনের পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মতো কমে যায়। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে বছরে মাত্র ১-২% ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ, নিয়মিত দীর্ঘ সময়ের নিদ্রাহীনতা আপনাকে অল্প বয়সেই বার্ধক্যে পৌঁছে দিতে পারে।
কর্মক্ষমতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসও নিদ্রাহীনতার ফল
লম্বা সময় জাগ্রত থাকার ফলে আমাদের শরীরের ইন্টারলিউকিন-৬ এর মতো প্রদাহজনিত প্রোটিন তৈরি হয় এবং সাথে সাথে ইমিউন সেলগুলো হ্রাস পেতে শুরু করে। যার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ক্যান্সার এবং ভাইরাস সংক্রমিত সেলগুলো সেই সুযোগে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এক রাতের খারাপ ঘুম শরীরের ৭০ শতাংশ ইমিউন সেল হ্রাস করে ফেলে। শুধু তা-ই নয়, ২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশনের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, যারা রাতের শিফটে কাজ করে, তারা বেশিরভাগ সময় ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে।
এছাড়াও কর্মক্ষমতা হ্রাসজনিত সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও নিদ্রাহীনতা দায়ী। ম্যারাথন, আল্ট্রাম্যারাথন, ট্রায়ালথনের মতো এনডুরেন্স ইভেন্টগুলোতে অংশ গ্রহণকালে তা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। ইভেন্টের আগের রাতে খারাপ ঘুম আপনাকে অনেকাংশেই দুর্বল করে দেয়। লম্বা সময় ধরে প্রস্তুতি নেওয়া শরীরে দুর্বলতা তেমন অনুভূত না হলেও, মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া ধোঁয়াটে ভাব আপনার সেরাটি উপহার দিতে বাধা দেয়।
নিদ্রাহীনতার সমাধানে রোর বাংলার এই দুটি লেখা কাজে আসতে পারে-
১) ক্যানাবিস: নিদ্রাহীনতা সমাধানের ভিন্নধর্মী পন্থা
২) ঘুমের সমস্যা সমাধানে ১৫টি কার্যকর টিপস
ফিচার ছবি: Bill Butcher