হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ক্যালেন্ডারটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে স্বপ্নীল। হঠাৎ করেই তার জীবনের সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। কিছুদিন আগেও কত সুন্দর কাটছিল তার দিনগুলো। অফিসে তাকে সকলেই খুব পছন্দ করতেন। ম্যানেজারের তার কাজে এতটাই খুশি হয়ে গিয়েছিলেন যে অগ্রিম পদোন্নতির তদবির পর্যন্ত করে ফেলেছিলেন।
কিন্তু গত দুই সপ্তাহে সবকিছু যেন বিপরীত মেরুতে বাক নিল। তার জীবন থেকে সুসময় যেন ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল। কিছুতেই যেন নিজেকে আটকে রাখতে পারছিলেন না স্বপ্নীল। অফিসে সকলের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে লাগলেন। ম্যানেজারের সাথে সেদিনের দুর্ব্যবহার তো পুরো অফিসের আলোচনার খোরাক হয়ে উঠেছিল।
ধীরে ধীরে কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছিলেন স্বপ্নীল। একসময় মনে হতে লাগল তার এই জীবনটাই বৃথা। এই জীবন থেকে তার কোনো কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই। মনের মধ্যে সবসময় বাজতে থাকে, কেন এই বেঁচে থাকা? তাই তো গত তিন দিন আগে, প্যাকেটের সবগুলো ঘুমের ওষুধ একসাথে খেয়ে নিয়েছিল স্বপ্নীল। সেই থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসায় আছে। সকালবেলা ছোট বোন মিলির কাছে শুনেছে, ডাক্তারদের ধারণা, তিনি সম্ভবত বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। এসম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না স্বপ্নীলের। তাই স্বপ্নীলের মতো অনেকের এই না জানা বিষয়টিকে জানানোর প্রচেষ্টায় আজকের লেখাটি।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার কী?
ইংরেজি ‘bipolar’ বা ‘বাইপোলার‘ এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘দ্বিমেরু’। অর্থাৎ এখানে মানুষের মানসিক সমস্যার দুটি মেরু বা পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে। এই ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক আচরণ বা অভিব্যক্তি দুটি ভিন্ন সময়ে পুরোপুরি ভিন্ন হয়ে উঠে।
যেমন, একটি সময় মানুষের মন হয়ে ওঠে অসম্ভব প্রাণবন্ত। যেকোনো কাজে সে চরম উৎসাহ-উদ্দীপনা অনুভব করে। এই সময় তার চরিত্রে অনেক বেশি কর্মস্পৃহা এবং উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়। এই সময় ব্যক্তির মন অসম্ভব আত্নবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, যার কারণে অনেক ভয়াবহ ও বিপদজনক কাজে বাড়াবাড়ি রকমের সাহস দেখিয়ে ফেলতেও পিছপা হন না। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় মনের এই স্তরকে বলা হয় ‘ম্যানিয়া’। ম্যানিয়ার প্রাথমিক স্তরকে বলা হয় ‘হাইপোম্যানিয়া’।
অন্যদিকে কিছুদিন পরেই ধীরে ধীরে মনের এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে স্বাভাবিক অবস্থায় আসে। কিন্তু বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি এই অবস্থায় বেশিদিন থাকতে পারেন না। কিছুদিন পরেই আবার মনের আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মনের মাঝে অকারণেই একধরনের অবসাদ অনুভব করেন। এক ধরনের নৈরাশ্য বা হতাশা পেয়ে বসে তার মন জুড়ে। অনেকের মাঝে থেকেও তখন নিজেকে একাকী মনে করতে থাকেন ব্যক্তিটি। কোনোকিছুতেই যেন তার মন বসতে চায় না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং সামাজিক যোগাযোগ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে চান।
আক্রান্ত ব্যক্তিটি এসময় কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারেন না। স্মৃতিশক্তিও খানিকটা ক্ষীণ হয়ে আসে তার। রাতে অনেক ধরনের চিন্তায় ঘুম আসতে চায় না। নিজের জীবনকে উদ্দেশ্যহীন বলে মনে হয়। মনের এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘ডিপ্রেশন’ বা ‘অবসাদগ্রস্থ’ পর্যায়। এই পর্যায়ের সবচাইতে বিপদজনক বা শেষ স্তর হলো আত্মহত্যা করার প্রবণতা।
কারণসমূহ
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। বিভিন্ন কারণে এই ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে। তবে এই রোগের সাধারণ কারণগুলো নিয়েই আলোচনা করা হল।
বংশগত বা জিনগত
সাধারণত ধারণা করা হয়ে থাকে বংশগতভাবেই এই সমস্যার সূত্রপাত। অর্থাৎ পরিবারে যদি কারো এই মানসিক সমস্যা থেকে থাকে তবে পরবর্তী প্রজন্মের কারো মাঝে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ
অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলেও এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- চাকরিক্ষেত্রে জটিলতা, সংসারে জটিলতা, আর্থিক সমস্যা, ব্যবসায় ক্ষতি অথবা বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতির কারণেও এই ধরনের সমস্যা হতে পারে।
শৈশবের স্মৃতি
ছোটবেলার এমন কোনো মানসিক বা শারীরিক আঘাতের স্মৃতি যা মনের কোঠায় বিভীষিকার মতো রয়ে গেছে, যার কথা কাউকে বলা হয়ে ওঠেনি বা বলার যোগ্যও নয়, যা সবসময় নিজের অজান্তে মনকে পীড়া দিয়ে উঠে; এই ধরনের ঘটনা বা স্মৃতি পরবর্তীতে এই ধরনের মানসিক সমস্যার জন্য দায়ী হয়ে উঠে।
লক্ষণসমূহ
যেহেতু এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ ম্যানিয়া পর্যায় থেকে ডিপ্রেশন পর্যায়ে পুরোই পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেই হিসেবে এদের লক্ষণগুলোও একজন ব্যক্তির মাঝে প্রায় ভিন্নভাবে প্রদর্শিত হয়। তবে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনো নিজের মনের অবস্থা বুঝে উঠতে পারেন না। তাই পরিবার এবং কাছের মানুষদের এই মানসিক সমস্যা সম্পর্কে ধারণা থাকা খুব প্রয়োজন।
ম্যানিয়া পর্যায়ের লক্ষণসমূহ
- অনেক বেশি কথা বলা এবং কথার মাঝে কাউকে কথা বলতে না দেয়া
- গল্প বা আড্ডার মূল বিষয়বস্তু থেকে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়া
- সর্বদাই বিভিন্ন চিন্তায় নিজেকে মগ্ন রাখা
- যেকোনো কাজে অতিরিক্ত আগ্রহ এবং পারদর্শীতার পরিচয় দেয়া
- অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া
- হিসেব ছাড়া খরচ করা বা সব অর্থ উজাড় করে দেয়া
সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হলে এই পর্যায় তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই পর্যায়ে ব্যক্তির স্বতন্ত্রতা এবং বিচার শক্তি হ্রাস পায়। যে কেউ তাকে দিয়ে যেকোনো কাজ করিয়ে নিতে পারে। ফলে এই সময় আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক বিপদজনক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারেন। আর ম্যানিয়ার স্বল্পমাত্রার রূপ হলো হাইপারম্যানিয়া, যা তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
ডিপ্রেশন বা অবসাদগ্রস্থ পর্যায়
এই পর্যায়ের লক্ষণসমূহ ম্যানিয়া পর্যায়ের পুরোই উল্টো।
- অনেক বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়া
- যেকোনো কাজে উদ্বেগ এবং আতঙ্কিত বোধ করা
- সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করা এবং একধরনের অপরাধবোধ কাজ করা
- জীবন নিয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়া
- ঘুম কমে যাওয়া
- যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া
- প্রেরণা হারিয়ে ফেলা
- আত্মহত্যার চেষ্টা করা
এই পর্যায় খুব তীব্র হয়ে উঠলে দুই সপ্তাহ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে খুব বেশিদিন স্থায়ী হলে এই ধরনের রোগী সর্বশেষ প্রয়াস হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেন।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ধরন
সাধারণত চার ধরনের বাইপোলার ডিসঅর্ডার দেখা যেতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার-১
একজন ব্যক্তি যখন ম্যানিয়া পর্যায় থেকে ডিপ্রেশন পর্যায়ে নিয়মিত পরিবর্তিত হতে থাকেন তখন তাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার-১ বলা হয়। এই ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই মূলত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। তবে এই ধরনের সমস্যা যদি এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী না হয় তবে তাকে জটিল সমস্যা বলে বিবেচনা করা হয় না।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার-২
এই ধরনের ব্যাধিতে রোগী শুধুমাত্র হাইপোম্যানিয়া পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা ম্যানিয়াতে রূপান্তরিত হয় না। অন্যদিকে একবার অন্তত ডিপ্রেশন পর্যায় অনুভব করেন।
সাইক্লোথাইমিয়া
কোনো ব্যক্তি যদি হাইপোম্যানিয়া বা হালকা অবসাদের পর্যায় জীবনে কয়েকবার উপভোগ করে তবে তাকে সাইক্লোথাইমিয়া পর্যায় বলে। এই ধরনের পর্যায়ে কোনোটাই বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাই এই পর্যায় তুলনামূলকভাবে অনেক সাধারণ।
অন্যান্য
বাইপোলার ডিসঅর্ডার ছাড়াও কোনো ব্যক্তি বিশেষের মেজাজ বা আচরণ পরিবর্তিত হতে পারে। সেই সকল সমস্যাকে অন্যান্য পর্যায়ে ধরা হয়।
চিকিৎসা
বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসা একটি বড় বাঁধা। এর প্রধান কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি কখনোই নিজের সমস্যা বুঝতে পারেন না অথবা বুঝতে পারলেও মানসিক সমস্যার ব্যাপারটি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। এই কারণে পরিবারের অন্যান্যদের এই সমস্যা সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি পরিবারের কারো এই সমস্যা থেকে থাকলে তা গোপন না করে সবাইকে জানিয়ে দেয়া উচিত। সমস্যা খুব তীব্র পর্যায়ে চলে গেলে কোনো অভিজ্ঞ মনোবিশেশজ্ঞ বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। নিয়মিত মেডিটেশন করা, যোগব্যায়াম করা, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন এবং এই রোগ সম্পর্কে অনেক বেশি জানার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ফিচার ইমেজ- writology.com