বর্তমান সময়টা এমন যখন সামান্য মাথা ব্যথা বা পেট ব্যথার জন্যও আমরা পেইনকিলার খেয়ে থাকি। কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের জন্য এতটাই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে যে, এসব সামান্য ব্যথাও আমাদের আর সহ্য করতে হয় না। কিন্তু কখনো আপনার মাথায় এমন প্রশ্ন আসেনি যে, যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল না বা থাকলেও তেমন একটা অগ্রগতি সাধিত হয়নি তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা কী উপায়ে ব্যথা উপশম করতো? সেই সময়টায় দাঁতের ব্যথা, কানের ব্যথা, হাত-পা কেটে যাওয়া অথবা ধরুন অস্ত্রোপচারের মতো মারাত্মক যন্ত্রণা কমাতে কী করতো ‘পেইন কিলার’ বা ‘চেতনা নাশক’ এর অভাব পূরণ করতে?
অতীতে মানুষকে অনেক কষ্ট করে সম্পূর্ণ চিকিৎসা প্রক্রিয়া সহ্য করতে হতো। এক গ্লাস ওয়াইন বা হুইস্কি ব্যথা উপশম করতে যথেষ্ট সক্ষম ছিলো না। তবে এটাও সত্য যে, সবাইকে এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি, কেউ কেউ যন্ত্রণা বা ব্যথা কমানোর বিকল্প রাস্তা ঠিকই খুঁজে বের করেছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় বলা হয়, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চিকিৎসা ও ঔষধের ক্ষেত্রে সৃজনশীল ছিল। প্রকৃতপক্ষে তাদের জ্ঞান এতটাই চটুল ছিল যে, খুব সাধারণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েই তারা ব্যথা বা প্রদাহ থেকে মুক্তি অথবা কষ্ট কমিয়ে ফেলার উপায় বের করেছিল। আজকের এই লেখায় সে সমস্ত কিছুই থাকবে যা আমাদের পূর্বপুরুষরা ব্যথা উপশমের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
ক্যারোটিড কম্প্রেশন
প্রাচীনকালে চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন যে ব্যথা দূর হবার একমাত্র উপায় হলো রোগীকে অজ্ঞান অবস্থায় রাখা। আর ঠিক কিভাবে এই কার্যটি সম্পাদন করা হতো? বিশ্বাস করুন আর না-ই বা করুন, প্রাচীন চিকিৎসকরা মাঝেমধ্যে রোগীদের ঘাড়ের ক্যারোটিড ধমনী (মস্তিষ্কে রক্ত-সংবহনকারী প্রধান ধমনীর একটি) চেপে ধরে এই কাজটি সম্পূর্ণ করতেন। চিত্রটি অনেকটা এমন যে, কোনো সিনেমায় যেমন একজন আরেকজনের গলা চেপে ধরে মারতে চায় ঠিক যেন তেমন। কিন্তু এই পদ্ধতি সফল ছিল, ডাক্তাররা নিশ্চিত হয়ে নিতেন যে, এই প্রক্রিয়া কেবল সাময়িক সময়ের জন্য রোগীর ধমনী বন্ধ করে দেবে।
এথেন্সের পার্থেননের দক্ষিণ দিকের একটি ভাস্কর্যে এমনটা দেখা যায় যে, একজন নরঘোটক অন্য একজন ল্যাপিথ যোদ্ধার ঘাড়ের ক্যারোটিড ধমনী চাপ দিয়ে ধরে রেখেছেন। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচীন গ্রিকরা এই কৌশলটির কার্যকারিতা সম্পর্কে সচেতন ছিল যে এভাবে চেপে ধরার মাধ্যমে কাউকে সহজেই অজ্ঞান করে দেওয়া সম্ভব। সত্য বলতে, যুদ্ধের এই কৌশলই হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষেরা চিকিৎসা ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছিলেন।
ইথিলিন
একটু অদ্ভুত শোনালেও এটা সত্য যে, একটা সময় ত্রুটিযুক্ত গ্যাস লাইনের গ্যাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করেও আমাদের পূর্বপুরুষরা অজ্ঞান করতেন। এই গ্যাসের অন্যতম উপাদান ছিল ইথিলিন। এই ইথিলিন দ্বারা চেতনানাশের ব্যাপারটা খুব জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনী থেকে এসেছিলো, যেখানে বলা হয়েছিলো অ্যাপোলোর পিথিয়ান পুরোহিত সূর্যদেবতার মন্দির নিচে ফল্ট লাইন থেকে গ্যাস শ্বসন সম্পর্কে বলেছিলেন।
১৯৩০ সালে ইথিলিন সর্বজনীন ক্লোরোফর্মের পরিবর্তে মেডিক্যাল টেকনোলজিতে নতুন সাধারণ অ্যানেসথেটিক হিসেবে বেশ প্রশংসা অর্জন করে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইথিলিন প্রায় ৩-৮ মিনিটের জন্য রোগীকে অজ্ঞান করে দিতে সক্ষম এবং তা-ও আবার অস্ত্রোপচারের পর কোনোপ্রকার ঘুম ঘুম ভাব ও বমিভাবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া।
এসব ছাড়াও ইথিলিনের আরও কিছু সুবিধা ছিল। ইথিলিন স্নায়ুতন্ত্র বা শরীরের অন্য কোষের উপর বিষাক্ত বা টক্সিক কোনো প্রভাব ফেলতো না। এতে মাথাব্যথা বা অন্যান্য কোনো উপসর্গের সম্ভাবনা ছিলো না। এমনকি ইথিলিন রোগীর ফুসফুসে জ্বালাপোড়া, উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি, অতিরিক্ত রক্তপাত ও অস্ত্রোপচার পরবর্তী অতিরিক্ত ঘাম ইত্যাদি সমস্যাগুলো হতো না। কোনো সন্দেহ নেই যে, অ্যাপোলোর পুরোহিতের ভূপৃষ্ঠ থেকে উৎক্ষেপিত ইথিলিন অনুভূতিনাশকের আবিষ্কার বা বাণী যুগান্তকারী ছিল।
আফিম
৩৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিম্ন মেসোপটেমিয়ায় আফিমের চাষ করা হতো। সুমেরিয়ানরা আফিমকে ‘হাল গিল’ বা ‘আনন্দের উদ্ভিদ’ নামে আখ্যায়িত করেছিল। আনন্দায়ক এবং চেতনানাশক বৈশিষ্ট্য থাকায় আফিমের নির্যাস সংগ্রহকরণ মিশরীয়, ব্যাবিলনীয় এবং অ্যাসিরিয়ানদের কাছে সুপরিচিত ছিল। আর পরবর্তীতে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরীয়রা নিজস্বভাবে আফিমের চাষ করা শুরু করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহারের উদ্দেশ্য নিয়ে। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ভারতীয় ও পার্সিয়ানদের কাছে আফিম সুপরিচিত করে তুলেছিলেন বলে জানা যায়।
আকুপাংচার
১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘দ্য ইয়োলো ইম্পেরর’স ক্লাসিক অফ ইন্টারনাল মেডিসিন’ অনুযায়ী, আকুপাংচার হচ্ছে “রোগ নির্ণয়ের এবং চিকিৎসার একটি সংগঠিত পদ্ধতি।” এই পদ্ধতিতে শরীরের বিভিন্ন অংশে সুঁই ব্যবহার করে চিকিৎসা প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় ।
যেখানে কিছু সংখ্যক মানুষ আকুপাংচারকে বিস্ময়কর চিকিৎসা পদ্ধতি বলে মেনে নিয়েছিলেন, সেখানে অধিকাংশ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ দ্বিমত পোষণ করেন। ফলাফল হিসেবে সপ্তদশ শতাব্দীতে আকুপাংচারের অনুশীলন জনসমর্থন হারাতে বসে এবং ১৯২৯ সালে এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের দিকে এই চিকিৎসা পদ্ধতি পূর্ববর্তী সম্মানজনক অবস্থায় ফিরে আসে এবং বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে পুনর্বহাল হয়। তারপর জাপান, সম্পূর্ণ ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে আকুপাংচারের প্রসার ও প্রচার ছড়িয়ে পড়ে, যদিও খুব সামান্য কিছু ক্লিনিক্যাল গবেষণা আকুপাংচারকে ব্যথা ও অন্যান্য সমস্যার চিকিৎসা করতে সক্ষম বলে সমর্থন করে।
ক্যানাবিস
ক্যানাবিস, আমাদের কাছে গাঁজা বা উইড নামেই সুপরিচিত। ২৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে চীনের সম্রাট ফু লক্ষ্য করেছিলেন যে, ক্যানাবিসে ব্যথা উপশমের ক্ষমতা রয়েছে। ব্যথা নিরাময়ের জন্য ক্যানাবিসের ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে চীনের স্থান ইতিহাসে প্রথম। চীন থেকে সারা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যথা নিরামক হিসেবে ক্যানাবিসের ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতীয়রা দুধের সাথে ক্যানাবিস মিশ্রণ করে ‘পেইনকিলার’ হিসেবে অর্থাৎ ব্যথা নিরাময়ের উদ্দেশ্যে পান করা শুরু করে, যাকে ভারতীয়রা আঞ্চলিক ভাষায় ‘ভাং’ নামে আখ্যায়িত করে। পরবর্তীতে কানের ব্যথা, কোথাও ফুলে যাওয়া ও অন্যান্য প্রদাহের প্রতিকারক হিসেবে ক্যানাবিসের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। ২০০ খ্রিস্টাব্দে হুয়া নামক একজন চীনের ডাক্তার ওয়াইনের সাথে ক্যানাবিস মিশ্রিত করে একপ্রকারের চেতনানাশক পানীয় আবিষ্কার করেন, যা পেট ও বুকের অস্ত্রোপচারের সময় ব্যবহার করতেন এবং এটি প্রায় ব্যথাহীন নিরাময়ক হিসেবে কাজ করে। ৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই আরবীয়রা ক্যানাবিস মাথাব্যথা ও মাইগ্রেনের ব্যথা উপশমে ব্যবহার শুরু করেন।
ধুতুরা
আমাদের কাছে ধুতুরা বিষাক্ত উদ্ভিদ নামেই সুপরিচিত। কিন্তু একাধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষদের নিকট ধুতুরা ব্যথা উপশমকারী ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের মাধ্যম হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এক দ্রাকমা (৩.৪১১ গ্রাম) ধুতুরা ওয়াইনের সাথে পান করলে হ্যালুসিনেশনের কারণ হতে পারে, দুই দ্রাকমা একজন মানুষকে কমপক্ষে তিন দিনের জন্য সম্পূর্ণ উন্মাদ করে দিতে আর বৃহত্তর পরিমাণ মানুষকে সাড়া জীবনের জন্য পাগল করতে বা মৃত্যু ঘটাতেও সক্ষম।
প্রাচীনকালে অস্ত্রোপচারের সময় রোগীদের ব্যথামুক্ত করার ক্ষেত্রে ধুতুরা কার্যকরী ছিল। তবে মাত্রাতিক্ত প্রয়োগের ফলে রোগীর মৃত্যু হয়েছিলো এটাও সত্য। আর এ কারণেই ধুতুরাকে ‘শয়তানের আপেল’ নামে ডাকা হয়।
হেনবেন
ঔষধি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত অন্যান্য ভেষজ ও ফুলের মতো হেনবেন Hyoscyamus niger নামেও সুপরিচিত। এই ভেষজ শরীর ও মনে প্রভাব ফেলতে সক্ষম ছিল। এই ভেষজটি সুপ্রাচীনকাল থেকে চেতনানাশক এবং ব্যথানাশক হিসেবে বহুল ব্যবহার হয়ে আসছিলো।
প্রকৃতপক্ষে প্রথম শতাব্দীতে হেনবেন মূলত ব্যথা দূর করতে ব্যবহার করা হতো। প্রাচীন তুরস্কে হেনবেন সুপরিচিত ছিল ‘beng’ বা ‘benc’ নামে, যা বড়ি বা ধোঁয়া আকারে গ্রহণ করা হতো দাঁতব্যথা, কানব্যথা ও এই ধরনের অন্যান্য অসুস্থতার নিরাময়ক হিসেবে। দাঁতব্যথার ক্ষেত্রে হেনবেন ধোঁয়া আকারে নেওয়া হতো। এক্ষেত্রে রোগী আগে গরম পানিতে মুখ কুলকুচি করার পর উক্ত ব্যক্তির মুখ খোলা অবস্থায় রেখে হেনবেন বীজ আগুনে ফেলে এর ক্রমবর্ধমান ধোঁয়া মুখের মধ্যে প্রবেশ করানো হতো।
উইলো বৃক্ষের ছাল
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উইলো বৃক্ষের ছাল প্রদাহবিরোধী বা ব্যথা উপশমকারী উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নীল নদের তীরে সাদা উইলো বৃক্ষ যেন এই ছালের একদম প্রস্তুত উৎস হয়ে উঠেছিলো।
১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ইবার্স পেপিরাস নামক ওষুধের বইয়ের এক সংকলনে উইলোর ছালের প্রদাহ নিরোধক ক্ষমতা নিয়ে বলা হয়েছিলো। এছাড়া প্রাচীন চীন ও গ্রিক সভ্যতায়ও ব্যথা নিরাময়ক হিসেবে এই ছাল ব্যবহার করা হতো। আধুনিক গবেষণায় জানা যায়, উইলো বৃক্ষের ছাল ব্যথা নিরাময় করতো, কারণ এতে সালিসিন নামক উপাদান উপস্থিত রয়েছে, যা অ্যাসপিরিনের অনুরূপ এক রাসায়নিক। গবেষণায় আরও জানান যায়, খুব সামান্য পরিমাণ ছাল ব্যথা নিরাময়ে অ্যাসপিরিনের চেয়ে আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে সক্ষম। শতাব্দীপ্রাচীন এই বৃক্ষের ছাল মাথাব্যথা, পিঠব্যথা ও অস্টিওআর্থ্রারাইটিসের মতো ব্যথা কমাতে কার্যকর।
মানদ্রাগোরা
সুন্দর বেগুনী রঙের ছয় পাপড়ির ফুল ও গাঢ় সবুজ পাতাসমৃদ্ধ উদ্ভিদ হচ্ছে মানদ্রাগোরা। ধারণা করা হয়, মানদ্রাগোরাই ছিল প্রথম চেতনানাশক উদ্ভিদ, যা প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষকে সম্পূর্ণ অবচেতন করতে সক্ষম ছিল। প্রথম শতাব্দীতে গ্রিক চিকিৎসক ডিওস্কোরাইডস মানদ্রাগোরার কার্যকারিতা নিয়ে লেখেন। তিনি সার্জারি রোগীদের জন্য একটি শক্তিশালী চেতনানাশক এজেন্ট হিসেবে মানদ্রাগোরা উদ্ভিদ থেকে ওয়াইন তৈরি করেছিলেন, যা ‘মানদ্রাগোরা ওয়াইন’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
ফিচার ইমেজ- turningpointsoftheancientworld.com