এংজাইটি ডিজঅর্ডার কী?
উদ্বেগ একটি সাধারণ আবেগ। আমরা জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবেই উদ্বিগ্নবোধ করি- কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে, কোনো পরীক্ষার পূর্বে, কিংবা প্রিয় কোনো মানুষকে দেখার জন্য। এই সবই আমাদের সাধারণ আবেগেরই অংশ। তবে যখন এই আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘন ঘন হতে থাকে, এবং তা স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করে, তখনই তা ব্যাধিতে পরিণত হয়।
মাঝে মাঝে উদ্বেগ বোধ করাটা স্বাভাবিক হলেও এংজাইটি ডিজঅর্ডার ভিন্ন বিষয়। এটি একধরনের মানসিক রোগ যা উদ্বেগ এবং ভয়কে চক্রাকারে বৃদ্ধি করে। এর ফলে দৈনন্দিন কাজকর্মও ব্যাহত হয়। এই অতিরিক্ত উদ্বেগ থেকে শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে কিংবা যেকোনো জায়গায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা এই রোগ বৃদ্ধির কারণ বা অবস্থার অবনতির কারণ হতে পারে।
এংজাইটির লক্ষণসমূহ
এংজাইটি ডিজঅর্ডারে ভুগছে এমন একেক ব্যক্তির একেক রকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সার্বিক অবস্থার উপর এ ধরনের উপসর্গ নির্ভর করে। তবুও সাধারণ কিছু উপসর্গ কম-বেশি সবার মাঝেই লক্ষণীয়, সেগুলো হলো:
- আতঙ্কিত হওয়া, ভয় পাওয়া, বা অস্বস্তি লাগা
- বিপদ বা ভয়ংকর কিছুর শঙ্কায় থাকা
- ঘুমের সমস্যা হওয়া, অর্থাৎ ঘুম কমে যাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া
- অস্থির বোধ করা
- হাত-পায়ের তালু ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া বা ঘামা
- গলা শুকিয়ে আসা
- বুক ধড়ফড় করা
- কোনো কাজে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়া
- বমি হওয়া বা বমিভাব হওয়া
- অতিরিক্ত চিন্তা করা, এবং নেতিবাচক চিন্তা করা
- কোনো কিছু সম্পর্কে বা স্থান সম্পর্কে অতিরিক্ত ভীতি কাজ করা
এছাড়াও, শ্বাসকষ্ট, কানে শব্দ হওয়া ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিয়ে থাকে।
এংজাইটি ডিজঅর্ডারের কারণসমূহ
এই মানসিক রোগের জন্য নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি। একই পরিস্থিতিতে একজনের হয়তো সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু অন্যজন মানসিক চাপে ভুগছেন। বৈজ্ঞানিকভাবে, এংজাইটির জন্য দায়ী এড্রেলিন এবং করটিসলের মতো হরমোন। এদের নিঃসরণের কারণ সম্পর্কে সঠিক কোনো কারণ জানা যায়নি। তবে সাধারণত যেসব কারণে বেশি মানুষ এংজাইটিতে ভোগে হয় এমন কিছু বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যায়।
১) জেনেটিক: এংজাইটি ডিজঅর্ডার বংশপরম্পরায় গড়াতে পারে। এংজাইটির ইতিহাসে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো মানুষের পরিবারে আগে থেকেই কেউ না কেউ এই রোগে আক্রান্ত ছিল।
২) ব্রেইন কেমেস্ট্রি: কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্কের যে অংশগুলো ভয়, আবেগ ইত্যাদি অংশগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, সেসব অংশের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ত্রুটির কারণেও স্ট্রেস, এংজাইটি হতে পারে।
৩) নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ ব্যবহারের কারণে: নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ অপব্যবহার বা অপরিমিত পরিমাণে গ্রহণের ফলে স্নায়ুচাপ থেকে এংজাইটিসহ আরও নানাবিধ মানসিক রোগ হতে পারে।
৪) নেশাজাত দ্রব্য: ধূমপান, মদ্যপান ছাড়াও আরও বিভিন্ন রকমের নেশা মানুষ করে থাকে। নেশা সবসময়ই মানুষের জন্য খারাপ কিছু বয়ে আনে, এংজাইটিও তেমন নেতিবাচক কারণের একটি। অতিরিক্ত নেশাজাত দ্রব্যের কারণে প্রথমে সামান্য, এবং পরবর্তীতে ক্রমশ এংজাইটি ডিজঅর্ডার হতে পারে। আবার হতে পারে হঠাৎ নেশা ছেড়ে দেয়ার ফলে শরীরে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তার থেকেও এমনটি হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা কখনোই হুট করে কোনো নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন না।
৫) পারিপার্শ্বিক পরিবেশ: এটি নির্দেশ করে আপনার সেই পরিস্থিতিকে যেখানে যথেষ্ট উত্তেজনা বা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো উপকরণ রয়েছে। যেমন- অবহেলা, ঘৃণা, নিকটস্থ কারোর মৃত্যু ইত্যাদি হলো নেতিবাচক পরিস্থিতি। আবার চাকরি পাওয়া, সন্তান জন্মদান ইত্যাদি হলো ইতিবাচক পরিস্থিতি।
৬) শারীরিক অবস্থা: নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক পরিস্থিতিতে মানুষের এংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা, হরমোনাল ইম্ব্যালেন্স (imbalnce) হলে সাধারণত মানুষের এংজাইটি হয়ে থাকে, অথবা মানুষের এংজাইটির উপসর্গগুলোকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই এংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসার সময় তার সম্পূর্ণ শরীরের হিস্ট্রি জেনে নেয়াই উত্তম।
এছাড়াও কিছু কারণ থাকে যার কারণে ব্যক্তির এংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যেমন:
১) পূর্ববর্তী কোনো মানসিক রোগ থাকা, ব্যক্তি পূর্বে কোনো মানসিক রোগ, যেমন— ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তার এংজাইটি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
২) শৈশবের কোনো কষ্টদায়ক স্মৃতি, শৈশবে শারীরিক, মানসিক, কিংবা যৌন অত্যাচার মানুষের মনে দাগ কেটে রাখে, যা পরবর্তী সময় এংজাইটিরূপে প্রকাশ পায়।
৩। দীর্ঘদিন কোনো রোগে ভুগলে, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগে দীর্ঘ সময় ভুগলে মানুষের মধ্যে এংজাইটি কাজ করে।
৪) আত্মসম্মানের অভাব, সাধারণত পারিবারিক কলহ থাকলে সন্তানের আত্মমর্যাদা কম থাকে, এই আত্মসম্মানবোধ বা কনফিডেন্স কম থাকার কারণে ব্যক্তি এংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারে।
এংজাইটির ধরন
এংজাইটি বেশ কয়েক ধরনের হয় থাকে, তবে কিছু এংজাইটি আছে খুব সাধারণ, এমন এংজাইটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরই সাধারণত বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
১) জেনারালাইজড এংজাইটি ডিজঅর্ডার: দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে সার্বক্ষণিক নেতিবাচক চিন্তা করা।
২) সোশ্যাল এংজাইটি ডিজঅর্ডার: একে স্যোশাল ফোবিয়াও বলে। এখানে ব্যক্তির সবসময় মনে হয় আশেপাশের মানুষেরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করছে।
৩) প্যানিক ডিজঅর্ডার: এটি হঠাৎ করেই হয়। প্যানিক অ্যাটাকের সময় সাধারণত ঘাম হয়, বুক ধড়ফড় করে, কখনো কখনো হার্ট অ্যাটাকের মতো মনে হয়।
৪) অ্যাগোরাফোবিয়া: এমন একধরনের এংজাইটি যেখানে ব্যক্তির ভয় এংজাইটিতে রূপান্তরিত হয়। অ্যাগোরাফোবিয়ায় ব্যক্তির মনে হয় যেকোনো জরুরি অবস্থায় তার সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন; জাহাজে থাকা অবস্থায় স্ট্রোক করতে পারে এমন ভয় হওয়া।
৫) নির্দিষ্ট কিছু ভীতি থেকে এংজাইটি: নির্দিষ্ট কিছুর প্রতি ভয় থেকে এংজাইটি। নির্দিষ্ট কিছুর প্রতি ভয়, যেমন- মাকড়সাভীতি থেকে উদ্বিগ্ন হওয়া।
৬) সেপারেশন এংজাইটি: বিচ্ছেদের ভয়ে উদ্বিগ্ন থাকা, ভালোবাসার মানুষ বা প্রিয় মানুষের সাথে বিচ্ছেদের শংকা থেকে উদ্বেগ কাজ করা।
আরও নানা ধরনের এংজাইটি হয়ে থাকে, যা ব্যক্তিভেদে পরিবর্তন হয়। নির্দিষ্ট এংজাইটির জন্য নির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে, সেসম্পর্কে অবগত থাকলে তা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বা সাবধানে থাকা সম্ভব। সাধারণ কিছু উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১) আপনার এংজাইটির ধরন সম্পর্কে জানুন। কিসে বা কী কারণে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন সেই বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকলে তা থেকে বিরত থাকা বা সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে তৈরি রাখা সহজ।
২) আপনার রিল্যাক্সেশন মেথড কী? সাধারণত ব্রিদিং এক্সারসাইজ, কাজের ফাঁকে ছোট বিরতিতে যাওয়া ইত্যাদি উপকারে আসে।
৩) নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করুন। চেষ্টা করুন এবং নিজের উপর জোর খাটিয়েই নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে ইতিবাচক চিন্তার সাথে প্রতিস্থাপন করুন, এবং একে অভ্যাসে পরিণত করুন।
৪) ব্যায়াম করুন। ধীরে হাঁটা নয়, ঘাম ঝরিয়ে দৌড়ানো বা সাঁতার কাটা। এটি ভেতরকার সংকোচ ভেঙে দেয়।
৫) নিকট কেউ বা বিশ্বাসযোগ্য কারো সাথে শেয়ার করুন, অথবা বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
এংজাইটি নিয়ে দৈনিক জীবনযাপন খুবই কষ্টের। সার্বক্ষণিক চিন্তা বা ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা সহজ নয়। এ কারণেই এমন অবস্থায় কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরি। যদি এংজাইটি উপসর্গ থাকে তবে ডাক্তার শুরুতেই শারীরিক কোনো সমস্যা আছে কিনা সেই বিষয় নিশ্চিত করবেন। যদি শারীরিক কোনো সমস্যা থেকে এংজাইটি না হয়ে থাকে তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে এংজাইটির ধরন বের করবেন, এবং সেই হিসেবে চিকিৎসা শুরু করবেন। এই চিকিৎসাও সময়সাপেক্ষ বিষয়। তা সম্পন্ন না করলে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসা বা সমস্যা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে। সঠিক এবং সম্পূর্ণ চিকিৎসাই এই সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দিতে পারে।