বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, সেই তুলনায় এই রোগ থেকে সেরে ওঠা মানুষের সংখ্যাটা অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, এই সংখ্যাটা মোট আক্রান্তের এক-পঞ্চমাংশ। চার মাস আগে সংক্রমণ শুরুর পর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেরে ওঠার সংখ্যাবৃদ্ধির গতি সেই তুলনায় ধীর। তবু মানুষ লড়াই করে যাচ্ছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে। কেউ বেঁচে ফিরছে, কেউ বা বরণ করে নিচ্ছে করুণ মৃত্যুকে।
ঠিক কত লোক কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছে সেটা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে। জনস হপকিন্সের মুখপাত্র ডগলাস ডনোভান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএনকে দেয়া এক ইমেইল বার্তায় বলেন, সেরে ওঠা রোগীদের প্রকৃত সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে। আমেরিকার সেন্টার অফ ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) বরাত দিয়ে সিএনএন বলছে, কোভিড-১৯-এর বেশিরভাগ ব্যক্তির হালকা অসুস্থতা রয়েছে এবং তারা চিকিৎসাসেবা ব্যতীত বাড়িতেই সেরে উঠতে সক্ষম হন, তবে গুরুতর ক্ষেত্রে অবশ্যই হাসপাতালে যেতে হয়।
তাদের মতে, বাসায় থেকে যারা সুস্থ হয়ে উঠছেন তাদের ক্ষেত্রে ৩টি মানদণ্ড দেখে তাদেরকে কোভিড-১৯ মুক্ত বলে ধরে নেয়া হয়। সেগুলো হচ্ছে- জ্বর কমানোর ওষুধ ব্যবহার ছাড়া অন্তত ৭২ ঘন্টা জ্বরহীন থাকা। করোনার অন্যান্য লক্ষণ, অর্থাৎ কাশি, শ্বাসকষ্টের উপসর্গগুলো কাটিয়ে ওঠায় উন্নতি এবং প্রথম লক্ষণ দেখা যাওয়ার অন্তত ৭ দিনের মধ্যে আর কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়া। তবে এক্ষেত্রে টেস্ট করার সুযোগ থাকলে ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুবার টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হবে।
মার্চ মাসের প্রথমদিকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক ব্রিফিংয়ের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ড. মাইক রায়ান বলেছিলেন, করোনাভাইরাসজনিত অসুস্থতা থেকে পুরোপুরি সুস্থ হতে ছয় সপ্তাহের বেশি সময় নিতে পারে। তবে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সময়টা কয়েক মাসেও যেতে পারে। তবে এসব ব্যাপার ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হতে পারে। গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেডিকেল জার্নাল জামা-তে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে চীনের উহানে করোনায় আক্রান্ত চার স্বাস্থ্যকর্মীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে যাদের শরীরে করোনার উপসর্গ না থাকার ১৩ দিন পরও এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
উহানেরই আরও কিছু রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে আরেক মেডিকেল জার্নাল ল্যান্ডসেটে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে ৩৭ দিন পর্যন্ত এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। গবেষণাটির তথ্য বলছে, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তাদের অসুস্থতা শুরু হওয়ার ২০ দিন পরে ভাইরাস শনাক্ত করা গিয়েছিল। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময়কাল সর্বনিম্ন আট থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ দিন।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে সম্ভাব্য একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। পত্রিকাটি বলছে, চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে এই ধরনের রোগীদের ব্যাপারে ডাক্তাররা বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করেন। গুরুতর রোগী যারা হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস দেয়া হয়। একটা সময় পর রোগী যখন নিজেই শ্বাস নিতে পারেন তখন কৃত্রিম শ্বাসনলটি খুলে নেয়া হয় এবং রোগীকে কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়। এরপরও রোগীর অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে মাস্ক বা এয়ারওয়ে প্রেসার ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
রোগী নিরাপদ বোধ না করা পর্যন্ত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেই (আইসিইউ) থাকেন। সংশ্লিষ্ট এক চিকিৎসকের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান বলছে, এই সময়টা ভেন্টিলেশন বন্ধ করার পর থেকে অন্তত তিন দিন। তবে এরপরও লড়াই শেষ হয় না।
নিউপোর্টের রয়্যাল গওয়েন্ট হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা পরামর্শক ডা. ডেভিড হেপবার্ন টুইটারে লিখেছেন,
আপনি যদি আইটিইউ (নিবিড় থেরাপি ইউনিট)-এ শেষ করেন তবে এটি একটি জীবন পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা। আপনি আরও ভাল হয়ে উঠলেও এটি একটি বিশাল ব্যয় বহন করে। আমাদের রোগীরা জেগে ওঠার সাথে সাথে এতটাই দুর্বল থাকেন যে তারা বিনা সহায়তায় বসে থাকতে পারে না, গভীর দুর্বলতার কারণে অনেকে বিছানা থেকে হাত ওঠাতে পারেন না।
হাসপাতাল ছাড়ার আগে এই ধরনের রোগীদের কৃত্রিম সরবরাহ ছাড়া স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হয়। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার ফলে রোগীর দ্রুত ওজন কমতে পারে এবং বায়ু চলাচলের সময় শরীর সংকীর্ণতার ফলে রোগীর পেশীগুলোর অপচয়জনিত কারণে দুর্বলতার মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার প্রতিকারের জন্যও কাজ শুরু করতে হয়। প্রথম সপ্তাহে বায়ু চলাচল করার পরেও চেয়ারে বসে থাকা একটি প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে, কিন্তু চলাচল বৃদ্ধি করার ফলে পেশীগুলোর উন্নতি হয় এবং দিন দিন সেগুলো দৃঢ় হয়।
যখন রোগী হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায় তখন ফুসফুস এবং পেশী উভয়েরই ক্ষতির কারণে কয়েক মাস ধরে ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তবে যারা ভেন্টিলেটারে না গিয়ে এর পরিবর্তে এয়ার প্রেশার ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই সময়টা কম লাগবে।
শারীরিক অসুস্থতা কেটে গেলেও মানসিকভাবে এই ধরনের রোগীরা বহুদিন পর্যন্ত বিপর্যস্ত থাকতে পারে। স্মৃতিতে থেকে যাওয়া সংকটের দিনগুলো হ্যালুসিনেশন তৈরি করতে পারে, যা পরবর্তীতে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
করোনার ভয়াল থাবা থেকে বেঁচে ফিরে আসা একজনের গল্প বলা যাক এবার। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন সংকটকালীন সেসব দিনের কথা।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত স্টুয়ার্ট বয়েল কয়েক সপ্তাহ আগে এক মিটিং থেকে করোনায় সংক্রমিত হন। তিনি বলছিলেন,
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। দেখা হওয়ার পরে আমরা সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছিলাম। কিন্তু রবিবারের মধ্যেই কিছু সংখ্যক লোকের দেহে ফ্লুর মতো লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। লক্ষণটা প্রথমে অনেক অল্পই ছিল। আমি সিঁড়িতে ওঠার এবং ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করতাম। … ভাইরাসটি আমার ফুসফুসকে আক্রমণ করেছিল। আমি লড়াইয়ের ক্ষমতা হারাচ্ছিলাম।
স্টুয়ার্টের পরিবার জরুরি সেবায় ফোন করলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
আমাকে রেড জোনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। তারা ভেবেছিল আমার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছিল, তাই তারা আমাকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করেছিল। ভেবেছিলাম আমার সময় শেষ, কিন্তু আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। … এনএইচএস (যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা) কর্মীরা ছিল অবিশ্বাস্য। তারা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আপনাকে সবরকম সহায়তা করবে।
স্টুয়ার্ট এটাও মনে করিয়ে দিলেন যে, এই ভাইরাসের যেহেতু কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই তাই সেরে উঠতে মনের জোর রাখা চাই সবসময়। গত ২৮ মার্চ তিনি হাসপাতাল ছাড়েন এবং এখন ঘরের মধ্যে নিজেকে আইসোলেশনে রেখেছেন। তার ফুসফুস এবং গলা সেরে উঠবার জন্য তিনি প্রচুর পানি পান করছেন।