এক
মোতালেব হোসেন(ছদ্মনাম) একজন কৃষক। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে তার নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। তিনি একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগী। কিন্তু সচেতনতার অভাবে তিনি নিয়মিতভাবে ডাক্তারের পরামর্শ, ঔষধ গ্রহণ বা নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস; এর কোনোটাই মেনে চলেন না। হঠাৎ যখন রক্তচাপ বেড়ে যায়, তখন অসুস্থ বোধ করায় ঔষধের দোকান থেকে দুয়েকটা রক্তচাপের ঔষধ কিনে খান, তারপর আবার আগের মতোই চলেন। এভাবেই চলছিলো সময়। হঠাৎ একদিন তার শরীরের একপাশ অবশ হয়ে গেলো, মুখ বাঁকা হয়ে গেলো, সেইসাথে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। বাড়ির লোকজন বললো, “বাতাস লাগছে”! তাই তারা কবিরাজ ডেকে নিয়ে আসলো। মোতালেব হোসেনের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই আব্দুল গফুর (ছদ্মনাম) নামে একজন স্কুল শিক্ষক বাস করেন। তিনি এ খবর শোনামাত্র মোতালেব সাহেবকে দেখতে গেলেন। স্ট্রোক সম্পর্কে অল্পবিস্তর কিছু ধারণা থাকায় তিনি বুঝতে পারলেন যে, মোতালেব হোসেন স্ট্রোক করেছেন। কিন্তু বাড়ির লোকজনকে কিছুতেই তা বোঝাতে পারছেন না। অনেক পীড়াপীড়ি করার পর অবশেষে তিনি মোতালেব হোসেনকে হাসপাতালে পাঠাতে সক্ষম হলেন।
দুই
হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা গ্রহণের পর মোতালেব হোসেন বাড়ি ফিরে এলেন। এখন তিনি মোটামুটি সুস্থ, কিন্তু ডান পাশের হাত এবং পা পক্ষাঘাতগ্রস্থ থেকে গেলো। এবার শুরু হলো পক্ষাঘাত তথা প্যারালাইসিসের চিকিৎসা। কবিরাজ ডাকা হলো, যিনি প্রথমবারও এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। কবিরাজ তাকে গলা পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে ফেললেন এবং চিকিৎসার নামে উদ্ভট সব কাণ্ড শুরু করে দিলেন। একটি দীর্ঘ সময় এই অপচিকিৎসা চলতে থাকল। বাড়ির লোকেদের বিশ্বাস, এতে প্যারালাইসিস ভালো হয়ে যাবে!
উপরের এই ঘটনা শুনে কি অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, এই ২০১৯ সালে এসেও মানুষ এতটা অজ্ঞ, এতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন থাকতে পারে? তাহলে বলব, হ্যাঁ পারে। শুধু হতেই পারে না, এই-ই হয়ে থাকে। গ্রামে এখনো মানুষের স্ট্রোক এবং প্যারালাইসিস বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই। বরং এ বিষয়ে মানুষজন আজগুবি সব ধারণা পোষন করে। তাই এ বিষয়ে সচেতন করাই আজকের লেখার উদ্দেশ্য।
স্ট্রোক কী?
প্রথমেই স্ট্রোক নিয়ে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করা যাক। মস্তিষ্ক আমাদের দেহের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি একটি সংবেদনশীল অঙ্গ। এতে ছোট-বড় অসংখ্য রক্তনালী দ্বারা রক্ত সংবহিত হয়। এই সংবহিত রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্ক পুষ্টি পদার্থ গ্রহণ করে তার স্বাভাবিক ক্রিয়া পরিচালনা করে। কিন্তু কোনো কারণে যদি আমাদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে স্ট্রোক বা ব্রেইন স্ট্রোক বলে। সাধারণত দুই ধরনের স্ট্রোক হয়ে থাকে;
১. ইসকেমিক(Ischemic) স্ট্রোক: এ ধরনের স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্তনালীর অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। ফলে ওই রক্তনালী দিয়ে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের স্ট্রোক দেখা যায়।
২. হেমোরেজিক(Hemorrhagic) স্ট্রোক: এ ধরনের স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে যায় এবং রক্তপাত হয়। এ ধরনের স্ট্রোক তুলনামূলকভাবে বেশি মারাত্মক।
স্ট্রোকের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ
আপনার পরিবারের বা আশেপাশের কারো স্ট্রোক হলে, কীভাবে বুঝবেন? এটি মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়। কিছু বিষয় খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। রোগীরা দু’ ধরনের স্ট্রোকেই প্রায় একই ধরনের লক্ষণ এবং উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে। এগুলো হলো:
- হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া
- শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যাওয়া
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- মুখ বেঁকে যাওয়া
- হাসলে মুখ অন্য পাশে চলে যাওয়া
- কথা বলতে না পারা
- কথা জড়িয়ে যাওয়া
- হঠাৎ চোখে না দেখা
- গিলতে সমস্যা হওয়া
- হাঁটতে না পারা
- বমি বমি ভাব বা বমি
- ঘুম ঘুম ভাব
- চোখে একটি জিনিস দু’টি দেখা
- প্রচণ্ড মাথাব্যথা প্রভৃতি।
অনেকের ক্ষেত্রে এই লক্ষণ-উপসর্গগুলো হঠাৎ দেখা দেয় আবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। একে ট্রানজিয়েন্ট ইসকেমিক অ্যাটাক (Transient Ischemic Attack) বলে।। এটিও একধরনের স্ট্রোক, তবে মিনি স্ট্রোক। মনে রাখতে হবে যে, এই মিনি স্ট্রোক হচ্ছে বড় ধরনের স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ।
ঝুঁকিপূর্ণ কারণ
অনেকগুলো কারনেই স্ট্রোক হতে পারে-
- উচ্চ রক্তচাপ
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
- স্থূলতা
- ধূমপান
- মদ্যপান
- রক্তে বেশি মাত্রায় কোলেস্টেরল
- পারিবারিক ইতিহাস প্রভৃতি
জটিলতা
স্ট্রোকের ফলে সৃষ্ট অনেকগুলো জটিলতার মধ্যে প্যারালাইসিস অন্যতম। তাই প্যারালাইসিসের বিষয়ে কিছু ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। মস্তিষ্ক নিউরন নামক অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। এই কোষ তথা নিউরনসমূহ অত্যন্ত সংবেদনশীল। যেহেতু একমাত্র রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে অক্সিজেন এবং শর্করা সরবরাহ হয়, তাই রক্ত প্রবাহে বাধার ফলে অক্সিজেন এবং শর্করার অভাবে দ্রুত এই নিউরনগুলো মরে যায়। ফলস্বরূপ, ওই নিউরনগুলো শরীরের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো, সেই অংশগুলোর প্যারালাইসিস হয়ে যায়। সাধারণত মস্তিষ্কের ডান অংশ নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের বাঁ অংশকে এবং বাঁ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের ডান অংশকে। তাই স্ট্রোক মস্তিষ্কের যে পাশে হয়, শরীরে প্যারালাইসিস তার বিপরীত পাশে হয়। রোগীর শরীরের কতটুকু অংশের প্যারালাইসিস হবে, তা নির্ভর করে মস্তিষ্কের অঞ্চলসমূহের কোন এলাকায় রক্ত চলাচলে ব্যত্যয় ঘটলো বা রক্তপাত হলো, কতটা এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং কত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা হলো, তার উপর।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা নির্দিষ্ট এবং এরা বিভাজিত হতে পারে না। ফলে নিউরন মরে গেলে নতুন কোনো নিউরন তৈরি হয় না। তাই প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া অঙ্গ সম্পূর্ণরূপে আগের অবস্থায় ফিরতে পারে না। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে আগের অবস্থার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়া আরেকটি জটিলতা হলো, হেমোরেজিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে মস্তিস্কের অভ্যন্তরে চাপ অনেক বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চাপে মস্তিস্কের নিচের দিকের অংশ, করোটি এবং মেরুদণ্ডের সংযোগস্থলের ছিদ্র দিয়ে নিচের দিকে নেমে আসে। এর ফলে মস্তিষ্কের ওই অংশে অবস্থিত শ্বাস-প্রশ্বাস কেন্দ্র বিকল হয়ে যায়। ফলে শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটে। তবে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এসব জটিলতা পরিহার বা কমিয়ে আনা যায়।
প্রতিরোধ
বলা হয়, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই স্ট্রোকের প্রতিরোধ আমাদের সুস্থ জীবনযাপনে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবলম্বন করার মাধ্যমে সহজেই স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে পারি।
- নিয়মিত ব্যায়াম
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: আমাদের দেশের অনেক মানুষই উচ্চ রক্তচাপের রোগী। কিন্তু এদের বেশিরভাগ মানুষ সচেতনতার অভাবে অথবা অবহেলাবশত তা নিয়ন্ত্রণ করেন না। নিয়ন্ত্রণ মানে এই নয় যে যখন অসুস্থ বোধ করবেন, তখন এর চিকিৎসা নেবেন। বরং নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস, নিয়মিত চেকআপ এবং ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ- এসব মিলেই নিয়ন্ত্রণ।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন
- বেশি মাত্রায় কোলেস্টেরল থাকে, এমন খাবার বর্জন
- আঁশ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, পরিমিত মাত্রায় লবণ গ্রহণ, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলা প্রভৃতি।
চিকিৎসা এবং অপচিকিৎসা
স্ট্রোক হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, রোগী যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা পাবে, জটিলতার ঝুঁকি তত কমে যাবে। স্ট্রোকের চিকিৎসা সাধারণত দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত। স্ট্রোকের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা এবং প্যারালাইসিস (যদি হয়) এর চিকিৎসা। হাসপাতালে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার সময় বা অল্প কিছুদিন পর প্যারালাইসিসের চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসার দ্বিতীয় পর্যায়টি ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে এই চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসাকে স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসন ও বলে। ফিজিওথেরাপি সেন্টারগুলো এই পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর জন্য এটি খুবই জরুরি। কেননা, সঠিক চিকিৎসা না পেলে রোগী স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়, অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে ওঠে। এতে করে পরিবার, সমাজের এবং রাষ্ট্রের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই চিকিৎসার এই দ্বিতীয় পর্যায় সম্পর্কে অবগত নয়। তারা কবিরাজ, ওঝার দ্বারস্থ হয় এবং ঝাড়ফুঁকের নামে বিভিন্ন ধরনের অপচিকিৎসা অবলম্বন করে। এসব অপচিকিৎসার পদ্ধতিগুলোও উদ্ভট। কখনো রোগীর শরীরের অংশ মাটিতে পুঁতে, কখনো রোগীকে শুইয়ে রেখে তার চারপাশে গান-বাজনা করে, কখনো ঝাঁটা দিয়ে রোগীকে আঘাতের মাধ্যমে! এসব কর্মকাণ্ড দেখে হতাশ হতে হয় এই ভেবে যে, মানুষ এখনো কতটা অজ্ঞ, কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে এই অপচিকিৎসা বেশি দেখা যায়। মনে রাখতে হবে যে, এসব অপচিকিৎসার কোনোই ভিত্তি নেই। উপরন্তু, এগুলো রোগীর অবস্থা আরো জটিল করে দেয়। সেইসাথে এসব প্রতারক কবিরাজরা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়।
সচেতন হয়ে আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমেই আমরা একজন রোগীর প্যারালাইসিস অবস্থার উন্নতি করতে পারি, যা সহজ করে দেবে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাপন, এনে দেবে কর্মক্ষমতা এবং করে তুলবে আত্মনির্ভরশীল। এতে করে পরিবার এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া রোধ হবে। তাই সচেতনতা একান্তভাবে কাম্য।